জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির পর রাজধানীতে সহিংসতার ঘটনায় ১১ জনকে ধরিয়ে দিতে পুলিশ পুরস্কার ঘোষণা করলেও একজনও ধরা পড়েনি দেড় বছরে। সেই ঘোষণার পর আবারও একই ধরনের পুরস্কার ঘোষণা করল পুলিশ। বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে জানিয়ে তাদের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দিলে প্রত্যেকের জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, যাদের ছবি প্রকাশ হয়েছে তাদের বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তাদের নাম-বাড়ি-পেশা কী সে বিষয়ে পুরো অন্ধকারে থাকায় ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। পরিচিতজনদের কেউ তথ্য দেবে, এই আশায় ঘোষণা করা হয়েছে পুরস্কার। এদের বিষয়ে তথ্যদাতার পরিচয় পুরোপুরি গোপন রাখার কথাও জানায় পুলিশ।
তবে অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে এবার সাফল্য আসবে কি না সে নিয়ে সন্দিহান খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাই। অবশ্য এবার রাজনৈতিক বিষয় না থাকায় পরিচিতজনরা তাদের বিষয়ে তথ্য দিতে উৎসাহী হবে বলেও আশা করছেন কর্মকর্তাদের কেউ কেউ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আসামি ধরতে বিভিন্ন সময় পুলিশ এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করলেও এর কার্যকারিতা খুব একটা নেই। কারণ আসামিরা আত্মগোপনে যাওয়ার সময় চেহারায় দৃশ্যমান পরিবর্তনসহ অনেক কৌশল বেছে নেয়। এতে সহজে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া প্রকাশ্যে ধরিয়ে দেওয়ার ঘোষণার পর আসামিরাও আরও সতর্ক হয়ে যান এবং নিরাপদ দূরত্বে চলে যান।
পুলিশের একজন সাবেক প্রধান মনে করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরনও পরিবতন হয়েছে। এখন আসামি ধরার কৌশলেও পরিবর্তন আনা উচিত। তিনি বলেন, ‘আসামিদের ছবি প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার আবেদন আন্তর্জাতিক একটি পদ্ধতি। এটি অনুসরণ করে অনেক সময় দাগি আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। তবে এখন আসামিদের আত্মগোপনের কৌশলেও পরিবর্তন এসেছে। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চিন্তাতেও ভিন্নতা আনা প্রয়োজন।’
গত পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে এলাকায় নারীদের যৌন নিপীড়ন চালানো হয়েছিল ওই এলাকায় পুলিশের ক্লোজসার্কিট (সিসি) ক্যামেরা ছিল, যা পুলিশ নিজেই জানিয়েছিল। ঘটনাস্থলের অদূরে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনা দমনে তারা ছিল অনেকটাই নির্লিপ্ত। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নেয়নি পুলিশ। তাছাড়া সিসি ক্যামেরা দেখে আসামি শনাক্ত এবং গ্রেপ্তারেও গত এক মাস দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই ছিল না। বরং ওই ঘটনার বিচার চাইতে গিয়ে হামলার শিকার হতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের। পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে বিচারের দাবিতে সরব ছাত্র-জনতাকে। পুলিশি নির্যাতনের ছবি ধারাবাহিকভাবে এসেছে পত্রিকার পাতায়। টিভিতেও প্রচার হয়েছে নির্যাতনের ভিডিও। অথচ ওই ঘটনায় নামকাওয়াস্তে একজন পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর এক মাস পর এসে আসামি ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে কার্যত অন্ধকারে থাকা পুলিশ।
এদিকে কয়দিন আগে এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পয়লা বৈশাখে নারীদের যারা উত্ত্যক্ত করেছে তারা ‘দুষ্টু ছেলের দল।’ স্বয়ং পুলিশ প্রধানের এমন বক্তব্যে হতাশ হয়েছিল বিচার প্রত্যাশীরা। তারা বলেছেন, পুলিশ প্রধান যখন এত বড় ঘটনাকে দুষ্টু ছেলেদের কা- বলে মূল্যায়ন করেন তখন বিচার নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘নারীদের উত্ত্যক্ত করা মোটেও কোনো ছোট অপরাধ নয়। এটাকে খাটো করে দেখলে নারীদের সম্মানকে ছোট করে দেখা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত দোষীদের খুঁজে বের করে অবিলম্বে শাস্তির মুখোমুখি করা। তাদের দায়সারা বক্তব্য মোটেও কাম্য নয়।’
পয়লা বৈশাখের ঘটনার পর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নারীদের নিপীড়নকারীদের ছবি প্রকাশ হয়। পথচারীদের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে ধারণ করা ছবিতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল দুষ্কৃতকারীদের। সেই তালিকাই এক মাস পর এসে প্রকাশ করল পুলিশ। অথচ গত এক মাস ধরেই ফেসবুকে দোষীদের নাম-পরিচয় নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে।
জামায়াতের নাশকতাকারীরা লাপাত্তা
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দ- কার্যকরের পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তা-ব চালায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। ভাঙচুর, আগুন, বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নাশকতা সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। ঢাকার কমলাপুরে একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও চিত্র দেখে ১১ জনের ছবিসহ তালিকা তৈরি করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ছবিসহ তালিকা ছেপে তা শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়। ঘোষণা করা হয় জনপ্রতি এক লাখ টাকা পুরস্কার। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই তালিকার একজনও আটক হয়েছেন কি না, পুলিশের কাছে সেই তথ্য নেই।
জানতে চাইলে ডিএমপি গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, ‘বিষয়টি আমার খেয়াল নেই। খবর নিতে হবে।