পুলিশ নিয়ে কথা হচ্ছিল বাহিনীটির সাবেক এক প্রধানের সঙ্গে। রাশভারী মানুষটি ঘুরেফিরেই পুলিশের শৌর্যবীর্যের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। অতীতে পুলিশের অর্জন, গৌরবের কথা বলে যাচ্ছিলেন সাবেক এই কর্তা। হঠাৎ যেন কী মনে করে চুপসে গেলেন তিনি। সোফার সামনে রাখা টি-টেবিল থেকে একটি জাতীয় দৈনিক তুলে নিয়ে তাতে ডুব দিলেন। খানিকবাদে পত্রিকা থেকে চোখ তুলে বললেন, ‘আসলে এমন সব লোকজন পুলিশে ঢুকেছে যাদের কারণে দেশের বড় এই বাহিনীটি দিনদিন প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছে। কী যে হবে বুঝে আসছে না।’
পরক্ষণে বোঝা গেল তিনি পুলিশ নিয়ে করা একটি খবর মন দিয়ে পড়ছিলেন। রাজধানীর মিরপুর থানা পুলিশের হেফাজতে ঝুট ব্যবসায়ী মাহাবুবুর রহমান ওরফে সুজন হত্যার অভিযোগে করা মামলায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেছে আদালত। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়। এই খবরটিই দৃষ্টি কেড়েছিল তার।
ঘটনাটি ছিল গত বছরের ১৩ জুলাই রাতের। হাজারীবাগ থানার পশ্চিম জাফরাবাদের বাসা থেকে মাহাবুবুর, তার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে মিরপুর থানায় নিয়ে যান উপপরিদর্শক জাহিদসহ একদল পুলিশ। পরিবারের অভিযোগ, ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে বাসায় এবং রাত প্রায় সোয়া ১২টা থেকে ভোররাত পর্যন্ত পুলিশ থানায় নিজেদের হেফাজতে রেখে মাহাবুবুরকে নির্যাতন করে। ভোরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যার অভিযোগে গত বছরের ২০ জুলাই তার স্ত্রী মমতাজ সুলতানা মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ১০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, মিরপুর মডেল থানার ওসি সালাউদ্দিন আহম্মেদ ও উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমানসহ অন্য আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পর¯পর যোগসাজশে মাহাবুবুর রহমানকে মারধর করে হত্যা করেন।
আদালত অভিযোগের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন। ঢাকা মহানগর হাকিম আশিকুর রহমান তদন্ত করে ওই ঘটনায় মিরপুর মডেল থানার ওসি সালাউদ্দিনসহ কয়েকজনের স¤পৃক্ততা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে এসআই জাহিদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদনে অভিযুক্ত বাকি চারজন হলেন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাজকুমার, কনস্টেবল আসাদ, রাশেদুল ও মিথুন।
কয়দিন আগে সারা দেশে পুলিশে ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলেছে। সেখানেও পাহাড়সম উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জোরেশোরে। পুলিশের উচ্চপদস্থ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকরা চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে সুযোগ বুঝে জনপ্রতি তিন থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নিয়েছেন। এসব নিয়ে কোথাও কোথাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের মধ্যে বাদানুবাদের চিত্রও সামনে এসেছে। মানুষজন ডেকে পুলিশের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। সংসদেও তোলা হয়েছে নিয়োগবাণিজ্যের ফিরিস্তি। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা বিভাগে নিয়োগবাণিজ্য বেশ রমরমা ছিল বলে অভিযোগ আছে।
শুধু তাই নয়, গত কয়েক মাসে পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্যিও বেশ রমরমা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন কর্মসূচিকে ঘিরে এই বাণিজ্য চাঙ্গা হয়েছে। আন্দোলনের নামে নাশকতা সৃষ্টিকারী সন্দেহে দোষীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। এই সুযোগে হয়রানি করছে নিরপরাধ ও নিরীহ মানুষদেরও। সন্দেহভাজন অজুহাতে গ্রেপ্তারের পর টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে নির্দোষদের। আবার টাকার অংশ ‘হ্যান্ডসাম’ হলে অপরাধীরাও গলিয়ে যাচ্ছেন লোহার শিক। সুযোগ আছে এমন কোনো জায়গাতেই ছাড় দিচ্ছে না পুলিশ।
দায়িত্বপালনে নিরীহ নাগরিকদের হয়রানি, বিনা ওয়ারেন্টে যে কাউকে আটক, সাদা পোশাকে ‘তুলে নিয়ে’ যাওয়া এবং পরে অস্বীকার, উৎকোচ পেলে পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত প্রতিবেদন, অপরাধীদের সঙ্গে আঁতাতসহ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। সবমিলিয়ে জননিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ এখন বেশ বেপরোয়া আচরণ করছে। এসব অভিযোগ মাথায় নিয়ে দিনদিন পুলিশ অপরাধীদের পাশাপাশি নিরীহদের কাছেও হয়ে উঠছে মূর্তমান আতঙ্কের ছায়াচিত্র।
কেন এমন লাগামহীন আচরণ করছে পুলিশ? অপরাধবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল হাকিম বলেন, ‘আসলে অপরাধপ্রবণতা যেকোনো মানুষের মধ্যেই থাকতে পারে। এটা যে কেউ হতে পারে। পুলিশই যে শুধু অপরাধপ্রবণ তা নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও তো এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা দেখা যায়। তবে যাদের গায়ে বিশেষ পোশাক জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অপরাধ দমনে তারা যদি অপরাধমূলক কা-ে জড়িয়ে পড়েন তাহলে ব্যাপারটা বেমানানই মনে হয়।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশে হয়ত গুটি কয়েক মানুষ আছেন যারা অসাধুবৃত্তির চর্চা করেন। তাই বলে গোটা বাহিনীকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না। খারাপ-ভালো মিলিয়েই তো মানুষ।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ এবং উৎকোচ শব্দ দুটি বেশ ঘনিষ্ঠ অনেক আগে থেকেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা এমনভাবে বাসা বেঁধেছে যে, পুলিশ মানেই ধরে নেওয়া হয়, তিনি উৎকোচ গ্রহণে সিদ্ধহস্ত। এর পেছনে বেশ কারণও আছে। যেখানেই পুলিশ সেখানেই আসে লেনদেনের প্রশ্ন। মাঠেঘাটে সবখানেই কমবেশি উৎকোচ দেওয়া ধরাবাঁধা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে পুলিশের ‘চাঁদাবাজি ওপেন সিক্রেট’। এমনকি ফুটপাতের দোকানপাট, সরকারি জায়গায় অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রায় জায়গাতেই পুলিশের জন্য বরাদ্দ থাকে। পুলিশের এক শ্রেণির অসাধু ও নৈতিকতাহীন কর্মকর্তা এসব নিয়ন্ত্রণ করেন বলে বিভিন্ন সময় সুনির্দিষ্ট অভিযোগও মেলে।
কনস্টেবল নিয়োগে পুলিশের ‘উদম’ বাণিজ্যের খবর গেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও। বেশ কয়েকটি জেলা থেকে লিখিত অভিযোগ উঠেছে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর টেবিলে। বিষয়টি এতটাই বেপরোয়া যে, সরকার ভাবছে পুলিশে নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও কীভাবে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা যায়। সেই ভাবনার কথাই প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল খানিকটা বললেন, ‘মুখে কিংবা লিখে অনেকেই অনেক অভিযোগ করেছেন কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে। এসব অভিযোগ তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছি। যে নিয়মে এখন নিয়োগ চলছে তা কীভাবে আরও স্বচ্ছ করা যায়, তা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে।’
অভিযোগ আছে, টাকা পেলে নিয়ম মেনে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ঝামেলা থাকে না। টাকার পরিমাণ যত বেশি চাকরি পাওয়া ততটা নিশ্চিতÑএমন কথাই চাউর আছে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, পুলিশে চাকরির কথা চিন্তা করার আগে উৎকোচের টাকা জোগাড়ের চিন্তা করতে হয় প্রার্থীদের। এসব নিয়ে লাজলজ্জার কিছু নেই। গুরুতর এই অনিয়মই পুলিশ বিভাগে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন ভুক্তভোগী অনেকে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এভাবে যদি চাকরির শুরুতেই অনিয়ম ও উৎকোচের সঙ্গে একজন পুলিশ সদস্যের পরিচয় হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে তার কাছ থেকে কী ধরনের নৈতিক আচরণ আশা করা যায়? লাখ লাখ টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়ার পর ওই ব্যক্তির চিন্তা থাকে কত তাড়াতাড়ি এই টাকা তুলে নেওয়া যায়। খুব সহজেই বোঝা যায় নিয়মিত বেতন-ভাতায় এই টাকা উঠতে বেশ সময় লাগে। যে কারণে বাঁকাপথে হাঁটার কথা চিন্তা আসে মাথায়। অনৈতিক পথে নিজের টাকা তুলতে গিয়ে জড়িয়ে যান অপরাধে। সেই থেকে শুরু দুর্নীতি ও অনিয়ম ধীরে ধীরে আরও শক্তভাবে লেপ্টে যায় ‘অসাধু’ কিছু পুলিশের গায়ে।
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র বলছে, টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়ার সুযোগে অনেক অপরাধীও ঢুকে পড়ার সুযোগ থাকছে পুলিশ বাহিনীতে। তাছাড়া জামায়াত-শিবিরপন্থিরাও কৌশলে ঢুকছে সরকারি এ বাহিনীতে। যা পরবর্তীতে যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রকে উস্কে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।
কনস্টেবল পদের বড় যোগ্যতা উৎকোচ
দেশের ৬৪ জেলায় আট হাজার ৫০০ পুরুষ ও এক হাজার ৫০০ নারীসহ ১০ হাজার ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়ার জন্য গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রথমে শারীরিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের একই দিনে ৪০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন করা হয়। এখন নিয়োগপত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কনস্টেবল পদে নিয়োগের জন্য পুরুষের উচ্চতা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং মহিলার ক্ষেত্রে উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। একজন প্রার্থী শারীরিকভাবে যোগ্য কি না তা পরীক্ষা করার জন্য মাঠের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়াতে হয়। দৌড়ে যারা টিকবে তাদের মাঝ থেকে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার কথা। জেলা পুলিশ সুপার নিজেই প্রশ্নপত্র তৈরি করে লিখিত পরীক্ষা নেবেন। এই পরীক্ষায় যারা পাস করবে তাদের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটিই পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
অথচ সম্প্রতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এসব যোগ্যতার চেয়ে বড় যোগ্যতা ছিল উৎকোচ। যারা এই যোগ্যতা উতরে গেছেন তাদের পরীক্ষারও উতরে গেছেন সহজে। আলাদাভাবে পরীক্ষা দিয়ে চাকরির নিয়োগপত্র পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তারা।
অভিযোগ আছে, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি হয়েছে থানা পর্যায় থেকে উচ্চপদস্থদের মধ্যেও। ধাপে ধাপে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়েছে পদস্থদের। নিজের প্রার্থীর পক্ষে সবুজ সংকেত পেতে কোথাও কোথাও জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অলিখিত সমঝোতার কথাও শোনা যাচ্ছে।
খোদ পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কনস্টেবল পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহীদের তিন থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ গুনতে হয়েছে। আবার অনেকে টাকা দিয়েও চাকরি পাননি। জেলা পুলিশ সুপারের নিজের তালিকার বাইরেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের তালিকাও জমা পড়েছিল নিয়োগ বোর্ডে। পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের দু-একটা অনুরোধও রাখতে হয়েছে কোথাও কোথাও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা জেলা থেকে নিয়োগপত্রের অপেক্ষায় থাকা এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, ‘অনেক ক্ষমতাও টাকার কাছে হার মেনেছে ভাই। টাকা দিয়েছি সব ঠা-া।’ টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়া তো অন্যায়, কেন এটা করেছেন? ‘কী করবো ভাই? দেশে চাকরির বাজারের যে খারাপ অবস্থা তা না হলে অনার্স পাস করে কনস্টেবলের চাকরি নিচ্ছি তাও আবার ঘুষ দিয়ে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তো পুরনো। আপনি চাইলেই এটা বন্ধ করতে পারবেন না। আমরা যদি নিজেরা সৎ হতাম তবেই এটা বন্ধ করা সম্ভব হতো। আপনি যখন টাকার ব্যাগ নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের পেছন পেছন ঘুরবেন তখন তো যেকেউ নমনীয় হতে পারে। তবে হ্যাঁ পুলিশের পোশাক গায়ে এভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়া তো মোটেও কাম্য নয়।
অভিযোগের স্তূপ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, অভিযোগ সংসদেও
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওসহ সাতটি জেলা থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতারা কনস্টেবল নিয়োগে বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এসব অভিযোগে নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ পুলিশের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছেন। গত ১৪ মার্চ রাজবাড়ী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী ও সংরক্ষিত আসনের এমপি কামরুন্নাহার চৌধুরী। তারা বলেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ীতে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে।
পুলিশের নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে জাতীয় সংসদেও। গত ১২ মার্চ রাতে ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংসদে পুলিশের নিয়োগ বাণিজ্য ও উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার নামে ঠাকুরগাঁওয়ে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করেছে কিছু সংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা। এতে জামায়াত-বিএনপির কর্মী-সমর্থকরাও চাকরি পেয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দবিরুল ইসলাম লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও অভিযোগ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, পুলিশ সুপার আবদুর রহিম শাহ চৌধুরী গানম্যান ও তার অনুগতদের দিয়ে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার নামে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করেছেন। কারো কারো কাছ থেকে সাত লাখ টাকা করে উৎকোচ আদায় করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, এই অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে তিন স্তরে এর তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে তদন্ত করেন রংপুর বিভাগীয় পুলিশের ডিআইজির বিশেষ টিম। এরপর পুলিশের হেড কোয়ার্টারে সাত সদস্যের একটি তদন্ত দল মাঠে নামে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ পুলিশ লাইনস মাঠে কনস্টেবল পদে জনবল নিয়োগের জন্য প্রাথমিক বাছাই শুরু হয়। এরপর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। চিকিৎসকের পরীক্ষার পর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। এতে ১১০ জন পুরুষ ও ১৭ জন নারীকে চূড়ান্তভাবে মনোনীত করা হয়। অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়েছে দুই নারীসহ ১০ জনকে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য আবদুল হাই ঝিনাইদহের এসপি আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের গোলাম মোস্তফা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের আবদুল ওদুদ বিশ্বাস স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে গত ৮ মার্চ লিখিত অভিযোগ করেন। তাতে বলা হয়েছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার ছয়-সাত লাখ টাকা করে নিয়ে জামায়াত ও বিএনপির লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন। ফলে দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে।
তবে পুলিশ সদর দপ্তর এসব অভিযোগ নিচ্ছে অনেকটা হালকাভাবেই। সদর দপ্তর সূত্র বলছে, যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার সব ঠিক নয়। কোনো কোনো এলাকায় জনপ্রতিনিধিরা তালিকা দিয়েছেন। তাদের তালিকাভুক্তরা শারীরিক যোগ্যতাসম্পন্ন না হওয়ায় বাদ পড়েছেন। এ কারণে তারা ঢালাও অভিযোগ করেছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাকরি দেওয়ার কথা বলে জনপ্রতিনিধিরা প্রার্থীদের থেকে টাকা নিয়েছেনÑএমন খবর রয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত চাকরি না হওয়ায় এখন ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ আনা হচ্ছে।
নিয়োগবিধি পরিবর্তনের চিন্তা
পুলিশে কনস্টেবল নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ বেশ পুরনো। পুলিশে নিয়োগ এলেই নির্ধারিতভাবেই উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ উঠে আসে সামনে। এতে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তির পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাই সরকার ভাবছে এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে আরও কীভাবে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক করা যায়। সূত্র জানায়, তিনটি ধাপে পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেন জেলা পুলিশ সুপার। সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগ দেয় পুলিশ সদর দপ্তর। আর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নিয়োগ দেওয়া হয় বিসিএসের মাধ্যমে।
প্রতিটি জেলায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের জন্য পাঁচজনের একটি কমিটি করা হয়ে থাকে। কমিটির প্রধান থাকেন জেলার পুলিশ সুপার। অন্যদের মধ্যে থাকেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপার। এ ছাড়া সিভিল সার্জন মনোনীত একজন চিকিৎসক ও পুলিশ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক মেডিকেল টিমে অন্তর্ভুক্ত থাকেন। তবে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে থাকেন পুলিশ সুপারই।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ বোর্ডে শুধু পুলিশ কর্মকর্তারা থাকায় নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব থেকে যাচ্ছে। নিয়োগ বোর্ডে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি রাখা হলে হয়ত এত অভিযোগ আসত না। আর অভিযোগ এলেও সত্যটা সহজেই জানা যেত। এ অবস্থায় বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর সরকার নিয়োগ বিধিমালায় পরিবর্তন আনার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে।
চলছেই গ্রেপ্তার বাণিজ্য
রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে পুলিশ নাশকতার অভিযোগ এনে দেদার আটকের সুযোগ পায়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই আটক বা গ্রেপ্তার বাণিজ্যের ফাঁদ পেতে বসে পুলিশ। গত কয়েক মাস ধরে এই ফাঁদকে পুঁজি করেই রমরমা গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এই নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারের পরও অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং ‘বেপরোয়া’ পুলিশ চালিয়ে যাচ্ছে বাণিজ্য। এই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
অনুসন্ধানে পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্যের নানাচিত্র উঠে এসেছে। গত ১৭ মার্চ ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির মতবিনিময় সভায় উপজেলার পাগলা থানা পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। বক্তারা বলেন, নবগঠিত পাগলা থানার প্রত্যন্ত এলাকায় পুলিশ গ্রামের নিরীহ সাধারণ মানুষকে মিথ্যা অভিযোগে আটক করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে।
কুড়িগ্রামের রৌমারী থানা পুলিশ রফিকুল ইসলাম সাজু নামের এক সাংবাদিকের কার্যালয়ে ঢুকে তার শরীরে মদ ঢেলে তাকে গ্রেপ্তার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারের পর ওই সাংবাদিকের দুই হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে প্রকাশ্যে বাজারে ঘুরানো হয় এবং একই সঙ্গে নির্যাতন চালানো হয় বলে অভিযোগ করা হয়।
রৌমারী থানা পুলিশের বিরুদ্ধে নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার বাণিজ্য এবং মাদক-জুয়ায় চাঁদাবাজির একাধিক সংবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ ওই নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দেয় বলে জানা গেছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১১টার দিকে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায় এ ঘটনাটি ঘটে।
রাত গভীর হলেই ব্যস্ত হয়ে উঠে ঢাকা মেট্রোপলিটনের পল্লবী থানা। নিস্তব্ধ নীরব থানায় ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। পুলিশের অভিযানে আটককৃতদের রাখা হয় থানাহাজতে। ভোরের আলো ফোটার আগেই চৌরাস্তার মোড়ে বাড়তে থাকে আটককৃতদের স্বজনদের ভিড়। পল্লবী থানা পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, থানা এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে।
আইন অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই তাদের আদালতে হাজির করার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চমকে ওঠার মতোই তথ্য পাওয়া গেছে আটককৃতদের স্বজন ও তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে।
আটককৃতদের মধ্যে রয়েছেন শহীদুল ইসলাম ও রাজু আহমেদ নামে দুই ব্যক্তি। ভোরে শহীদুলকে নাস্তা দিতে দেড় বছরের শিশুসন্তানসহ থানায় যান তার স্ত্রী জুলি ও বৃদ্ধা মা। জুলি জানান, শনিবার রাত ১০টায় বাসা থেকে আটক করা হয় শহীদুল ইসলামকে। সঙ্গে তার বন্ধু রাজু আহমেদকেও আটক করে পুলিশ। ১৪ মার্চ রাতে আটক করলেও তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছে ১৬ মার্চ দুপুরে। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৬০ ঘণ্টা।
জুলি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। টাকা-স্বর্ণ সব নিয়ে গেছে পুলিশ। এখন একটা মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।’ পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাসেলের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয় বলে জানান তিনি।
যেখানে বাদ সাধছে পুলিশ
২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন প্রণীত হয়েছিল। অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং আইন ও মানবাধিকার-সংশ্লিষ্ট অনেকেই আইনটির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সেধেছে পুলিশ বিভাগ।
সূত্র জানায়, ২০টি ধারাসংবলিত এই আইনের ১৪টি ধারা ও উপধারায় সংশোধনী চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশোধনী প্রস্তাবগুলো খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য গত ১৬ মার্চ একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করেছে।
পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই আইনের ফলে আইন প্রয়োগকারী সব সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা তাদের দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। একই সঙ্গে দাবি করা হয়েছে, এই আইনের অনেক ধারা প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
এ ছাড়া পুলিশ সদর দপ্তরের প্রস্তাবে অন্তরীণ আদেশ বাতিল ও এসব অপরাধকে ‘অ-আপসযোগ্য ও জামিন-অযোগ্য’ বিবেচনা করার বিরোধিতা করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি কমানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে।