logo ২৬ এপ্রিল ২০২৫
মানবপাচারের নেপথ্যে কারা?
১৮ মে, ২০১৫ ০০:৪৪:১৯
image


মানবপাচারের শক্তিশালী চক্রের সঙ্গে সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনীতিকরাও জড়িত আছেন। যাদের নাম বারবার উঠে এসেছে তালিকায়। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে ওই অর্থে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং গভীর সমুদ্র থেকে শত শত মানুষকে উদ্ধার করা হলেও মানবপাচারকারী চক্রের হোতাদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মাঝেমধ্যে দু-একজন ছোটখাটো দালালকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরক্ষণে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধান করেছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ ও বলরাম দাস





সাগরপথে মালয়েশিয়ায় অবৈধ মানবপাচারের প্রসঙ্গটি এর আগেও আলোচিত হয়েছে নানা সময়। কিন্তু পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ছিল তা জানা যায়নি এতদিন। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গণকবর, বন্দি নির্যাতন কেন্দ্র, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া উপকূলে হাজার হাজার যাত্রীসহ নৌকার সন্ধান পাওয়ার পর মানবপাচার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে গোটা বিশ্বে। মানুষকে ভালো বেতনে বিদেশে চাকরি আর উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে এভাবে নৌকায় করে গাদাগাদি করে নিয়ে যাওয়া, পথে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, কাউকে কাউকে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেওয়া বা মাটিতে পুঁতে রাখা, সুযোগ বুঝে কোনো উপকূলে নৌকা থেকে নামিয়ে দেওয়া বা সাঁতরে যাওয়ার কথা বলে সাগরেই নামিয়ে দেওয়া, হাঙ্গরের আক্রমণে প্রাণ হারানো, এসব ঘটনা এখন প্রকাশিত হচ্ছে।

অমানবিকতার আরও নিদর্শন দেখাচ্ছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সরকার। সাগরে ভাসতে থাকা শত শত মানুষবাহী নৌকাগুলোকে ভিড়তে না দিয়ে জ্বালানি আর কিছু খাবার ও পানি দিয়ে সাগরে ফিরে যেতে বাধ্য করছে দেশগুলোর সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এরই মধ্যে বিপদ টের পেয়ে দালাল আর নৌকার মাঝি-মাল্লারা পালিয়েছে, এই নৌকা কীভাবে চালিয়ে কোথায় যেতে হবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই যাত্রীদের। সাগরেই কি হাজারো মানুষের মৃত্যু হবে? সে প্রশ্ন এরই মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে।

থাইল্যান্ড উপকূলে একাধিক নৌকায় যাত্রীদের ফেলে পালিয়েছে দালালরা। একটিতে কয়েকজন ছিল যারা নৌকা চালাতে পারত, জানত সাগরে দিক নির্ণয়। তারা উদ্যোগী হয়ে কয়েকটি নৌকা থেকে বাংলাদেশিদের একত্রিত করে তা চালিয়ে সেন্ট মার্টিনস পর্যন্ত আসতে পেরেছে। সেসব নৌকায় থাকা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের কী পরিণতি হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসছে নৌকাগুলোতে মানুষ মরতে শুরু করেছে। ইন্দোনেশিয়ার আচেহ উপকূলে ৭০০ যাত্রী নিয়ে ডুবেছে একটি নৌকা। স্থানীয় জেলেরা তাদের উদ্ধার করেছে। কতজন জানিয়ে গেছে সাগরে, তা অবশ্য জানা যায়নি। আরও কত নৌকা এভাবে ডুবেছে বা ডুববে, সে প্রশ্নেরও জবাব নেই কারও কাছে।

