logo ২৬ এপ্রিল ২০২৫
খালেদা না তারেক
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
০৬ মে, ২০১৫ ১১:২৮:০৬
image


সিটি নির্বাচনে ভোটের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে ভোটার এবং দলীয় কর্মীদের প্রতি বিশেষ আহ্বান জানিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ভোটারদের প্রতি তার অনুরোধ ছিল ‘নীরব বিপ্লব’-এর। ভোটের দিন সকাল থেকে কেন্দ্র পাহারা আর গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে কেন্দ্র ছাড়ার নির্দেশনা ছিল দলীয় কর্মীদের প্রতি। নীরব ভোট বিপ্লব হয়েছে কি হয়নি তা জানার উপায় নেই মাঝপথে বিএনপি ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোয়। তবে নেতা-কর্মীরা যে খালেদা জিয়ার আহ্বানে এতটুকু সাড়া দেননি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভোটের দিন সকাল থেকে প্রায় সব কেন্দ্রই ছিল বিএনপির এজেন্ট শূন্য। কেন্দ্র পাহারা তো দূরের কথা, পরিচিত কর্মীদের নিজ নিজ এলাকায় ভোট দিতেও দেখা যায়নি। আর এই সুযোগে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা দখল করে নেয় ভোটকেন্দ্রের একাংশ। আর ভোটের পরিবেশ না থাকার কথা বলে তিন ঘণ্টার মাথায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা আসে বিএনপি থেকে।

দলটির ভেতরে আলোচনা আছে, ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত এসেছিল লন্ডন থেকে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই ভোট শুরুর পর নির্বাচন থেকে সরে আসে দলটি। অথচ ভোট বর্জনের পরও ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের অনেকে এককভাবে তিন থেকে চার লাখ পর্যন্ত ভোট পেয়েছেন। যে কারণে বিএনপি নেতা-কর্মী ও প্রার্থীদের মনে সংশয় থেকেই যাচ্ছে, ভোট বর্জন না করলে হয়ত ফল অনুকূলে যেত তাদের। আবার তারা এটাও ভাবছেন, সরকার তাদের মনে আফসোস সৃষ্টির জন্যই তাদের পক্ষে ভোটের সংখ্যা বাড়িয়েছে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিন ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করতে না পেরে পরদিন থেকে ডাকা টানা হরতাল-অবরোধ চলাকালে দলীয় নির্দেশনা নিয়েও আছে নানা আলোচনা। দলীয় সূত্র জানায়, শুরুর দিকে টানা অবরোধের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। কিন্তু পরে অবরোধের পাশাপাশি টানা হরতালের নির্দেশনা আসে তারেক রহমানের কাছ থেকে। বিএনপিপ্রধান যখন জনদুর্ভোগে মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে অবরোধ-হরতাল আপাতত ক্ষ্যান্ত দেওয়ার কথা ভাবছিলেন তখনও নাকি তারেক রহমান বলেছিলেন ‘চালিয়ে যেতে’।

পাল্টাপাল্টি এসব নির্দেশনায় মাঝেমধ্যে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে দলটিকে। নেতা-কর্মীদের মধ্যেও আছে নানামুখী চিন্তাভাবনা। দলীয় যেকোনো বিষয়ে খালেদা জিয়ার পাশাপাশি তারেক রহমানের দিকেও তাকিয়ে থাকেন তারা। অনেক সময় নেতা-কর্মীরা বুঝে উঠতে পারেন না, কোন পথে পা বাড়াচ্ছে বিএনপি বা সামনের দিকে কী হতে যাচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে এমন অনেক কথাই চাউর আছে খোদ দলের নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, প্রশ্ন উঠছে-‘বিএনপি চালাচ্ছেন কে, খালেদা জিয়া না তারেক রহমান?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সময়ের আন্দোলনে বিএনপি সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আন্দোলনে ‘আপাত ব্যর্থতার’ নেপথ্যে নির্দেশনাও যে বড় কারণ সে কথা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে তারেক রহমানের প্রতিও পুরোপুরি ভরসা করতে পারছেন না দলটির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতে তারেক রহমানের জন্য দেশে ফেরা কঠিনই হবে বটে। অর্থ পাচারের মামলায় বিচারিক আদালত তারেক রহমানকে খালাস দিলেও রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেছে সরকার। আবার খালাস দেওয়া বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুদক। সামনে আছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়। এই দুই মামলার রায়ের ওপর বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যতেও অনেক কিছুই নির্ভর করছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সরকার যে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে শেষ করে দিতে ছক কষছে এটা বুঝতে আর কারো বাকি নেই। তারা দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রায় সবাইকেই কারাগারে রেখে বিএনপির নেতৃত্বকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব থেকে শুরু করে নেতৃস্থানীয় নেতাদের জেলে ভরে রেখে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশের কথা বলা হচ্ছে। এটা কি গণতন্ত্রের কোনো ভাষা হতে পারে? আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিরও শান্তিপূর্ণ রাজনীতি করার অধিকার আছে। কিন্তু সরকার জেনেবুঝেই এই অধিকার হরণ করছে।’

