বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও মনীষীদের দৃষ্টিতে মহানবী (স.)
জাকির হোসাইন আজাদী
১৭ মার্চ, ২০১৫ ০০:৩৭:০৫

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ও আগমনবার্তা এবং তাঁর কার্যক্রমের কথা কেবলমাত্র কুরআনে বলা হয়েছে, তা নয়। তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল কিতাব থেকে শুরু করে প্রায় সবগুলো ধর্মগ্রন্থেই তাঁর বিবরণ এসেছে। তেমনিভাবে বড় বড় অমুসলিম মনীষীরাও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। আলোচ্য প্রবন্ধে সে সমস্ত বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন মুনি ঋষিরা স্পষ্টভাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর নির্দেশ ও আদর্শ মেনে চলার মাধ্যমেই বিচার দিবসে মুক্তির উপায় সন্ধান করার কথা ব্যক্ত করেছেন—“লা ইলাহা হরতি পাপমইল্ল ইলহা পরম পদম, জন্ম বৈকুণ্ঠ অপ ইনুতি তজপি নাম মুহাম্মদম” আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নাই এই কথার ওপর বিশ্বাস ছাড়া পাপ মুক্তির কোন রাস্তা নেই। আল্লাহর আশ্রয়ই হলো প্রকৃত আশ্রয়। বৈকুণ্ঠে জন্মলাভের প্রত্যাশা করলে রবের আশ্রয় ব্যতিত কোন উপায় নেই। সে কারণে মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শের অনুসরণ জরুরি (উত্তরায়ণ বেদ, আনকাহি, পঞ্চম অধ্যায়)। ইহুদী ধর্ম গ্রন্থ তাওরাতে উল্লেখ করা হয়েছে, “আমি তাদের মধ্য থেকে তাদের ভাইদের মত একজন নবীর আবির্ভাব করবো এবং আমার আদেশ তার কাছে যাবে সে অনুযায়ী যারা চলবে না তাদের হিসাব নেব” (তাওরাতে পঞ্চম Dcutronomy ১৮:১৫-১৯) খ্রীস্টানদের ইঞ্জিল কেতাবে বলা হয়েছে—“যে সব নবীকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে তাদের সংখ্যা এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার, যারা সত্য কথাই বলেছেন। কিন্তু আমার পরে সকল নবী ও রসূলগণের জ্যোতি প্রকাশ লাভ করবে এবং অন্ধকার থেকে তিনি মানুষদেরকে আলোকিত পথের দিকে ডাকবেন। কারণ তিনি আল্লাহর রসূল। যিশু বলেছেন, তিনি তোমাদের যুগে আসবেন না তোমাদের কয়েক বছর পর তিনি আগমন করবেন। যখন আমার ওপর নাজিলকৃত ইঞ্জিল (বাইবেল) এমন অরক্ষিত হয়ে পড়বে যে, মাত্র ত্রিশজন মুমিন টিকে থাকবে। তখন আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের ওপর রহম করবেন এবং তাঁর রসূলকে পাঠাবেন যাঁর ওপর মেঘমালা ছায়া বিস্তার করবে। যাকে আল্লাহ মনোনীত করবেন তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ পরিচিত হবেন। তিনি আল্লাহবিমুখ লোকদের ওপর বিরাট ক্ষমতার অধিকারী হবেন এবং প্রতিমা পূজার মূলোত্পাটন করবেন। তিনি এমন সত্যতা নিয়ে আসবেন যে সকল নবীর সত্যতা থেকে অধিকতর সুস্পস্ট হবে (অধ্যায়-৭২)। প্রাচীন ধর্মগুলির অন্যতম বৌদ্ধধর্ম যার প্রচারক ছিলেন গৌতম বুদ্ধ (৪৮৫-৫৬৭ খ্রীষ্টপূর্ব)। এই ধর্মের অন্যতম গ্রন্থ দিগনিশিকায়াতে বলা হয়েছে, মানুষ যখন গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ভুলে যাবে তখন আর একজন বুদ্ধ আসবেন। যার নাম হবে মৈত্রেয়। এটা দ্বারা মুহাম্মদ (স.)-কেই বুঝানো হয়েছে। ভিক্ষু আনন্দ বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মৃত্যুর পর কে আমাদের উপদেশ দিবে? বুদ্ধ বললেন, আমিই একমাত্র বুদ্ধ বা শেষ বুদ্ধ নই। সময়মত আর একজন বুদ্ধ আসবেন। আমার চেয়েও তিনি পবিত্র ও অধিক আলোপ্রাপ্ত হবেন। তাছাড়া জগিবখ্যাত বিভিন্ন মনীষীরা মহানবীর ব্যাপারে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন। যেমন- স্কটল্যান্ডের খ্যাতিমান গ্রন্থাকার স্যার টমাস কারলাইল (১৭৯৫-১৮৬২ খ্রী:) তাঁর প্রধান গ্রন্থ অনু হিরোস হিরো ওয়ারশিপ এন্ড দি হিরোইন ইন হিষ্টোরীতে লিখেছেন- মহানবীর আগমনে মানুষের সার্বিক অবস্থায় এবং চিন্তাধারায় এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ জাতির এক বিরাট অংশ অন্য কারো কথা অপেক্ষা মুহাম্মদের কথায়ই অধিকতর আস্থাশীল। অন্ধকার হতে আলোর পথের দিশারী হযরত মুহাম্মদ (স.)। তিনি নিজে যা নন তাই হওয়ার জন্য তিনি ভান করতেন না। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এডওয়াড গিবন বলেন, আশ্রয়প্রার্থীর জন্য বিশ্বস্ততম রক্ষাকারী ছিলেন মুহাম্মদ (স.)। কথাবার্তায় সব চেয়ে মিষ্ট ভাষি, সবচেয়ে মনোজ্ঞ তাকে যারা দেখেছেন তারা আবেগাপ্লুত হয়েছেন—অপ্রত্যাশিতভাবে। যারা কাছে এসেছে তারা তাঁকে ভালবেসেছেন। পরে তারা বিবরণ দিয়েছেন তাঁর মত মহামানব আগে কখনো দেখিনি পরেও না। মুহাম্মদ (স.) এর স্মৃতিশক্তি ছিল গভীর, তাঁর রসিকতা ছিল শালীন। তাঁর কল্পনা ছিল উন্নত ও মহত্। তাঁর বিচার বুদ্ধি ছিল তীক্ষ্ম। জাগতিক শক্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেও মুহাম্মদ (স.) নিজ গৃহের কাজগুলোও করতেন। তিনি আগুন জ্বালাতেন, ঘর ঝাড় দিতেন, দুগ্ধ দোহন করতেন এবং নিজ হাতে কাপড় সেলাই করতেন। তাঁর আনীত ধর্ম বিধান সর্বলোকের জন্য প্রযোজ্য। কবি জন মিল্টন বলেছেন, “মুহাম্মদ আবির্ভূত হলেন ষষ্ঠ শতাব্দীতে এবং পৌত্তলিকতাকে নিশ্চিহ্ন করলেন। এশিয়া, আফ্রিকা ও মিশরের অনেকাংশ থেকে যার সর্বাংশেই আজ পর্যন্ত এক আল্লাহর উপাসনা প্রতিষ্ঠিত। স্যার উইলিয়াম ম্যুর বলেন, “আবির্ভূত হলেন একটি মানুষ মুহাম্মদ, ব্যক্তিত্ব ও ঐশী নির্দেশ পরিচালনার দাবিতে যুদ্ধরত গোত্রগুলোর অসম্ভব মিলনকে প্রকৃতই সম্পন্ন করলেন।” ডব্লিউ মন্টোগুমারী ওয়াট বলেছেন, “মুহাম্মদ (স.) তাঁর যুগে তিনি ছিলেন একজন সামাজিক সংস্কারক, এমনকি নীতির শাস্ত্রের ক্ষেত্রেও। তিনি সৃষ্টি করেছিলেন সামাজিক নিরাপত্তার এক নতুন পরিবার সংগঠন; আর উভয়টিই ছিল পূর্বেকার ব্যবস্থার ওপর বিরাট উন্নতি সাধন।” লেবাননের হিট্টি বংশীয় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও মার্কিন মুল্লুকে অধ্যাপনায় প্রশংসিত প্রফেসর ফিলিপ কে হিট্টি আরব জাতি ও দেশ নিয়ে অনেকগুলো তথ্যপূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি মহানবী সম্পর্কে বলেছেন, “মুহাম্মদ তাঁর স্বল্প পরিসর জীবনে অনুল্লেখযোগ্য জাতির মধ্য হতে এমন একটি জাতি ও ধর্মের গোড়াপত্তন করলেন যার ভৌগলিক প্রভাব খ্রীষ্টান ও ইহুদীদেরকেও অতিক্রম করলো। মানব জাতির বিপুল অংশ আজও তাঁর অনুসারী। অমায়িক ব্যবহার, অনুপম ভদ্রতা ও মহত্ শিক্ষার দ্বারা তিনি আরব জাতির অবস্থার পরিবর্তন ঘটান। মহত্ত্ব, সহানুভূতি ও বদান্যতার মাধ্যমে তিনি মানুষের হূদয় জয় করেন। তিনি ন্যায়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কখনো ন্যায় নীতি ও পূণ্যতার পথ পরিহার করেননি। তিনি ওয়াদা খেলাফ করেননি বা কাউকে প্রতারিত করেননি। এমনকি তার আজীবন শত্রু, যারা তাকে দেশ হতে বের করে দিয়েছিল এবং সমগ্র আরব জাতিকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল চূড়ান্ত বিজয়ে তিনি প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। ব্যক্তিগত আক্রোশে তিনি কখনো কাউকে শাস্তি দেন নাই। সমগ্র দেশের শাসনকর্তা হয়েও তিনি পূর্বের মতই দারিদ্র্যপূর্ণ জীবন-যাপন করতেন। যার ফলে মৃত্যুকালে তাঁর ওয়ারিশদের জন্য কিছুই রেখে যাননি।” অন্য একজন প্রাচ্য পণ্ডিত গিব তাঁর “মুহাম্মদেনিজম” শীর্ষক ইংরেজী গ্রন্থে বলেছেন, “আজ এটা এক বিশ্বজনীন সত্য যে, মুহাম্মদ নারীদেরকে উচ্চতর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।”(সংক্ষেপিত)
লেখক :সাংবাদিক