দালালদের সুন্দর কথায় ভুলে নৌকায় করে সাগরে পাড়ি দিয়ে যাওয়ার বিপদ বাংলাদেশের গণমাধ্যম আর সরকারি বিভিন্ন দপ্তর অবশ্য সতর্ক করে আসছে বহু বছর ধরে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বিপদকে গ্রাহ্য না করে যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার পণ করেছে হাজারো মানুষ। কেবল যশোরের একটি উপজেলাতেই শোনা যাচ্ছে চার হাজার মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা। এরা সবাই ভালো চাকরির লোভে পারি জমিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়।

আর এ ধরনের যাত্রী বাছাইয়ে দেশজুড়ে জালের মতো বিস্তৃত রয়েছে দালালরা। এভাবে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে কারও কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা, কারও কাছ থেকে ১০ হাজার, এমনকি বিনা টাকায় নিয়ে যাওয়ার প্রলোভনও দেখানো হয়। এদের একটি অংশকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয় থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার কৃষি খামারে।

এই দালাল চক্রের বিস্তৃতি কেবল বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে সারা বিশ্বেই। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবপাচারের ভয়াবহতা গণমাধ্যমে বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হলেও অতিলোভ মানুষকে এ থেকে দূরে রাখতে পারছেন না। কমদিনে বেশি আয় করে জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনে মরিয়া জনগোষ্ঠী তাই দালাল চক্রের দেখানো রঙিন স্বপ্নের ফাঁদে পা দেয়। এজন্য মানবপাচার বন্ধের জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি এই মানবপাচারকারীদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। সরকার মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত রাখতে হবে।



প্রকাশ হতে শুরু করেছে পাচারকারীদের নৃশংসতা

অনুসন্ধান ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, মানবপাচারের শক্তিশালী চক্রের সঙ্গে সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনীতিকরাও জড়িত আছেন। যাদের নাম বারবার উঠে এসেছে তালিকায়। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে ওই অর্থে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং গভীর সমুদ্র থেকে শত শত মানুষকে উদ্ধার করা হলেও মানবপাচারকারী চক্রের হোতাদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মাঝেমধ্যে দু-একজন ছোটখাটো দালালকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরক্ষণে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মানবপাচারকারীদের অন্তত ছয়জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনশর বেশি মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য।   

২০১৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কান নৌবাহিনী মাছ ধরার নৌকা থেকে ১৩৮ জনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করলে বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই নজরে আসে। সবশেষ থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের জঙ্গল থেকে বাংলাদেশিদের উদ্ধারের ঘটনায় মানবপাচারের ভয়াবহ রূপ ফুটে ওঠে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন রুট দিয়ে মানুষ বোঝাই ট্রলার ভাসিয়ে দেওয়া হয় সমুদ্রে। মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এসব ট্রলার গিয়ে ভিড়ে থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে। সমুদ্রপথে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন এবং ফিরে এসেছেন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে রোমহর্ষক কাহিনির বর্ণনা মিলেছে। ট্রলারে ওঠার পর থেকেই শুরু হয় নানা ধরনের নির্যাতন। বিশেষ করে দিনের পর দিন মাঝ সাগরে খাদ্যের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। তারপর তাদের থাইল্যান্ডের উপকূলের বিভিন্ন জঙ্গলে নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। দেশ থেকে স্বজনরা এই টাকা পরিশোধ না করলে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যারা টাকা দিতে পারেন তারা পাচারকারীদের হাত থেকে ছুটতে পারলেও অন্যদের দিনের পর দিন জঙ্গলেই কাটিয়ে দিতে হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০০৮ সালে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়, যার মেয়াদ শেষ হয় ২০১১ সালে। দ্বিতীয় আরেকটি কর্মপরিকল্পনা ২০১২ সালে শুরু হয়ে ২০১৪ সালে শেষ হয়। পাচার বন্ধের সব কার্যক্রম এই পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়ে থাকে। কিন্তু দুটি পরিকল্পনার একটিতেও সমুদ্রপথে মানবপাচারের বিষয়টি ছিল না। এমনকি ২০১৫-১৭ সালের খসড়া কর্মপরিকল্পনায়ও এ বিষয়টি স্থান পায়নি।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সমুদ্রপথে পাচার বন্ধে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। আগামী কর্মপরিকল্পনায় বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’

আবার ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন পাস হয়। আইনের অধীনে জাতীয় মানবপাচার দমন সংস্থা ও বিধিমালা, মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন বিধিমালা এবং মানবপাচার প্রতিরোধ তহবিল ও বিধিমালা করার কথা থাকলেও গত তিন বছরে কিছুই হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তাসনীম সিদ্দিকি বলেন, ‘সমুদ্রপথে মানবপাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। অতীতে কী হয়েছে না হয়েছে সেদিকে তাকিয়ে না থেকে এখন উচিত বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দেওয়া। মানুষ সচেতন হলেই যে, সব বন্ধ হয়ে যাবে না। এ নেপথ্যে যারা কলকাঠি নাড়ছেন তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করতে হবে।’



কক্সবাজারেও আছে গোপন শিবির

কেবল থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নয়, কক্সবাজারের উপকূলেও রয়েছে পাচারকারীদের অসংখ্য গোপন আস্তানা। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, কাটাবুনিয়া, শীলখালী, উখিয়ার মনখালী, ছেপটখালী, ইনানীর সোনারপাড়া, রামুর পেচার দ্বীপ- এসব এলাকাকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে পাচারকারীরা হাজার হাজার লোককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। পুলিশি অভিযানে পাচারকারী চক্রের হোতারা এখন গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। আর আস্তানাগুলো রয়েছে রোহিঙ্গাদের দখলে। সরেজমিনে দেখা গেছে, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাংসহ বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ঝুপড়ি ও ঝাউবাগান মানবপাচারকারীদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার হয়। রামুর হিমছড়ি সাগর উপকূলীয় ধোয়াপালং পাহাড়ি আস্তানা ধুইল্যাছড়িতেও আছে কয়েকটি গোপন আস্তানা। স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ের ভেতরে টিন ও মাটির ঘর বানিয়ে সেখানে এনে জড়ো করা হয় মানুষদের। পরে সুবিধাজনক সময়ে ট্রলারে তুলে দেওয়া হয় তাদের। ধুইল্যাছড়ির বাসিন্দা আলী আহমদ প্রকাশ লেইঙ্গা আলীর ছেলে আব্দুল করিম, তার ছেলে মোহাম্মদ শফি প্রকাশ বাক্কুল্ল্যাসহ বেশ কয়েকজন এর সঙ্গে জড়িত।



নাম-পরিচয় সবই জানে পুলিশ

পুলিশের অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন মানবপাচারকারী নিহত হওয়ার পর ভয়ে আত্মগোপনে গিয়েছেন অন্যরা। গোয়েন্দা সংস্থার যে প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী আরও অন্তত ৩০০ মানবপাচারকারী আছেন কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।  উখিয়া উপজেলার সোনারপাড়া গ্রামের নুরুল কবিরের স্ত্রী রেবেকা সুলতানাই আজকের রেবি ম্যাডাম। মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম এই নারীর নাম পুলিশের খাতায় থাকলেও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের আশীর্বাদে পার পেয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিছুদিন আগে মানবপাচারের এক কোটি ২০ লাখ টাকার চেকসহ কক্সবাজার আদালতপাড়ায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটকের পর জামিনে বেরিয়ে এসেছেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকে তার কত টাকা আছে তিনি নিজেই জানেন না। কক্সবাজারের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তার। যে কারণে মানবপাচারকারী হয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন তিনি।

উপকূলের জুম্মাপাড়া, সোনারপাড়া, সোনাইছড়ি, চোয়াংখালী, ছেপটখালীসহ ইনানীর শীর্ষ পাচারকারীদের সঙ্গে স্থানীয় ইনানী পুলিশ ফাঁড়ি ও উখিয়া থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্যের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। মালয়েশিয়ার নাম করে সমুদ্রে লোক বোঝাই ট্রলার নিরাপদে ভাসিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে নিয়মিত মাসোহারাও পেতেন পুলিশ সদস্যরা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সোনারপাড়ার কালা মন্টুর ছেলে নুরুল কবির, সোনাইছড়ি গ্রামের মৃত ইউছুফ আলীর ছেলে রোস্তম আলী, সোনারপাড়া গ্রামের অজিউল্যাহর ছেলে কাউছার আহম্মদ জনি, ওমর সওদাগরের ছেলে আলমগীর হোছন রানা, পশ্চিম সোনাইছড়ি গ্রামের আবু ছৈয়দের ছেলে মাহাদু, নুর মোহাম্মদের ছেলে আহম্মদ শরিফ, মৃত হোছন আলীর ছেলে শাহ আলম, মৃত রশিদ আহম্মদের ছেলে আবদুল¬াহ, আব্দুল জলিলের ছেলে লাল মাঝি, মৃত মোজাফফর আহম্মদের ছেলে রাসেল, ফজল আহম্মদের ছেলে শামশু আক্তার, উত্তর সোনাইছড়ি গ্রামের হাবিব উল¬াহর ছেলে জয়নাল উদ্দিন জুনু, আমির হামজার ছেলে ছৈয়দ আলম, সুলতান আহম্মদের ছেলে মুজিবুল হক, সোনারপাড়ার জমির আহম্মদ প্রকাশ কালা জমির, সোনাইছড়ি গ্রামের শফি আলম, জমির আহম্মদ, শামশুল আলম সোহাগ, লম্বরী গ্রামের ছৈয়দ আলম তাবাইয়া, লাল বেলাল, রূপপতি গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে জমির মিয়া, চোয়াংখালীর জাহেদুল আলম, মোজাম্মেল হকের মতো শীর্ষ পাচারকারীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এর পেছনে পুলিশের সহায়তা রয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।

তবে পুলিশের দাবি, মানবপাচারকারীরা গা-ঢাকা দেওয়ায় তাদের আটক করা যাচ্ছে না। পুলিশ বলছে মানবপাচারকারীরা আপাতত পালিয়ে বেড়ালেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ছাড়া পাবে না।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম খান জানান, উপকূলীয় এলাকা দিয়ে আর যাতে মানবপাচারের মতো ঘটনা না ঘটতে পারে সেজন্য উপকূলীয় এলাকায় কমিউনিটি পুলিশকে কাজে লাগানো হয়েছে।

উপজেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি শফিউল আলম বাবু এবং জালিয়াপালং ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি শহিদুল্লাহ কায়ছার জানান, উপকূলীয় এলাকায় কমিউনিটি পুলিশের সদস্যদের তৎপর রাখা হয়েছে। তারা যে কোনো সময় পাচারকারীদের তথ্য থানা পুলিশের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করছে।



২৯৭ জনের সিন্ডিকেট

পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে মানবপাচারের সঙ্গে ২৯৭ জন পাচারকারী জড়িত বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জন আন্তর্জাতিক চক্রের, ২৬ জন দেশীয় হুন্ডি ব্যবসায়ী ও ইয়াবা পাচারকারী। আর ২৬০ জন দেশের আনাচে-কানাচে থাকা পাচারকারী চক্রের সংঘবদ্ধ সদস্য। এছাড়া কক্সবাজার জেলা পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবও একটি তালিকা তৈরি করেছে। এতে রয়েছে কক্সবাজারের  সাড়ে তিনশরও বেশি পাচারকারীর নাম।  দুটি তালিকাতেই রয়েছে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাসহ অনেক রাঘব বোয়ালের নাম।

উভয় তালিকায় রয়েছে উখিয়া-টেকনাফের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ভাই মুজিবুর, শফিক, ফয়সাল ও সাংসদের আত্মীয়স্বজন ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত অনেক রাজনৈতিক নেতার নাম। রয়েছে জেলার অনেক রথী-মহারথীর নাম। তবে এ পর্যন্ত এদের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে পুলিশ হেডকোয়াটার্সের তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য মতে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রকে অর্থায়নে রয়েছে ২৬ জন। যার ২২ জনই টেকনাফের বাসিন্দা। এতে রয়েছে উখিয়া- টেকনাফের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নিকটজনও। এরা হলো টেকনাফের চৌধুরীপাড়ার অং শ্যাং থার ছেলে এমপি বদির খালাতো ভাই মং মং সেন, টেকনাফের ডেইল পাড়ার কালো মো. আলীর তিন ছেলে নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আমিন, আবদুল আমিন, লামারবাজার এলাকার হুন্ডি আবদুল জলিল, তার ছেলে মো. ইসমাইল, বাজারপাড়ার হাজি আলী হোসেনের ছেলে বাট্টা আয়ুব ও মো. ইউনুচ, টেকনাফের জালিয়াপাড়ায় জাফর আলম ওরফে টিপি জাফর, একই এলাকার শাহজাহানের ছেলে জাফর সাদেক, শাহপরীর দ্বীপের মৃত আবু শামা প্রকাশ বাড়– হাজির ছেলে হেলাল উদ্দিন, ইমাম শরীফের ছেলে ফাইসাল, রহিম উল্লাহর ছেলে আবদুল্লাহ, মৃত নবী হোসেনের ছেলে মো. জামাল, সাবরাংয়ের আছারবুনিয়ার মৃত হাকিম আলীর ছেলে মো. হারুল, সাবরাংয়ের সিকদারপাড়ার মুচা আলীর ছেলে আবদুস শুক্কুর, টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরী পাড়ার মো. ইসমাইলের ছেলে ও এমপি বদির ভাই মুজিবের সহযোগী মো, ইসলাম, টেকনাফ বাস স্টেশনের মুদির দোকানদার হামিদ হোসেন, সাবরাংয়ের আছারবুনিয়া এলাকার মো. আলীর ছেলে মুফিজুর রহমান, টেকনাফের আল জামিয়া মাদ্রাসার সামনের ফার্মেসীর আবু বক্কর, নাইট্যাংপাড়ার ফজল আহমদের ছেলে আবু বক্কর, টেকনাফের কুলাল পাড়ার শামসুল হুদার ছেলে নুরুল আবসার। টেকনাফের পুলিশের এক সোর্স জানান, তালিকায় থাকা টেকনাফে শীর্ষ মানবপাচারকারীরা এলাকাতেই রয়েছে।



সাংসদ বদির নামও পুলিশের তালিকায়

পুলিশ মানবপাচারে জড়িত অভিযোগে ১৭৬ জনের যে তালিকা করেছে তার মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফেরই আছে ৭৯ জন। অভিযানের আগে আলাদাভাবে এই তালিকা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে তা। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে। স্বারষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তালিকায় আছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদি, টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র-১ ও বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান ও টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ।

সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি অবশ্য দাবি করেছেন, তালিকায় তার নাম তোলা পুরোপুরি ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, ‘আমি যখনই মানবপাচার নিয়ে প্রতিবাদ করেছি তখনই আমার নাম এখানে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় আমাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে মালয়েশিয়া থেকে। এর আগেও ইয়াবা পাচারের বিরুদ্ধে যখন আমি অবস্থান নিয়েছি তখন এই চোরাচালানে আমার নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে।’  

এই তালিকায় স্থান পাওয়া সবার বাড়ি কক্সবাজার জেলায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার-পাঁচ বছর আগেও কক্সবাজার জেলার লোকজন পাচারকারীদের ২০ থেকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি মাসে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেত। যাত্রাপথে ট্রলারসহ যেসব যাত্রী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে ধরা পড়ত তাদের মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশ যাত্রীই মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গা। তখন মালয়েশিয়ায় সমুদ্রপথে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো ফিশিং ট্রলার। এসব ট্রলার ছিল খুবই নিম্নমানের এবং ট্রলারগুলো মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর ভেঙে ফেলা হতো। গত এক থেকে দেড় বছর ধরে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের কার্গো ট্রলার। টেকনাফের তালিকাভুক্ত মানবপাচারকারীরা হলো আবদুর রহমান বদি (৪৩) পিতামৃত এজাহার মিয়া, জাফর আহমদ (৫১) পিতামৃত সুলতান আহমদ, মৌলভী মুজিবুর রহমান (৩২) পিতামৃত এজাহার মিয়া, মো. ধলু হোসেন (৫৫) পিতামৃত সুলতান আহমদ, মো. ইউনুছ (৪০) পিতামৃত সুলতান আহমদ, মো. ইসমাইল (৩৫) পিতা ছালে আহমদ, ফিরোজ আহমদ পিতামৃত আবু শামা ওরফে বাডু হাজী, দেলোয়ার (৩৮) পিতামৃত আবদুল মোতালেব, মো. সাহাব মিয়া, পিতামৃত সুলতান আহমদ, মো. শরীফ হোসেন (৪০) পিতামৃত জালাল আহমদ, শরীফ হোসেন ভুলু (৪৫) পিতামৃত মো. হোসেন, সাহেদুর রহমান নিপু পিতা আবদুর রহমান ওরফে অসি আবদুর রহমান, হামিদ হোসেন (৪০) পিতামৃত হাজী আবদুল করিম, জহির উদ্দিন ওরফে কানা জহির (৬০) পিতামৃত হোসেন আলী সিকদার, মৌলভী আজিজ পিতা মৌলভী নাছির উদ্দিন, নূর হাকিম মাঝি (৫৫) পিতামৃত গণি মিয়া, নূর মোহাম্মদ মেম্বার পিতা নজু মিয়া, মৌলভী বশির ওরফে ভাইলা পিতামৃত সুলতান আহমদ, নজির আহমদ ওরফে নজির ডাকাত পিতা আবদুর রহিম, আবদুল হামিদ (৪০) পিতা আবদুল, গুরা মিয়া (৩২) পিতামৃত মোছাব্বর আহমদ, মো. কাসেম ওরফে জিমা কাসেম (৫৫) পিতা অজ্ঞাত, মো. ইসলাম ওরফে বাগু (৩২) পিতা ফজল আহমদ, জাফর আলম (৩৫) পিতা ফজল আহমদ, আক্তার কামাল (৩৫) পিতা নজির আহমদ মেম্বার, শাহেদ কামাল (৩০) পিতা নজির আহমদ মেম্বার, আবদুল গফুর (৪০) পিতা আলু ফকির, হেবজ রহমান ওরফে হেবজ মাঝি (৪২) রোহিঙ্গা পিতা অজ্ঞাত, মো. নুরুল হুদা পিতামৃত আবুল কাসেম, মো. নুরুল কবির পিতামৃত আবুল কাসেম, আমান উল্লাহ ওরফে আনু পিতা মো. শফি, বেলাল উদ্দিন (২২) পিতা মো. ধলু হোসেন, নূর হোসেন (৩২) পিতামৃত জালাল আহমদ, নুরুল আলম পিতা নজির আহমদ, এনায়েত উল্লাহ পিতা হাজী আলী হোসেন, মো. সেলিম পিতামৃত হোসেন, মো. হোসেন পিতা দলিল মিয়া, জাফর আহমদ পিতা জোর আহমদ, মো. শফিক পিতা মাহমুদুল্লাহ মাঝি, আবু তাহের পিতা আবুল কাসেম মিয়া, মো. জাফর পিতামৃত নূর আহমদ, আলী মাঝি পিতা অজ্ঞাত, সামসুল আলম পিতামৃত কবির, মো. সাব্বির আহমদ পিতামৃত আব্দুল লতিফ, মো. কামাল হোসেন পিতা কালা মিয়া, মো. হাসান পিতা ফয়জুর রহমান, মো. কবির হোসেন পিতা শফি মিয়া, মো. কবির হোসেন পিতা নূর আহমদ, সাদ্দাম (৪৫) পিতা নূর আহমদ, আবুল কালাম পিতা গুরা মিয়া, মো. শরীফ পিতা লাল মিয়া, মো. লিটন পিতা আবদুল্লাহ, মো. আবুল হাসেম পিতা মো. জালাল, মো. দলিল আহমদ পিতা মো. হোসেন, সিদ্দিক আহমদ, পিতা ইউসুফ আলী, ফয়েজ পিতা আজিজুর রহমান, নুরুল ইসলাম ওরফে কালা পুতু পিতা মৃত মকবুল আহমদ, জাহাঙ্গীর পিতা আব্দুল মাজেদ, মীর আহমদ পিতা অজ্ঞাত, মো. শাকের মাঝি (৩০) পিতা কবির আহমদ, নুরু মাঝি (৪০) পিতা নাজু মিয়া, হাফেজ মোক্তার, পিতা মৌলভী আবদুল গফুর, মো. সৈয়দ আলম পিতামৃত দুদু মিয়া, আব্দুর রহিম পিতা মঈনুজ্জামান, আলী আহমদ ওরফে আলী বলি, পিতা অজ্ঞাত, নুরুল ইসলাম মাঝি, পিতামৃত গোলাল আহমদ, আইয়ুব আলী মাঝি পিতামৃত আশরাফ আলী, আল মাসুদ পিতা মফিজুর আলম, জাহাঙ্গীর পিতা রবিউল হোসেন ওরফে আনসার, সোহাগ আবদুল্লাহ, পিতা আবদুর রহিম, কবির ওরফে ডা. কবির (৫০), পিতা অজ্ঞাত, মো. আলম ওরফে মাত আলম পিতামৃত আমির হামজা, এনায়েত উল্লাহ পিতা হাফেজ আবদুর রহমান, মো. শামসুল আলম, পিতা আব্দুর রশীদ, আবদুস সালাম ওরফে আবদু পিতা রশীদ আহমদ ও আজিজুল ইসলাম ওরফে পুতুইয়া পিতা রশীদ আহমদ।



ফিরে আসা যুবকের কথা

রামুর ধোয়াপালং নাপিতপাড়ার আবুল খায়েরের পুত্র আনোয়ার ইসলাম (২৫) থাইল্যান্ডের বন্দিদশা থেকে ফিরে আসার রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, পাশের গ্রামের দালাল সৈয়দের প্রলোভনে পড়ে তিনি সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। উন্নত মানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জাহাজে করে তাকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও মূলত তাকে একটি মাঝারি ধরনের ট্রলারে তোলা হয়। সেখানে ট্রলারে তাদেরকে ভালো করে ঘুমাতে-বসতেও দিত না, ছিল না কোনো ধরনের খাবার-দাবার। তার সঙ্গে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া শুকনা খাবার চিঁড়া-গুড় খেয়ে কোনোভাবে তিনি প্রাণ রক্ষা করলেও তার ট্রলারের ৫০ থেকে ৬০ জন যাত্রী অনাহারে ও ট্রলারে থাকা দালালদের নির্যাতনে মারা যায়। তাদের কারো কারো লাশ সাগরে ছুঁড়ে ফেলা হয় আবার অনেক মৃতদেহ থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়।

উখিয়ার সোনারপাড়া রেজুঘাট থেকে রওনা দেওয়ার ১২ দিন পর তাকে বহনকারী ট্রলারটি থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গিয়ে ভিড়ে। সেখানে তাদেরকে কাদার  ভেতর ও জঙ্গলে আটকিয়ে ব্যাপক শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। তার পরিবারকে জানানো হয় টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলা হবে। তার বাবা জানায়-তার পরিবার থেকে দালাল সৈয়দের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা ও জঙ্গল থেকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যেতে গাড়িভাড়া বাবদ আরো ১২ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আনোয়ার জানায়, জঙ্গল থেকে ছয় দিন ছয় রাত হটিয়ে তাদেরকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। খাবার, পানির চরম সংকটে অর্থমৃত অবস্থায় প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তার সঙ্গে থাকা আরো কয়েকজনসহ তারা হাঁটতে হাঁটতে মালয়েশিয়ার একটি জায়গায় গিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় হয়নি, সেখানে তাদেরকে আরেক দফা দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। চার মাস ধরে কাজ করিয়ে আটকিয়ে রেখে তাকে কোনো বেতন দেওয়া হতো না।

এক পর্যায়ে সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেখানকার এক পুলিশ ক্যাম্পে তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ মাস কারাভোগের পর সে তার বাড়িতে খবর পাঠিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা বিমান ভাড়া ঢাকায় এক দালালের মাধ্যমে পরিশোধ করে সে দেশে ফিরে আসে। আনোয়ারের মতো শত শত যুবক এভাবে দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে।



নিখোঁজ স্বজনদের আহাজারি

রামুর পূর্ব ধেছুয়াপালং হাকিম আলী বাপের পাড়ার আব্দুর রহমানের মেয়ের জামাতা সিলেটের তৌহিদুল ইসলামের ফেলে শহিদুল ইসলাম প্রায় ১৯ মাস আগে সাগরপথে অবৈধভাবে যাত্রা শুরু করলেও তার কোনো সংবাদ না পেয়ে স্ত্রী-সন্তানেরা আছে উৎকণ্ঠায়। একই পাড়ার এজাহার মিয়ার পুত্র নুরুল আমিন প্রকাশ মনিক্ক্যা দুই স্ত্রী ও ৫ সন্তান রেখে মালয়েশিয়ায় যাত্রা করলেও গত দেড় বছর ধরে তারও কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। শহিদ ও মনিক্ক্যার মত গত চার মাস ধরে খোঁজ নেই উখিয়ার মরিচ্যা পাতাবাড়ির মৃত আলি মিয়ার পুত্র মোহাম্মদ আলমের। কিছুদিন আগেও তিনি পরিবারের কাছে ফোন করে বলেছে টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলা হবে। এরপর অনেক ধারকর্জ করে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা পাঠানোর পরও এখনো পর্যন্ত তাকে ট্রলারে করে সাগরে ভাসানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এভাবে কক্সবাজার জেলার পাড়া-মহল্লায় শত শত লোককে এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। থাইল্যান্ডে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার সংবাদে তারা রয়েছে আতঙ্কিত অবস্থায়। অনেকে বিজিবির মাধ্যমে আবেদন করে মিয়ানমারের কোন কারাগারে তাদের স্বজনরা আছে সে বিষয়েও তৎপরতা চালাচ্ছে।



ছেলের আশায় এখনো পথ চেয়ে বসে থাকেন মা

কক্সবাজারের রামুর ধোয়াপালং পশ্চিম পাড়ার মাস্টার আব্দুল হামিদ ও খুরশিদা বেগম। ছেলেকে হারিয়ে আজ পাগল পিতা-মাতা ও ভাই বোন। ছয় মাস আগে পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে তার ছেলে স্থানীয় আল ফুয়াদ একাডেমির অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মহিউদ্দিন স্থানীয় দারিয়ারদীঘির দালাল মফিজ ও টেকনাফের দালাল সেলিম মাঝির মাধ্যমে ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে আটকা পড়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে মুক্তিপণ বাবদ দুই লাখ ১০ হাজার টাকা পাঠানোর পরও রেহাই মিলেনি মহিউদ্দিনের। দুই মাস আগে খবর আসে মহিউদ্দিনকে মেরে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে কবর দেওয়া হয়েছে। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।