ঢাকা: বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা করেন এমন মানুষ নিয়ে ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু হয় ‘শত নাগরিক কমিটি’ নামের অরাজনৈতিক সংগঠনটির। ধীরে ধীরে তা বিস্তৃতি লাভ করে। তবে এখন রাজনৈতিক প্রলেপ লেগে গেছে এর গায়ে।
বর্তমানে সংগঠনটির প্রায় সবাই একটি রাজনৈতিক জোটের অনুসারী। শুরুর কয়েক বছরে ধীরে ধীরে এর পরিচয় হয়ে ওঠে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীদের মোর্চা হিসেবে। আর রাজনৈতিক জোটের অনুকরণে বুদ্ধিজীবীদের এই মোর্চায় ভিড়ে যায় জামায়াতপন্থিরাও। তাই ‘বিএনপিপন্থি’ তকমার সঙ্গে আরও একটি শব্দ যোগ হয়ে এর পরিচিতি হয়ে ওঠেছে ‘বিএনপি-জামায়াতপন্থি বুদ্ধিজীবীদের’ সংগঠন হিসেবে।
তবে মাঝেমধ্যে আলোচনা সভা, সেমিনারে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে আসলেও সংগঠনটি খুব বেশি আলোচনায় ছিল না কখনও। তবে হঠাৎ করেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর আলোচনায় আসে এই শত নাগরিক কমিটি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে এসে কমিটির প্রধান এমাজউদ্দীন আহমদ জানান, সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব আছে খালেদা জিয়ার। এরপর বিএনপির নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে শত নাগরিক কমিটি।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে প্রায় তিন মাস ধরে হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস আন্দোলন এবং মামলার ভয়ে আত্মগোপনে আছেন বিএনপি-জামায়াত জোটের শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগ। কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় একেবারেই। বাকি কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে আছেন কারাগারে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া বলতে গেলে আলোচনা করতে পারছেন না কারও সঙ্গে। এই অবস্থায় বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আসছেন দল এবং জোটের অনুসারী বুদ্ধিজীবীরা।
যদিও নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিষয়টি আড়াল করতে চান এই বুদ্ধিজীবীরা। তাদের দাবি, দেশে নাগরিক সমাজের যতটুকু ভূমিকা পালন করা উচিত, আইনি বিধিনিষেধ ও বিবেকের তাড়না থেকে ততটুকুই করার চেষ্টা করছেন তারা। এর মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের প্রসঙ্গ না মেলানোর অনুরোধও করেছেন এই বুদ্ধিজীবীরা।
১৯৯৭ সালে শত নাগরিক কমিটির যাত্রা শুরুর সময় এর আহ্বায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ। আঠারো বছর পরও এই পদ ধরে রেখেছেন তিনি। সদস্য সচিব হিসেবে আছেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার।
পরিচালনা পর্ষদে আছেন সাবেক বিচারপতি আবদুর রউফ, সাবেক সচিব আসফ-উদ দৌলা, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ।
শুধু দেশেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে ‘শত নাগরিক কমিটির’ সদস্যরা কাজ করছেন বলে সংগঠন সূত্রে জানা গেছে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগীয় শহরে সংগঠনটির কমিটি আছে।
বিএনপির দাবি তুলে ধরছে শত নাগরিক কমিটি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে ছয়টি দাবি জানিয়েছে শত নাগরিক কমিটি। এর মধ্যে আছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় পিছিয়ে দেওয়া, বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের যারা কারাগারে আছেন তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা, সহিংসতা মামলার আসামিরা যেন নির্বিঘেœ প্রচার চালানোর সুযোগ পায়, সেসব দাবিও জানায় শত নাগরিক কমিটি।
তবে বিএনপির হয়ে কাজ করার বিষয়টি মানতে নারাজ শত নাগরিক কমিটির নেতারা। তারা বলছেন, বিএনপি নয়, সবার অংশগ্রহণে যাতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় সেজন্য পদক্ষেপ নিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অনুরোধ করেছেন তারা। এখন তা আমলে নেওয়া বা না নেওয়া কমিশনের ব্যাপার।
এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও একইভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেন শত নাগরিক কমিটির শীর্ষ ব্যক্তিরা। বিএনপি-জামায়াত জোটের নজিরবিহীন সহিংসতার মধ্যে বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে নানা সময় উদ্বেগ জানাতেন বুদ্ধিজীবীরা। তবে সহিংসতা থামাতে নয়, জোটের সঙ্গে সমঝোতা করতে সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়ে আসতেন তারা।
এসব কারণেই সরকার এই বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্যকে পাত্তা দিচ্ছে না। সরকার দল বলছে, বিএনপি-জামায়াতের আরেকটি মোর্চা তারা। নানা পেশায় প্রতিষ্ঠিতদের মুখ দিয়ে বিএনপি তার দাবি এবং বক্তব্য তুলে ধরছে এই সংগঠনের মাধ্যমে। তাই এদের বক্তব্য বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান হিসেবে ধরা যায় না।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি যে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে তার প্রমাণ শত নাগরিক কমিটিকে সামনে নিয়ে আসা। সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বিএনপি নেতারা এখন জনগণের সামনে এসে কথা বলার সাহস পচ্ছে না বলে এ ধরনের ফোরাম তৈরি করে কথা বলছে। কিন্তু এই চালাকি মানুষ বুঝবে না-এমন তো নয়।’
রাজনৈতিক বিশ্বাস আড়ালের চেষ্টা
বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের বক্তব্যের মতোই একই ধাঁচে কথা বলেন শত নাগরিক কমিটির নেতারা। তারপরও তারা নিজেদের দাবি করছেন সমাজের সত্যিকার দর্পণ হিসেবে। জানতে চাইলে সংগঠনের সদস্য সচিব আবদুল হাই শিকদার বলেন, ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা করেন এমন ব্যক্তিদের একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে চায় শত নাগরিক কমিটি। আইনের শাসন, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার পাশাপাশি দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’
রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য না থাকলে বিএনপি-জামায়াত বিশেষ জোটের অবস্থান এবং বক্তব্যের সঙ্গে শত নাগরিক কমিটির বক্তব্য কীভাবে মিলে যায়Ñজানতে চাইলে আবদুল হাই শিকদার বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমরা কথা বললে সেটা কারও পক্ষে গেলে তিনি খুশি হবেন আর বিপক্ষে গেলে নাখোশ হবেন, তা ঠিক নয়।’
আবদুল হাই শিকদার স্বীকার না করলেও বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতাল-অবরোধে পেট্রল বোমায় মানুষ হত্যা, যানবাহনে হামলা, ভাঙচুরের কোনো নিন্দা বা এ থেকে বেরিয়ে আসতে জোটের প্রতি কোনো আহ্বান কখনও জানাননি শত নাগরিক কমিটির নেতারা। আর এ নিয়ে কখনও গণমাধ্যমের চাপে কেউ কথা বললেও তারা সেই বিএনপি নেতাদের মতোই, কারা পেট্রল বোমা হামলা চালাচ্ছে সে নিয়ে সংশয়ের কথা বলেছেন।
লক্ষ পূরণে শত নাগরিক কমিটি কীভাবে কাজ করছেÑ জানতে চাইলে এর সদস্য সচিব বলেন, ‘আমরা আগেও সভা-সেমিনার করেছি, এখনও করছি।’ আবদুল হাই শিকদার যেটা বলেননি সেটা হলো, এই তাদের আলোচনা সভা-সেমিনারে বরাবর বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বুদ্ধিজীবীরা কথা বলবেন দেশ ও জাতির স্বার্থে। কিন্তু দলের হয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন না তারা। কেউ এমন করলে তারা আর বুদ্ধিজীবী থাকেন না, দলীয় কর্মীতে পরিণত হয়। শত নাগরিক কমিটির সাম্প্রতিক কর্মকা- নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরা বুদ্ধিজীবী পরিচয় দিলেও আসলে দলের লোক। তারা নিজেদের দলীয় পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা করলেও তা পারেননি।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু মুক্তি পরিষদের আহ্বায়ক হয়েছেন শত নাগরিক কমিটির প্রধান এমাজউদ্দীন আহমদ। খালেদা জিয়ার উপদেষ্টাদের একজনও তিনি। তারপরও যদি শত নাগরিক কমিটি তার রাজনৈতিক পরিচয় গোপন করতে চায়, তাহলে তাদের নিয়ে আমি আর কী বলব।’
যারা আছেন শত নাগরিক কমিটিতে
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বুদ্ধিজীবীদের এই মোর্চায় পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম এ মাজেদ, সরকারি কর্মকমিশন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান জিন্নাতুননেসা তাহমিনা খাতুন, চলচ্চিত্র পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সদরুল আমীন, তাজমেরী এস ইসলাম, তাহমিনা আখতার টফি, খলিলুর রহমান, আমিনুর রহমান মজুমদার, এম এ আজিজ, বোরহান উদ্দিন, এম এ রশিদ, ওবায়েদুল ইসলাম, আখতার হোসেন, মামুন আহমেদ, মনিরুদ্দিন আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল আলম, সৈয়দ কামরুল হাসান, আবদুল লতিফ মাসুম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মোবিন খান, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন সাইফুল ইসলাম, সাবেক উপ-উপাচার্য আবদুল মান্নান মিয়া, কোলরেক্টাল সার্জারি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুল হক, সার্জারি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এ এন এম আতা ই রাব্বী, আইইবির সাবেক সভাপতি আ ন হ আখতার হোসেন, ওয়াপদার সাবেক প্রধান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা, ঢাকা ডেন্টাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আশরাফ হোসেন, তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খাদিজা খাতুন, শেরেবংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোহাম্মদ ফারুক, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন বোরহান উদ্দিন আহমেদ, কৃষি অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক খন্দকার মো. ইব্রাহীম মিয়া, প্রকৌশলী মুয়িদ রনি, প্রকৌশলী ফজলুল এলাহী, অধ্যাপক সাব্বির আহমদ, আমজাদ হোসেন প্রমুখ।
এদের মধ্যে সবাই ব্যক্তিগত জীবনে বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত। পেশাজীবীদের মধ্যে নির্বাচনের সময় এদের কেউ কেউ বিএনপি-জামায়াতপন্থি জোটের হয়ে নির্বাচন করেছেন।
(ঢাকাটাইমস/ ৩০ মার্চ /এআর/বিএন/ ঘ.)