logo ১০ মে ২০২৫
টকশো-বিজ্ঞাপনে বিরক্ত দর্শক জনপ্রিয় হচ্ছে বিদেশি চ্যানেল
বিলকিছ ইরানী, ঢাকাটাইমস
১০ আগস্ট, ২০১৪ ২০:১০:৪৫
image

ঢাকা: দেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন ও টকশো বিড়ম্বনা থাকায় বিদেশি চ্যানেলের দখলে এখন দেশের বিনোদন বাজার। দর্শক রীতিমতো বিরক্ত হয়েই দেশি চ্যনেলগুলো দেখতে চান না। ফলে দর্শকের ৭০ শতাংশই বিদেশি চ্যানেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বলে ক্যাবল টিভি দর্শক ফোরামের এক জরিপে বলা হয়েছে।


একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রায়ানস আর্কাইভসের মিডিয়া সম্পর্কিত একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলো দিনে প্রায় ৮ ঘণ্টা বিজ্ঞাপন প্রচার। আর টকশো প্রচার করেছে গত তিন মাসে চার সহস্রাধিক!


দেশে ২০টিরও বেশি টিভি চ্যানেল চালু থাকলেও দর্শকদের বিনোদনের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না বিজ্ঞাপন ও টকশোর কারণে। তাই বিনোদনের খোরাক না পেয়ে নারী-শিশুরা বিদেশি চ্যানেলের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আর ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়াল দেখার কারণে কিছু সংখ্যক নারীর মধ্যে একধরণের মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে দাবি করছেন অনেকেই।


সিরিয়াল দেখতে দেখতে ভুলে যাচ্ছে দেশীয় সংস্কৃতি। এছাড়া এবার ঈদের আগে স্টার জলসার সিরিয়াল ‘বোঝেনা সে বোঝেনা’ এর একটি চরিত্র পাখির নামে তৈরি পাখি ড্রেস নিয়ে আত্মহননসহ ইতোমধ্যে ঘটে গেছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা।


 দেশি চ্যানেল ছেড়ে বিদেশি চ্যানেলে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন ও মানহীন টকশোকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।


দর্শকরা অভিযোগ করে বলেন, দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে মানসম্মত অনুষ্ঠান প্রচার না হওয়ায় তারা নেহাতই নির্মল বিনোদনের জন্য বাধ্য হয়ে অন্য দেশের চ্যানেলে চোখ রাখছেন। আর দেশের টিভি চ্যানেলগুলো সস্তায় টকশো আর সিংহভাগ সময় বিজ্ঞাপন প্রচার করেই দায় সারছে তাদের ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচারের।


মিডিয়া ব্যক্তিত্ব পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আমাদের চ্যানেলগুলো এক সঙ্গে সবকিছু করতে চায়। তাই দর্শক ধরে রাখতে পারে না। আমাদের যথেষ্ট গুণী নির্মাতা ও শিল্পী আছে। কিন্তু তাদের সঠিকভাবে আমরা উপস্থাপন করতে পারছি না। পাশাপাশি আমাদের চ্যানেলগুলোর বিপণন পদ্ধতিতেও দুর্বলতা রয়েছে। উপস্থাপনায় বৈচিত্র আনা গেলে আমাদের দর্শকরা দেশীয় চ্যানেল থেকে বিমুখ হবেন না। চ্যানেলগুলোকে এমন অনুষ্ঠানসূচি রাখতে হবে যেখানে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকবে।  পাশাপাশি দর্শকদের নির্মল বিনোদন নিশ্চিত করতে পারে।


দেশি চ্যানেলে টকশো বিড়ম্বনা:


দেশের প্রায় সবগুলো টিভি চ্যানেলই টকশোর ছড়াছাড়ি। চ্যানেলগুলোর মধ্যরাতের অনুষ্ঠান তালিকায় আছে টকশোর আয়োজন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চ্যানেলগুলোর অতি ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণেই মানসম্মত অনুষ্ঠান প্রচার হচ্ছে না।


যেকোনো ইস্যুতেই বেসরকারি টেলিভেশন চ্যানেলগুলো টকশোর আয়োজন করে থাকে। তবে এর মধ্যে দু’একটি অনুষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলোতে কতটুকু মান সম্পন্ন আলোচনা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দর্শক মহলে।


অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি কারিগরি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান না থাকলেও টকশোর আলোচকরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেন। আবার অনেক আলোচককে দেখা যায় তিনি সব বিষয়েই আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন।


এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশের ২০টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মনিটরিং করে দেখা গেছে মোট ৪ হাজার ২৮৩টি টকশোর অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে ১ হাজার ৪৬৩টি টকশোতে। অন্য টকশোগুলো হয়েছে খেলাধুলা, শিল্প-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, আইনকানুন ও শিক্ষা বিষয়ে।


এই তিন মাস পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি টকশো আয়োজন করে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বেসরকারি টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশন। চ্যানেলটি বিভিন্ন ইস্যুতে ৫২৩টি টকশো করেছে।  তিন মাসে ৩৪২টি টকশোর আয়োজন করে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এটিএন বাংলা। তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাভিশন, চতুর্থ অবস্থানে চ্যানেল আই এবং পঞ্চম স্থানে আছে এসএ টিভি।


এর মধ্যে রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে বেশি সংখ্যক টকশো করেছে চ্যানেল আই। তিন মাসে এই বেসরকারি চ্যানেলটি মোট ২৮৪টি টকশো অনুষ্ঠান প্রচার করেছে যার মধ্যে ১৫৫টি টকশোর বিষয় ছিল রাজনৈতিক।


রাজনৈতিক বিষয় ছাড়া তিন মাসে মাত্র ৭৭টি টকশোর আয়োজন করেছে এশিয়ান টিভি। একাত্তর টিভি একই সময়ে ২২৬টি টকশো আয়োজন করেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে টকশো হয়েছে ১২৪টি।


এছাড়া গাজী টিভি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল২৪, বাংলাভিশন এবং মোহনা টেলিভিশন প্রত্যেকেই জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে শতাধিক রাজনৈতিক টকশো প্রচার করেছে। ২০টি চ্যানেলের ৯০ দিনের হিসেবে গড়ে একটি চ্যানেল প্রতিদিন দুইটির বেশি টকশোর অনুষ্ঠান প্রচার করেছে।


বেসরকারি ব্যাংকের চাকুরে সাইদুল বলেন, আগে আমাদের দেশের চ্যানগুলোতে ভালো নাটক প্রচার করা হতো। এখন অফিস থেকে ফিরে যেই চ্যানেলেই যাই সেখানেই দেখি টকশো। মজার বিষয় এসব টকশো থেকে শুধু রাজনৈতিক গালাগালি ছাড়া ভালো কোনো পরামর্শ আমাদের জন্য আসে না। তাই ভারতীয় কয়েকটি টিভি চ্যানেলই আমাদের বিনোদনের নির্ভর হতে হয়।


বিজ্ঞাপন বিড়ম্বনা:


বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রায়ানস আর্কাইভসের মিডিয়া মিনিটরিংয়ের গত এপ্রিল মাসের তথ্য অনুয়ায়ী দেশের ২১টি টিভি চ্যানেলের প্রতিটি গড়ে দৈনিক সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। এ তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি ও তালিকার সর্বনিম্নে রয়েছে মোহনা টিভি।


ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি প্রতিদিন গড়ে ৮ ঘণ্টা বিজ্ঞাপন প্রচার করে। এরপরই ৭ ঘন্টা ৪৩ মিনিট বিজ্ঞাপন প্রচার করে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মাই টিভি। আর দৈনিক ৭ ঘণ্টা বিজ্ঞাপন প্রচার করে আরটিভি। প্রতিদিন ছয় ঘন্টার বেশি বিজ্ঞাপন থাকে চ্যানেল আই, এশিয়ান টিভি, এটিএন বাংলা, দেশ টিভি ও গাজী টিভিতে। দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করে এনটিভি, বাংলাভিশন, এটিএন নিউজ, একাত্তর টিভি, চ্যানেল টুয়েন্টিফোর, মাছরাঙ্গা টিভি ও চ্যানেল নাইন। এছাড়া দিনে চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বিজ্ঞাপন প্রচার করে সময় টিভি, একুশে টিভি, এস এ টিভি ও বিজয় টিভি। মোহনা টিভি দিনে বিজ্ঞাপন প্রচার করে ২ ঘণ্টা ৪১ মিনিট। সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি দিনে গড়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে মাত্র ৪২ মিনিট।


দেখা যাচ্ছে দেশীয় নাটক শুরু হওয়ার ৫ মিনিট কিংবা ১০ মিনিট পরই শুরু হয় বিজ্ঞপন। কখনও কখেনও ৫ মিনিট নাটক আর ১৫ মিনিট বিজ্ঞাপন। অন্যদিকে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর একটি সাধারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, তারা আধা ঘণ্টার নাটকে ২২ মিনিট নাটক ৪ মিনিট করে ২ বার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বিজ্ঞাপনের শেষের দিকে ২মিনিট আবার ফিরে আসার সময় মাইনাস হয়।


কেন চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন ও টকশোর নির্ভর:


জানা যায় অধিকাংশ চ্যানেলেরই আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। কম বাজেট হওয়ায় তারা নির্মাণ করতে পারছেনা ভালো কোনো অনুষ্ঠান। এছাড়া অনেক চ্যানেল আছে যারা ঠিকমতো দিতে পারছেনা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন। এ নাজুক অবস্থা কাটিয়ে উঠতে বেশি লাভের আশায়ই তারা বাধ্য হচ্ছেন বিজ্ঞাপন ও টকশো নির্ভর হতে।


এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চ্যানেলগুলো ব্যবসা করতে বসেছে। টকশো আর বিজ্ঞাপনেই তাদের আয়। বিজ্ঞাপন না হলে তারা আয় করতে পারবেনা। আর টকশো মানসম্মত না হলে জনগণ দেখবে না এটাই স্বভাবিক।


অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, মানহীন টকশো বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, টেলিভিশন চ্যনেলগুলো টকশো আয়োজন করে থাকে তা ভালো। এ থেকে অনেক কিছুই জানা যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বিরক্তির কারণ হয় যখন অযোগ্য লোককে দিয়ে টকশো করানো হয়। চ্যানেলগুলোইকেই বুঝতে হবে তাদের ভালো মন্দ।


তিনি বলেন, চ্যানেলগুলো ব্যবসা করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে জনগণ কি চাচ্ছে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। আর মানসম্মত না হলে টকশো কিংবা নাটক কোনো কিছুই দর্শক গ্রহণ করবে না।


(ঢাকাটইমস/ ১০ আগস্ট/ ইরা/এএসএ)