logo ২৭ এপ্রিল ২০২৫
ভোট এলেই ঢালাও প্রতিশ্রুতি
তালহা রহমান
০৮ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০৩:৫০
image

আবারো এলো নির্বাচন। ভোট হবে দুই শহরে কিন্তু তার প্রভাব পড়বে দেশের আনাচে-কানাচেও। রাজধানী এবং বাণিজ্যিক রাজধানী বলে পরিচিত চট্টগ্রামে নির্বাচন বলে কথা। কেবল দুটি শহরের প্রশাসক নির্বাচন নয়, নানা কারণে আলোচিত এই নির্বাচনটি ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতি-প্রকৃতিই পাল্টে দিতে পারে। শুরু থেকেই বেশ কয়েকটি প্রশ্ন বড় হয়ে আসে। প্রথমত জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি-জামায়াত জোট এই নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থন দেয় কি না, দ্বিতীয়ত সরকার দল এই নির্বাচনে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে কি না, তৃতীয়ত ঢাকায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় জমা নাগরিক সমস্যার সমাধান হয় কি না।


তফসিল ঘোষণার আগ থেকেই দেশবাসীর আলোচনায় ছিল এই নির্বাচন। ২৮ এপ্রিলের ভোটকে ঘিরে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে চারদিকেই। রাজধানীর হাজারো সমস্যার কয়টি সিটি করপোরেশনের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব, জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি এতে কতটা পাল্টাবে-সেসব প্রশ্নের সমাধান না থাকলেও বিরাট প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে নাগরিকদের মধ্যে।


পাহাড়সম নাগরিক প্রত্যাশা


রাজধানীকে ঢাকা উত্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ-এই দুই ভাগে ভাগ করার পর এই প্রথম নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ২০০২ সালের পর নগরবাসীর প্রথম প্রতিনিধি নির্বাচনের আগে রাজধানীর হাজারো সমস্যা আবারো সামনে এসেছে। সমাধান না হওয়া সমস্যার একটা গতি হবে-এমন আশা দেখছেন নাগরিকরা।


কেবল এবার নয়, প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তৈরি হয় এমন প্রত্যাশা। আর প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার আশায় বইয়ে দেয় প্রতিশ্রুতির বন্যা। ভোটাররাও সচরাচর বিবেচনা করেন না তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি আদৌ নির্ধারিত সময়ে প্রার্থী বা দলের পক্ষে রাখা সম্ভব কি না। ভোটের পর নির্বাচিত প্রার্থীর কাছে যাওয়া হয় না ভোটারদের। আর দেখা যায় কয়দিন পর থেকেই কথা না রাখার অভিযোগ ওঠে নির্বাচিতদের বিরুদ্ধে। এবারও ভোটের আগের অভিজ্ঞতার কথা তুলছেন নাগরিকরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জানা যায় ভোটারদের ক্ষোভের কথা।


মগবাজারের রিকশাচালক ইলাহি বক্স গাজী বলেন, ভোট দেওয়া কর্তব্য তাই দেই। তিনি বলেন, ‘নেতাগো কথা আর কামে মিল থাহে না। ভোটের আগে হাতে-পায়ে ধরে, পরে আর ছায়াও দেহা যায় না। তাগো মুহে এক কথা আর কাজে অন্য।’ তাহলে কেন ভোট দেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভোটার আইডি কার্ড যেহেতু করা হয়েছে সুতরাং ভোট তিনি দেবেনই।


এবার প্রার্থীদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী? প্রশ্ন করলে জবাব এলো ‘তাগো কথা ও কাজের মিল থাকলেই আমি খুশি।’ 


মালিবাগের এক চা দোকানদার বলেন, ‘আমরা ভোট দেই উন্নয়নের জন্য। কিন্তু যত আশা করি তত তো হয় না।’ তাহলে কেন ভোট দেন-এই প্রশ্নের জবাবে ঝরে পড়ল হতাশা। বললেন, ‘ভোট দিয়া কি লাভ, আমি আর ভোটই দিমু না। ভোটের আগে এক মাস ধইরা বাড়ি বাড়ি ঘুইরা ফেরেশতার মতো কথা বলে, অনেক প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু নির্বাচনের পর তাদের আর কোনো খোঁজ থাকে না।’


বাসাবো এলাকার অটোরিকশাচালক আলম বিশ্বাস বলেন, ‘টাকা দিয়া ভোট কেনাবেচা অয়। একেকজন ভোটের সময় লাখ লাখ টেকা খরচ করে। এই টেকা আয় কোত্থন।’ নিজের শহর বরিশালের ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, ‘রাতের আন্ধারে ভোট কেনা হয়। অনেক সময় হুমকি-ধামকি দেয়।’ প্রার্থীদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হয়া গেলে তারা আর চেনে না। নিজেগো টেকা-পয়সার দিকেই নজর থাহে বেশি।’ তিনি মনে করেন, জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের জন্য নির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার। ভালো হলে মানুষ এমনিই ভোট দেবে।


তাহলে কি নির্বাচিত হয়ে গেলে প্রার্থীরা কিছুই করেন না? মানতে নারাজ প্রবাসীকল্যাণ ভবনের সামনে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘অনেক কাজই হয়, তবে মানুষের প্রত্যাশা থাকে বেশি। পাঁচ বছরে কতটুকু করা সম্ভব, উন্নয়ন কাজের জটিলতা কী, তা মানুষ সেভাবে বুঝতে চায় না। এই যে দেখেন, ঢাকার আগে কী দশা ছিল! এখন তো তাও একটা পর্যায়ে আসার পথে আছে নগর। আগের থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রতিশ্রুতির একটি বড় অংশ বাস্তবায়ন হয় বলেই এই উন্নয়নগুলো হয়।’


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র ফাহমিদ খান বলেন, ‘গণতান্ত্রিক পন্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভোট দেই। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দেউলিয়া হয়ে গেছে, এটা তাদের দোষ, আমাদের নয়।’


ঢাকা সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, ‘আমি সেদিনই ভোট দেব যেদিন রাজনৈতিক নেতারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন।’


প্রত্যাশা আকাশচুম্বী, প্রার্থীরাও বাড়িয়ে চলেন


বস্তুতপক্ষে ভোটের সময় প্রার্থীরাও ভুলে যান তাদের ক্ষমতার সীমারেখা। দিয়ে যান নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি। ২০১০ সালে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলম। পাঁচ বছরে তার প্রধান প্রতিশ্রুতি জলাবদ্ধতা নিরসনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন মনজুর। আগের তিন দফায় এই সমস্যার সমাধান দিতে তার পূর্বসূরি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীও ব্যর্থ। ২০ বছরে যে সমস্যার সমাধান হয়নি, পাঁচ বছরেই তার সমাধানের অঙ্গীকার করেছেন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির। এবারও কি এটি শুধু প্রতিশ্রুতিই থেকে যাবে নাকি এর বাস্তবায়ন দেখতে পাবে চট্টগ্রামবাসী-এর জবাব দেবে সময়ই।


২০০৮ সালে খুলনা সিটি নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার আবদুল খালেক। পাঁচ বছরে তিনিও তার প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। নগরীর সড়ক উন্নয়ন হলেও নাগরিক আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিল ঘটেনি পুরোপুরি। ভোটের আগে খুলনার বন্ধ কল-কারখানাগুলো চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন খালেক। কিন্তু এই ক্ষমতা তার ছিল না। সরকারেরর উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া যে কাজ করা সম্ভব নয়, সেটি করার আশ্বাস দিয়ে রাখতে পারেননি খালেক।


২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে পূরণ না হওয়া অঙ্গীকারের জন্য জবাবদিহি করতে হয় তালুকদার আবদুল খালেককে। অপ্রত্যাশিতভাবে বড় ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। এই নির্বাচনে জয়ী বিএনপি নেতা মনিরুজ্জামান মনিও ভোটের আগে ২১ দফার ইশতেহার ঘোষণা করেন। কিন্তু এক বছরে তার কিছুই করা হয়নি। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, ধীর গতিতে রাস্তা ও নালা সংস্কারে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে নগরীতে। জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।


তালুকদার আবদুল খালেকের মতোই নিজের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে খালিশপুরে শিল্পাঞ্চল পুনরুজ্জীবনের পদক্ষেপ নেওয়া, শিল্প ও কল-কারখানা স্থাপনে সহযোগিতা দেওয়া, শিক্ষার উন্নয়ন, সুন্দরবন রক্ষায় ভূমিকা নেওয়া, শিশু ও প্রবীণ এবং প্রতিবন্ধীদের সহায়তায় পরিকল্পনা নেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মেয়র মনিরুজ্জামান মনি।


রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেও প্রতিশ্রুতির জোয়ারে নগরবাসীকে ভাসিয়েছিলেন তিন মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগ সমর্থিত এম খায়রুজ্জামান লিটন, বিএনপি সমর্থিত মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হাবিবুর রহমান। খায়রুজ্জামান লিটনের প্রতিশ্রুতির একটি ছিল বিসিক শিল্প নগরীকে আধুনিকায়ন করা, যেখানে ৩০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এছাড়া সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারে না থাকলেও রাজশাহী মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা এবং ওই অঞ্চলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অঙ্গীকার করেন লিটন।


মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের ২০ দফা ইশতেহারের মধ্যে ছিল রাজশাহীর স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, রাজশাহীতে একটি আইটি ভিলেজ গড়া, একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং খেলাধুলার মান বৃদ্ধিতে বিকেএসপির শাখা খোলা। কিন্তু এর কোনোটির কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি গত এক বছরে। আসলে এই বিষয়ে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নেওয়ার কোনো এখতিয়ারই নেই।


সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে বিজয়ী আরিফুল হক চৌধুরী দিয়েছিলেন ১১ দফা ইশতেহার। এর মধ্যে আছে সাইবার সিটি গড়ে তোলা, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট স্থাপন করা।


এবারও ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীরা নগরবাসীকে নানা প্রতিশ্রুতি দেবেন। কী কী বিষয়ে কাজ করতে হবে সে বিষয়ে কাজ চলছে। তবে ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগেই নারী নির্যাতন বন্ধসহ নানা প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন। এগুলোর সমাধান কি সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারে আছে কি না, তা যাচাইয়ের চেষ্টা করেননি তিনি।


এভাবে প্রতিশ্রুতি দিলেও স্বভাবতই তা পালন করতে পারেন না। বারবার দেখা গেছে প্রতিশ্রুতি পালন না হলে পরের নির্বাচনে যেমন সেই প্রার্থী হেরে যান, তেমনি রাজনৈতিক নেতা এবং তার দলও পরে সমস্যায়। রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতি রাখেন না এমন একটা কথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমাজে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, ‘ভোটের আগে বাড়িয়ে বলা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।’ এ জন্য ভোটারদেরও দায় আছে বলে মনে করেন তিনি। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো প্রার্থী যদি যানজট নিরসনের কথা না বলেন, তাহলে ভোটাররা ভাববেন এ বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই, আর এ কারণে হয়ত ভোট কম পাবে ওই প্রার্থী। তাই ক্ষমতা থাকুক আর না থাকুক প্রার্থীকে ভোটারদের মূল চাওয়া-পাওয়া নিয়ে নির্বাচনের আগে বলতেই হবে প্রার্থীদের।


বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান স্বীকার করেন, ভোটের আগে এভাবে বাড়িয়ে বলা উচিত নয় প্রার্থীদের। কিন্তু জনগণ সারা বছর তাদের সব সমস্যার কথা যেহেতু কারও কাছে বলার সুযোগ পায় না, তাই নির্বাচন এলেই এসব বিষয়ে প্রার্থীদের কাছে অঙ্গীকার চায়। আর প্রার্থীরাও বিষয়টি বুঝতে পেরে কাজ করার আশ্বাস দেয়। 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম অবশ্য মনে করেন, অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে ভোটাররা আর প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে ভাবেন না অতটা। স্থানীয় আর জাতীয় সব নির্বাচনেই এখন ইস্যু হয় জাতীয় বিষয়। কোন রাজনৈতিক দল থেকে প্রার্থী হয়েছেন তাদের বর্তমান কাণ্ডকীর্তিই বড় হয় ভোটারদের কাছে। 


সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে