logo ২৬ এপ্রিল ২০২৫
৫৭ নদী বিলীনের পথে
দিলওয়ার খান নেত্রকোনা থেকে
২৪ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:২০:২৮
image


নেত্রকোনার খরস্রোতা নদীগুলো অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে এখন প্রায় বিলীন হওয়ার পথে, যেন নদী আর নদী নেই। কালক্রমে এ নদীগুলো হারিয়েছে তাদের নাব্য, গতিপথ, স্রোত ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় খননের অভাবে নেত্রকোনার ছোট-বড় ৫৭টি নদীর এখন বেহাল অবস্থা। কোনো কোনো নদী আবার চলছে দখলের প্রতিযোগিতা। গড়ে ওঠেছে বসতি, জনপদ ও চলছে চাষাবাদ। এ ব্যাপারে  প্রশাসন কোনো প্রকার জোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় নেত্রকোনাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি নদী খনন ভেস্তে যেতে বসেছে।

কৃষিভিত্তিক নেত্রকোনা জেলার নদীগুলোর নাব্য ফিরিয়ে আনা হবে এবং এর ঐতিহ্য ধরে রাখা হবে ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আটপাড়া উপজেলায় কৃষকদের ভর্তুকির কার্ড বিতরণ অনুষ্ঠানে এমন বক্তব্য রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বলেন, জেলার নদীগুলোকে বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে খনন করা হবে এবং এর নাব্য ফিরিয়ে আনা হবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ৫ বছর অতিবাহিত হলেও কোনো নদীর এখনো খনন কাজ শুরু হয়নি।

এক সময় এসব নদীতে উত্তাল ঢেউয়ে নৌকা চলত। এখন এসব নদীর বুক জুড়ে মাটি কেটে ভরাট করে চলছে চাষাবাদ। কৃষিনির্ভর নেত্রকোনার হাওর-বাঁওড় আর নদ-নদী বিধৌত জেলার বিস্তৃত অংশ মূলত ভাটি এলাকা। বর্ষাকালে এসব এলাকায় নৌকা, ট্রলার, লঞ্চযোগে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল সহজতর। কিন্তু শুকনো মৌসুমে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ চলতে হয় পায়ে হেঁটে। নদীপ্রধান এ জেলায় রয়েছে ৫৭টি নদী ও ২৮টি খাল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মগড়া নদী। নেত্রকোনা জেলা শহরকে তিন দিক থেকে বেষ্টন করে আছে মগড়া। বর্তমানে জেলার পৌর শহরসহ মগড়া নদীর বিভিন্ন অংশে মাটি কেটে ভরাট করে চলছে চাষাবাদ, বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে নদী দখলের জোর প্রতিযোগিতা। জেলার পূর্বধলা, আটপাড়া, নেত্রকোনা সদর ও মদন উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা এ মগড়া নদী মেঘনায় মিশেছে। কালের খরস্রোতা ও কিংবদন্তির এ নদী আজ যেন স্রোতহারা অন্য এক নদী, ঐতিহ্যহীন ‘মগড়া’।

নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড আঁকাবাঁকা নদীর নাব্য ধরে রাখা এবং গতিপথ সোজা করার জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মগড়া নদীকে জেলা শহরতলির চল্লিশার অংশ থেকে শহরের দক্ষিণ দিক কুরপাড় দিয়ে কেটে লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের নদীর সঙ্গে একীভূত করার প্রকল্প হাতে নিলেও এলাকাবাসীর আপত্তির কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। এদিকে বছরের পর বছর নদীগুলোতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেলেও এর খনন কাজের জন্য স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

নেত্রকোনা পান্নি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খুশী মোহন সরকার বলেন, আমাদের কাছে নদী খননের কোনো বরাদ্দ আসেনি, তাই নদীগুলো খননের কাজ শুরু করতে পারিনি। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু হবে। তিনি আরো বলেন, নৌ চলাচলের জন্য কংস, বিশনাই এবং ধনু নদীর খনন অত্যন্ত জরুরি।

জেলার ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথের মধ্যে  উল্লেখযোগ্য নদীগুলো হচ্ছেÑকংস, সোমেশ্বরী, ধনু, ধলাই, সাইডোলী, নিতাই, উদাখালী, বিশনাইখালী, ধনাইখালী। নেত্রকোনার পাহাড়ি জনপদ দুর্গাপুরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সোমেশ্বরী নদী। মেঘালয়ের পাদদেশ থেকে নেমে আসা ঐতিহ্যবাহী সোমেশ্বরী নদীর বালির স্তর জমে ভরাট হয়ে গেছে। এখন তলায় শুধু ধু-ধু বালু। ফলে প্রতি বছরই অকাল বন্যায় প্ল-াবিত হয় বিস্তীর্ণ জনপদ।

লোকে বলে সোমেশ্বরী হচ্ছে এখন ‘পাহাড়ি জনপদের দুঃখ’। তাছাড়া প্রাচীনতম নদ কংসও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে বারহাট্টার ‘কানাই’ এবং কেন্দুয়ার ‘বেতাই নদী’। বৃহত্তম সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী ধনু নদীর বুকেও জেগে ওঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। ফলে প্রায় এসব চরে এখন মালবাহী কার্গো, ট্রলার, নৌকা আটকা পড়ে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে সাইডোলী, খালীহারী, গোড়াউত্রা, গোমাইসহ অসংখ্য নদী পরিণত হয়েছে এক একটি শীর্ণ খালে।

কৃষিনির্ভর নেত্রকোনা জেলার খাল-বিল আর নদ-নদীতে ভরপুর এলাকার যত্রতত্র অপরিকল্পিত স্লুইস গেট নির্মিত হওয়ায় অসময়ে নদীগুলো শুকিয়ে গিয়ে এর বুক চৌচির হয়ে যায়। কৃষি কাজ হয় চরমভাবে ব্যাহত। গত কয়েক বছর আগেও এই নদীগুলো ছিল উত্তাল। ফলে দেশের মিঠা পানির মৎস ভা-ার বলে খ্যাত এই জেলার সুখ্যাতি হারিয়ে যাচ্ছে। বেকার হয়ে পড়েছে নেত্রকোনার জেলে সম্প্রদায়ের এক বিশাল অংশ। যাদের একমাত্র জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল মাছ ধরা।

পরিবেশবিদদের মতে, নেত্রকোনার নদীগুলোকে অতি জরুরি ভিত্তিতে খনন করা প্রয়োজন এবং কৃষি কাজের উন্নয়নের জন্য নদী খনন করে নাব্য ফিরিয়ে আনা জেলার কৃষকসহ সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি। পাশাপশি নদী খনন করে যদি দুই পাশে বৃক্ষ রোপণ করা হয় তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে এবং খরা, অকাল বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুযেূাগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক ড. তরুণ কান্তি শিকদার জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রকল্প নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের সময় জরুরি ভিত্তিতে নদী খননের জন্য দাবি জানানো হয়।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।