বিএনপির রাজনীতিতে কিছুটা মেরুকরণের আভাসও মিলছে বিভিন্ন পর্যায়ে। দলের তরুণ ও যুবক নেতা-কর্মীদের ভরসা তারেক রহমানের প্রতি। যাকে আগামী দিনে বিএনপির কা-ারি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এছাড়া চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মাঝামাঝি নেতারাও মনে মনে নাও বেঁধেছেন দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ঘাটে। তবে এর ওপরে যারা আছেন তাদের অবস্থা ভিন্ন। স্থায়ী কমিটি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের বেশির ভাগই এখনো তাকিয়ে আছেন খালেদা জিয়ার দিকে। বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও তারা মনেপ্রাণে এখনো তারেকের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না।

রাজনীতি বোদ্ধাদের মতে, বর্তমান সরকার এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্থিতিশীল জায়গাতেই রয়েছে। পদত্যাগ কিংবা পতনের মতো কোনো পরিস্থিতিতে এখন তাদের পড়তে হয়নি। ভবিষ্যতেও যে বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে পারবে সেই নমুনাও নেই। তাই সরকার যদি পুরো মেয়াদ শেষ করে তাহলে জাতীয় নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে আরও তিন বছর আট মাস অপেক্ষায় থাকতে হবে। দীর্ঘ এই সময়ের পর বিএনপি চেয়ারপারসন দল পরিচালনায় শারীরিকভাবে কতটুকু সক্ষম থাকবেন তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ তার বয়স হয়েছে। বাধ্য হয়েই হয়ত সরে যেতে হবে দলের নেতৃত্ব থেকে। সেক্ষেত্রে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে থাকবেন তারেক রহমান। তাই এখন থেকেই নেতা-কর্মীরা তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য দেখানোর অভ্যাস গড়ে তুলছেন।

দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা আক্ষেপ করে বলেন, ‘মাঝেমধ্যে দলীয় সিদ্ধান্ত কোত্থেকে আসে সেটাই বোঝা যায় না। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের অনেকে জানে না বিএনপি কখন কী করতে যাচ্ছে। দলীয় সিদ্ধান্ত জানার জন্য টেলিভিশন বা পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতে হয়। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও যোগাযোগের উপায় প্রায় বন্ধ। তার আশপাশের কিছু লোকের কারণে দলের অনেক ত্যাগী নেতার মূল্যায়ন হয় না। যে কারণে এই নেতাদের অনেকেই রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন।’ বিএনপির এক নেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন দলে কোনো মূল্যায়নই পাচ্ছি না। এই যদি অবস্থা তাহলে রাজনীতি করি কীভাবে বলুন?’

বিএনপিপন্থি রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘বিরোধী দলে থাকলে যেকোনো দলকেই সাময়িকভাবে ছন্নছাড়া মনে হতে পারে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির এই অবস্থার জন্য তো সরকার দায়ী। সরকার একতরফাভাবে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্ষমতার জোরে বিরোধীদলকে জেলে পুরছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তো সবাই অসহায়। শাসক গোষ্ঠী তাদের যেভাবে পরিচালনা করছে তারা সেভাবেই চলছে।’ তিনি বলেন, ‘জীবনের মায়া তো সবার আছে। অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে তো কেউ রাজনীতির চিন্তা করবে না, জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করবে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে সেই ভয়ই করছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আরেক অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষমতাসীনদের যেমন সম্মান দেখানো উচিত তেমনি বিরোধী দলেরও উচিত সরকারের ভালো কাজে সহযোগিতা করা। ভালো-খারাপ সব কিছুতেই যদি সমানভাবে বিরোধিতা করা হয় তাহলে তো দেশ পরিচালনা করা যাবে না। যুক্তি, বিবেক ও বিবেচনার সমন্বয় ঘটাতে না পারলেও রাজনীতি করা সম্ভব, তবে মানুষের কল্যাণে কিছুই করা সম্ভব নয়।’

সরকার দলীয় নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘বিএনপি বারবার ষড়যন্ত্র করে পেছনের রাস্তা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে। সিটি নির্বাচনে তাদের ভোট বর্জন তারই অংশ। তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নির্বাচন থেকে হঠাৎ সরে দাঁড়িয়েছে। সরকার যদি ভোটে হস্তক্ষেপ করত তাহলে বিএনপির প্রার্থীরা কীভাবে তিন-চার লাখ ভোট পান? এসব করে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা যাবে না।’

শক্তি হারিয়েছে সংগঠন

বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি দিনদিন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। দলীয় কর্মসূচিতে তো দূরে থাক, বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশনাও মানছেন না নেতা-কর্মীরা। যার নজির মিলেছে সদ্য শেষ হওয়া সিটি নির্বাচনে। নির্বাচনী প্রচারণায় পরপর দুদিন খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে এবং আরেকদিন খালেদা জিয়ার নিজের গাড়িতেই হামলা হয়েছে। কিন্তু ওই অর্থে ওই ঘটনার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি দলটি। রহস্যজনক কারণে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ওপর এমন হামলার ঘটনায় নেতা-কর্মীরা প্রায় শান্তই থেকেছে। সিটি নির্বাচনে ভোটের দিন কেন্দ্র পাহারা ও ভোট গণনা শেষে তা বুঝে নিয়ে কেন্দ্র ছাড়ার কথা বলেছিলেন বিএনপিপ্রধান। অথচ ভোটের দিন সকাল থেকেই রাজধানীর শতকরা ৯০ ভাগ কেন্দ্রই ছিল বিএনপির এজেন্ট শূন্য। কোনো নেতা-কর্মীকেও ভোট কেন্দ্রের আশপাশে চোখে পড়েনি। বরং সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দখলেই ছিল ভোটের বুথ থেকে শুরু করে পুরো কেন্দ্র।

এক্ষেত্রে বিএনপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ সেই পুরনো। মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়। গ্রেপ্তার এড়াতে কেন্দ্রমুখী হননি নেতারা। তারা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কেন্দ্রে যেতে দেয়নি।

তবে রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, তিনবার ক্ষমতায় থাকা একটি দলের নেতা-কর্মীদের মুখে এসব অভিযোগ খুবই বেমানান। কারণ ভোট কেন্দ্র দখল এবং সরকারি দলের আচার-ব্যবহার তাদের কমবেশি জানা আছে। ক্ষমতায় থাকতে তারাও কম করেনি। রাজনীতি করতে এসে এভাবে গ্রেপ্তার ও মামলায় ভয় পাওয়া তো ‘ঘোড়াতেও চড়ার ইচ্ছা আবার হাঁটুও কাঁপছে’ এমন দশা।

বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান অবশ্য মনে করেন, ভোটের দিন বিএনপির নেতা-কর্মীরা যদি কেন্দ্রে গিয়ে গ্রেপ্তার বা হামলার শিকার হতো তাও বিএনপির জন্য ভালো ছিল। কিন্তু এভাবে প্রতিপক্ষকে ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দেওয়া সাংগঠনিক দুর্বলতার সত্যতাকে আরও জোরালো করেছে। তিনি বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে বিএনপি যে ভাগ্যবরণ করেছে তা নির্ঘাত সাংগঠনিক বিপর্যয়ের কারণে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে হতাশা বাসা বেঁধেছে তারই প্রতিফলন ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া। এ থেকে দলীয় নেতৃত্বের প্রতি তাদের আনুগত্যে ভাটার চিত্রও ফুটে উঠেছে। সেদিন যদি আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের হামলা দু-একজন বিএনপি নেতা-কর্মী হাতাহত হতো তাহলেও সরকার বেকায়দায় পড়তো। এভাবে ঘরে বসে থাকলে তো বিজয় আসবে না।’

তিন সিটি নির্বাচনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে খালেদা জিয়াসহ মাত্র তিন-চারজন নেতাকে সক্রিয় হতে দেখা যায়।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির ১১টি সহযোগী সংগঠনের মধ্যে আন্দোলন ও নির্বাচনে ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের কিছু তৎপরতা দেখা গেছে। যুবদল, শ্রমিক দল, কৃষক দল, ওলামা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, তাঁতীদল, মৎস্যজীবী দল ও জাসাসের উল্লেখ করার মতো তৎপরতা ছিল না। ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো দেওয়া হয়নি। সংগঠনের মহানগর কমিটিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি নেই। স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলের কমিটি গঠন নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে সিদ্ধান্তহীনতা চলছে।

বিএনপির সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের পর দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয় না। আন্দোলন-কর্মসূচি সবকিছু একাই ঠিক করছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এতে দুই-চারজন ছাড়া দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকে কিছুই জানেন না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে গত চার মাসে প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

দলীয় শীর্ষ নেতাদের অনেকে বলছেন সাংগঠনিক এই বিপর্যয় রুখতে ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। যোগ্যদের নেতৃত্বের সামনের সারিতে নিয়ে আসতে হবে। আন্দোলনের চেয়ে দল গোছানোর প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে। দল যদি সুসংগঠিত করে আন্দোলনের মাঠে নামা যায় তবেই আন্দোলনে সফলতা আসবে। তা না হলে অতীতের পুনরাবৃত্তি বৈ কিছুই হবে না।

‘হেরেও’ যেখানে ‘জয়’ দেখছে বিএনপি  

ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন সিটি নির্বাচন থেকে সরে আসলেও ভোট পেয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। সে হিসেবে তারা হেরেছেন। কিন্তু এর মধ্যেও জয় দেখছেন দলটির নেতারা। তারা বলেছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি তার প্রমাণ দিয়েছে। আওয়ামী লীগের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির ভাগ্যে সিটি নির্বাচনের মতোই কিছু ঘটতো। এক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তকেও সাধুবাদ জানিয়েছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। নির্বাচনে কারচুপির ইস্যুতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের নতুন করে আন্দোলনে যাওয়ার আভাসও মিলেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘সিটি নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনে তফাৎ কোথায়। সরকার এখন যা করেছে তখনও তা করতো। শুরুর দিকে আমিও নির্বাচনের পক্ষে ছিলাম কিন্তু শেষে যা দেখলাম তাতে বলতে দ্বিধা নেই যে, ম্যাডাম ইজ অলওয়েজ রাইট।’

বিএনপি নেতা জমির উদ্দিন সরকারের ভাষায়-‘হিস্ট্রি রিপিট্স ইট্স সেলফ।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাকশাল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এখন তার মেয়ে শেখ হাসিনাও তাই করেছেন। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে এর পরিণতি ভালো হয় না, এটাও ভুলে গেলে চলবে না।’

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তে জনসমর্থন বাড়বে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘জনসমর্থন তো আছেই। বিএনপির এমন কোনো নেতা-কর্মী নেই যাদের বিরুদ্ধে ছয়-সাতটি মামলা নেই। তারা ভয়ে বাড়িতে ঘুমাতে পারছে না। পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তাদের সামনে আসতে দেওয়া হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র বলতে কোনো শব্দ নেই, যা আছে স্বৈরতন্ত্র।’

ভোটে কারচুপি ও আধিপত্য বিস্তারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে বিএনপি আগামীতে আন্দোলনে যাবে কি না এমন প্রশ্ন ছিল বিএনপি নেতাদের কাছে। জবাবে তারা বললেন, আন্দোলন তো থেমে যায়নি। নির্বাচনে অংশ নেওয়া তো আন্দোলনের অংশ। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আন্দোলন তো চলছেই। সিটি নির্বাচনে যা ঘটলো নিঃসন্দেহে এটা ন্যক্কারজনক। এভাবে গণতন্ত্রকে ভুলুণ্ঠনের ইতিহাস অতীতের সব রেকর্ডকে হার মানিয়েছে।’

ইলিয়াস আলী, সালাহউদ্দিনের পরিণতি তাড়া করছে নেতা-কর্মীদের

বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর পর নিখোঁজ  সালাহউদ্দিন আহমেদের হদিস মিলছে না এখনো। গত ১০ মার্চ রাতে দলের যুগ্ম এই মহাসচিবকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে তাও জানা যাচ্ছে না। বিএনপি নেতাদের অনেকে ধরেই নিয়েছেন, ইলিয়াস আলীর মতো ভাগ্যই বরণ করেছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। এই দুটি ঘটনায় আতঙ্ক বেড়েছে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যেও। সিটি নির্বাচনের পর বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট নেতা-কর্মীদের মধ্যেও গ্রেপ্তার ও গুম আতঙ্ক ভর করেছে। যে কারণে তাদের অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

সালাহউদ্দিন আহমেদ ছাড়াও বর্তমানে ছাত্রদলের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা আনিসুর রহমান তালুকদার ও মেহেদী নিখোঁজ আছেন। এ অবস্থায় নির্বাচন উপলক্ষে যে কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে এসেছিলেন, তাদের অনেকেই আবারও আত্মগোপনে চলে গেছেন। বিশেষ করে মির্জা আব্বাসের জামিনের মামলার নি®পত্তি না হওয়ায় নেতাদের মধ্যে গ্রেপ্তারের ভীতি বেড়ে গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘বিএনপির এমন কোনো নেতা-কর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে না যার বিরুদ্ধে একটি মামলাও নেই। আওয়ামী লীগ বিএনপির ওপর যেভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে তা স্বৈরাচারী সরকারের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। যে দেশে রাজনীতিকদের নিরাপত্তা নেই, সে দেশে রাজনীতির ভবিষ্যৎ যে খুব ভালো নয় তা সহজেই অনুমেয়।’ সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।