logo ২৬ এপ্রিল ২০২৫
সিটি নির্বাচন: নিরপেক্ষতার প্রমাণ দেবে কি সরকার?
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২২ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০৫:২৮
image


দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু, সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পরই উপজেলা নির্বাচনেও হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনেছে বিএনপি। ভরাডুবি ঠেকাতে ভোট কারচুপির শক্ত অভিযোগ ওঠেছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। বিতর্ক থেকে রক্ষা মেলেনি নির্বাচন কমিশনের। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, এসব কারণেই দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ভয় বাড়ছে। নিজেদের হার ঠেকাতে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার ব্যবহার করবেন না-এমন সংস্কৃতি দেশের রাজনীতিতে গড়ে তোলা যায়নি। বরং দিনদিন অবিশ্বাসের পাহাড়ই বড় হচ্ছে। তবে ২৮ এপ্রিল হতে যাওয়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে পারে সরকার। আর শেষ বেলায় এসে নির্বাচন কমিশনও পক্ষপাতিত্বের তকমা তুলে ফেলতে পারে নিজেদের পেছন থেকে।

এখন পর্যন্ত নাগরিক এবং রাজনীতি-সচেতন মানুষের মন্তব্যে প্রার্থী পছন্দে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। মোটামুটি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ধরে রাখার চেষ্টার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সেই তুলনায় বিশ্লেষকরা পিছিয়ে রাখছে বিএনপিকে। শেষ মুহূর্তে প্রার্থী পছন্দে হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল দলটিতে। উত্তরের প্রার্থী সমর্থনে দারুণ বেকায়দায় ফেলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু। শেষতক তিনি ছিটকে পড়েন নির্বাচনী দৌড় থেকে। তবে বাবা মিন্টুর জায়গা নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছেন তাবিথ আউয়াল। ‘না পারতে’ তার ওপরই ভরসা করেছে বিএনপি। উত্তরের প্রার্থী নিয়ে যখন ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ দলটির শীর্ষ নেতারা, তখন এছাড়া উপায়ও ছিল না। তবে উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আনিসুল হকের বিপরীতে তাবিথ যে শক্ত কেউ নন, বিএনপি নেতারাও এমনটাই মনে করেন।  দক্ষিণেও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বিতর্কও কম নেই। নির্বাচনে লড়ছেন কিন্তু মাঠে নামতে পারছেন না মামলার বেড়াজালে। তার হয়ে স্ত্রী মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাঈদ খোকন নিজেই আছেন মাঠে। জয় আনতে আদাজল খেয়ে লেগেছেন তিনি।



তবে সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হামলা-মামলা উপেক্ষা করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোদমে। বিভিন্ন পথসভায়ও সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখছেন।  এছাড়া তিনি নিজে দ্বারে দ্বারে গিয়ে মানুষের কাছে ২০ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাইছেন এবং লিফলেট বিলি করছেন। পথসভাগুলোতে মানুষজনের ভীরও ছিল ব্যাপক।

চট্টগ্রাম নগরীর অব্যবস্থাপনা নিয়ে সাবেক মেয়র মনজুর আলমের বিরুদ্ধে আছে বিস্তর অভিযোগ। তার দায়িত্বকালে চট্টগ্রাম নগরীতে খুব একটা উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে বলা যাবে না। কিন্তু তারপরও বিএনপির সমর্থন তার প্রতিই। তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিনকে এগিয়ে রাখছেন কেউ কেউ।  



এই যখন অবস্থা তখন রাজনীতি-বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার চাইলে এই নির্বাচনের মাধ্যমে নিরপেক্ষতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারে। এতে বিএনপির আন্দোলনের অ্যাজেন্ডাও হালকা হয়ে আসবে। শুধু নিরপেক্ষ নয়, দলীয় সরকারের অধীনেও যে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব সেই উদাহরণও তুলে ধরতে পারবেন সরকারি দলের নেতারা। তাছাড়া বর্তমান নির্বাচন কমিশনেরও মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন তারা করেছেন। কিন্তু সুনামের চেয়ে তাদের দুর্নামই জুটেছে বেশি। এখন শেষ বেলায় এসে কমিশন নিজেদের ভালো কাজের স্বীকৃতি আদায় করতে পারে।

তবে বিএনপিপন্থি রাজনীতিবোদ্ধারা নির্বাচনে সরকারি দলের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা থেকে বের হতে পারছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিএনপি চেয়ারপারসনের পরামর্শক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে নিজেদের পরাজয় ঠেকাতে আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে তা তো গণমাধ্যমেই ওঠে এসেছে। তাদের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান তো চ্যালেঞ্জ। এজন্যই সিটি নির্বাচন নিয়ে আমরা বারবার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলে আসছি। নির্বাচন কমিশনকে দেখা করেও একই কথা বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন আজ্ঞাবহ সংস্থায় কাজ করলে সেটা তো ইলেকশন হবে না, সিলেকশন হবে। আমরা তো ইলেকশনের কথা বলছি।’



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তীর মতে, গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তার পছন্দের প্রতিনিধিকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয়। এটা যতটা স্বচ্ছ ও জবাবদিহি হবে ততই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে। তিনি বলেন, ‘বরাবরই সরকারি দল নাগরিকদের কাছে কম জনপ্রিয় হয়। তবে এর মধ্য থেকে যদি তারা নিজেদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিতে পারে তা নিঃসন্দেহে রাজনীতির মাঠে বারতি শক্তি জোগাবে।’

রাজনৈতিকবোদ্ধাদের পাল্টাপাল্টি মতামতের বিষয়টিকে আমলে নিয়ে রাজনীতিকরা বলছেন, নির্বাচনের শক্তি একটাই, জনগণ। জনগণ যাদের প্রতি সমর্থন দেবেন, তারা নির্বাচিত হবেন।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘সরকার যদি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করত তাহলে বিএনপি গত উপজেলা নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় জয়ী হতে পারত না। জিতলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে আর হেরে গেলে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে-এ ধরনের মানসিকতা যতদিন থাকবে ততদিন নির্বাচন যতই সুষ্ঠু হোক তার সমালোচনা হবেই।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা গাজীপুর, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল ও চট্টগ্রামে জয়ী হয়েছে। সরকার তো তাতে বাধা দেয়নি। এখন বিএনপির পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে বলে তারা ভয় পাচ্ছে। এই মাটি হচ্ছে জনগণের সমর্থন। ক্ষমতায় যেতে হলে আন্দোলন করে লাভ হবে না। জনগণ যেদিন চাইবে সেদিনই তারা ক্ষমতায় যাবে।’



তবে বিএনপি নেতাদের পাল্টা অভিযোগও আছে। দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘বিগত পাঁচ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নানাভাবে চেষ্টা করে বিজয়ী হতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে জনগণ সজাগ ছিল বলে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করে অনেক জায়গায় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে দেওয়া হয়নি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে এমনটি করা হলে সরকারের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পাবে।’



নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগের ইতিহাস নতুন নয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের আমলেও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সরকারি দলের হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠেছে। জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগও বেশ পুরনো। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো পরাস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি হয়নি। যে কারণে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতাই প্রকট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এক অর্থে মানুষ রাজনৈতিক জীব। রাজনীতির চক্রেই মানুষ আবর্তিত হয়। ক্ষমতার পালাবদল তারই অংশ। এই প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিকভাবে চালু থাকা উচিত। এখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ঠিক হবে না।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে