logo ০১ মে ২০২৫
সমন্বয়হীন উন্নয়নে অপচয় ও জনদুর্ভোগ
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
১৮ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:৪৬:০৪
image

ঢাকা: তেজগাঁওয়ের সড়ক সংস্কারের দাগ মুছেনি এখনও। এরই মধ্যে আবার সড়কটি কাটছে ওয়াসা। পানির পাইপ বসাচ্ছে তারা।


তেজগাঁওয়ের ভাঙাচুরা সড়ক নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভ ছিল কয়েক বছর ধরে। চলতি বছরের শুরুর দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পর সড়কগুলো সংস্কারে যাতায়াতের ভোগান্তি যেমন দূর হয়, তেমনি ক্ষোভ মেটে এলাকাবাসীর। কিন্তু এরই মধ্যে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হওয়ায় বিরক্তি জানিয়েছে এলাকাবাসী।


এই কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরও এক মাস। এতে এলাকার পানির সংকটের সমাধান হবে বলছে সংস্থাটি। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সড়কগুলোর আবার কী দশা হয় তা নিয়ে থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন।


কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সড়ক কাটার পর তা মেরামত না করে ফেলে রাখা হয় দীর্ঘদিন অথবা সংস্কার করার পর ওই জায়গায় সড়ক ভেঙে যায় দ্রুত। বিশেষ করে বর্ষাকাল এলেই বৃষ্টির পানি জমে তৈরি হয় গর্ত। পড়ে এই গর্ত বাড়তে থাকে।


মিরপুর রোড, ধানমন্ডি, গুলশান লিংক রোড থেকে সাতরাস্তা হয়ে সড়কে পানির বড় পাইপলাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু মিরপুর রোড এবং গুলশান লিংক ও সাতরাস্তা থেকে গুলশান লিংক রোডের শুরু পর্যন্ত সড়কটির সংস্কার হয়নি ভালোভাবে।


এখানে সেখানে এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে মেরামত করা সড়কটি। বৃষ্টি হলে সড়কের ভাঙা অংশ আরও বড় হয়। এতে যান চলাচলে ঘটে বিঘ্ন। আবার পথচারীদের গায়ে লাগে গাড়ির চাকা থেকে ছিটকে আসা কাদাপানি।  


গত প্রায় এক মাস ধরে তেজগাঁওয়ে পানির পাইপ বসাতে অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তির আশ্রয় নিচ্ছে ওয়াসা। যাতে সড়ক পুরোটার বদলে সড়কের বিভিন্ন অংশ কেটে এর মধ্য দিয়ে পাইপ বসানো হচ্ছে। তবে মোহাম্মদপুরের চিত্রটা এ রকম নয়।  দেড় বছর আগে মেরামত করা বিভিন্ন গলি কেটে বসানো হয়েছে পয়ঃনিষ্কাশন লাইন।


এক মাসেরও বেশি সময় আগে কাজ শেষ হলেও এখনও সংস্কার হয়নি সড়ক। কাজ করার সময় সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সাইনবোর্ড দেয়া হলেও সড়ক কাটাকাটির পর এর সংস্কার কবে হবে তাও জানায়নি ওয়াসা।


এটি কেবল এই দুটি সড়কের চিত্র নয় বা কেবল চলতি বছরের সমস্যা নয়। আবার কেবল ওয়াসা একাই এই খোঁড়াখুঁড়ি করে তাও নয়। নানা সময় সরকারি বিভিন্ন সংস্থা সড়ক কেটে মাটির নিচে বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন লাইন বসায়।


কখনও দেখা গেছে যে, একটি সংস্থার কাজ শেষ হওয়ার পর সড়কটি সংস্কারের পর পর অন্য একটি সংস্থা আবার কাটে সড়ক। নগর পরিকল্পনাবিদরা একাধিকবার এ রকম কাজ করার ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলছেন, সমন্বয় করে কাজ করলে জনগণের ভোগান্তি যেমন কমত, তেমনি রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ও রোধ হতো।


এই সমন্বয়ের জন্য কথা হচ্ছে দুই দশক ধরেই। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে  না। ফলে জনগণের ভোগান্তিও কমছে না।


বিরক্ত ঢাকাবাসী


তেজগাঁও এলাকার পানির সংকট সমাধানে ওয়াসা পাইপলাইন বসাচ্ছে অথচ এ নিয়ে বিরক্ত এই এলাকার বাসিন্দারা। এদের একজন আবদুস সালাম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘কয়েক মাস আগে রাস্তাটি মেরামত করানো হয়েছিল। এখন আবার রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে। এরপর হয়ত আবার মেরামত হবে। এভাবে বছরের ছয় মাসই যদি সড়কে চলাচলে সমস্যা হয়, তাহলে আমরা যাব কোথায়?’


আবদুস সালাম বলেন, একবার কাটে ওয়াসা, আরেকবার তিতাস আর ভোগান্তিতে পড়ি আমরা। মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয় হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা জামালগীর আলমও বিরক্ত এই খোঁড়াখুঁড়িতে। এই এলাকায় সড়কগুলো কেটে পানির পাইপ বসানো হয়েছে দুই বছর আগে। সে সময় এই এলাকায় দুর্ভোগ এত বেশি হয়েছিল যে, বেশ কয়েকটি প্রধান দৈনিকে প্রধান শিরোনাম হয়েছিল। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও করেছিল একের পর এক প্রতিবেদন।


ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফের ডটকমকে জামালগীর বলেন, ‘সে সময় ঘরে ঢুকতে বা ঘর থেকে বের হতে কাদাপানি আর যানজটে ভুগেছি। এবার বর্ষাকালের আগেই কাজ শেষ হওয়ায় তাও একটি স্বস্তিতে আছি। কিন্তু কেটে রাখা সড়কে কেবল মাটি আর ইটের সুরকি ফেলে গেছে। বৃষ্টি হলে আবারও হয়ত কাদায় মাখামাখি হয়ে বাসায় ঢুকতে হবে।’  


সমাধান কঠিন নয়, কিন্তু নেই উদ্যোগ


নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম মনে করেন, বছরের পর বছর রাজধানীবাসীর এমন দুর্ভোগের বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিবেচনাতেই নেয় না বলেই এর কোনো সমাধান হচ্ছে না। ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘সব সংস্থা একসঙ্গে বসে আলোচনা করে কাজ করতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ থাকে না। আরও একটি সমস্যাও আছে। সরকারি একেক সংস্থার বাজেট পাস হয় একেক সময়। তবে এটাও পরিকল্পনার অভাবে হয়।’


এই সমন্বয় না হওয়ার জন্য অবহেলাই দায়ী বলে মনে করেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাজধানীতে উন্নয়ন কাজ করে এমন সংস্থা হাতেগোনা। এরা যদি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে তাহলে তেমন কোনো ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। এতে নগরবাসী যেমন উপকৃত হবে তেমনি রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ও হবে না।


ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস ডি এম কামরুল আলম চৌধুরীর অবশ্য দাবি করেছেন, তারা এই সমন্বয়ের জন্য বৈঠক করেন। তবে কিছু সমস্যা আছে যার সমাধান খুব সহজ নয়। ফলে একসঙ্গে সব সংস্থার কাজ করা কঠিন। 


কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়ন কাজ অকেকটাই নির্ভর করে বিদেশি দাতাদের ওপর। তারা যখন টাকা ছাড় করে তখনই আমাদের কাজ করতে হয়। আবার টাকা ছাড় করার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হয়। তাই আমাদের পক্ষে অন্য সংস্থার জন্য অপেক্ষা করা কঠিন।


আর একেক সময় একেক সংস্থার বাজেটের সমস্যাটির সমাধানও খুব সহজেই করা সম্ভব বলে মনে করেন পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ছোটোখাটো কিছু কাজ আছে যেগুলো হয়ত তাৎক্ষণিক করতে হয়। কিন্তু বড় কাজগুলো যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুরু এবং শেষ করার পরিকল্পনা থাকে তাহলে সেভাবেই আগাবে সরকারি সংস্থা আর টাকার সংস্থানও সে ক্ষেত্রে তেমন কঠিন কোনো কাজ হবে না।’


বিড়ম্বনার আরেক নাম বর্ষায় খোঁড়াখুঁড়ি


বাংলাদেশে অর্থবছর শেষ হয় ৩০ জুন। আর উন্নয়ন প্রকল্পে টাকা ছাড় করতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। তাই প্রতি বছরই দেখা যায়, সড়ক খুঁড়ে উন্নয়ন কাজের একটি হয় অর্থবছরের শেষদিকেই। আর এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় বর্ষা। বৃষ্টির মধ্যে মাটি খোঁড়াখুঁড়িতে দুর্ভোগ চরমে উঠে নগরবাসীর।


চলতি বছর তেজগাঁও আর মোহাম্মদপুরে ওয়াসার মাটি খুঁড়ে পাইপ বসানোর কাজ শেষ হবে বর্ষা আসার আগেই। তাই এই ভোগান্তি হয়ত এই দুই অঞ্চলের মানুষের সইতে হবে না। কিন্তু বেশকিছু এলাকায় আগের বছরগুলোর মতো এবারও সইতে হবে বর্ষায় খোঁড়াখুঁড়ির দুর্ভোগ।


ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস ডি এম কামরুল আলম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তেজগাঁওয়ের কাজ শেষ করে পাইপলাইনের কাজ শুরু করে নাখালপাড়ায়। এছাড়াও নগরীর সমস্যাসংকুল বিভিন্ন এলাকায়ও শুরু করে পাইপলাইন বসানোর কাজ।


বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই কেন এসব কাজ শেষ করা হচ্ছে না জানতে চাইলে ওয়াসার এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের তো এত লোকবল নেই যে, সব জায়গায় একসঙ্গে কাজ করব। তাছাড়া সব টাকাও একসঙ্গে ছাড় হয় না। তাই যত টাকা পাই, সে হিসাব করে পর্যায়ক্রমে কাজ করতে হয়।’


এই দুর্ভোগ লাঘবে উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা আগেভাগে ছাড় করা এবং বর্ষার আগে কাজ শেষ করার পরামর্শ বারবার দিয়ে আসছেন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং অর্থনীতিবিদরা। সরকারও নানা সময় বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই। এর জন্যও আমলাতন্ত্রের অবহেলাকেই দায়ী করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম।


(ঢাকাটাইমস/১৮এপ্রিল/টিএ/এএসএ)