logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
শুধুই আওয়ামী লীগ!
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
০৯ মার্চ, ২০১৫ ১২:০৩:২২
image


শীত কেটেছে। হাওয়া বইছে বসন্তের। গাছের ঝরা পাতায় ঢেকে যাচ্ছে চলার পথ। গায়ে এসে পড়ছে দুপুরের মিষ্টি রোদ। আবার হঠাৎ দমকা হাওয়ার আয়েশ লাগছে গায়ে। রাজধানীর রমনা পার্কে প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে এসেও এসবে খেয়াল নেই কারো। বিকেলে হাঁটার পর পার্কের বেঞ্চিতে বসে সরকারের সাবেক দুই কর্মকর্তা আলাপ জুড়ে দিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে। খানিকবাদে আরও দুজন যোগ দিলেন তাদের সঙ্গে।

‘বুঝলেন ভাই সাহেব, ঢাকায় এখন নির্বাচনী হাওয়া বইছে।’ জুলফিকার আহমেদের কথা শুনে মাইনুল ইসলাম নামের একজন প্রৌঢ় আঙুল উঁচিয়ে একটি বড় বিলবোর্ড দেখিয়ে বলেন, ‘দেখুন না দু-একজন সংসদ সদস্যও নেমে পড়েছেন মেয়র হওয়ার দৌড়ে। ক্ষমতার লড়াইয়ে বেশ দম আছে তাদের।’

: তাও ভালো। নির্বাচনটা হওয়া দরকার। অনেকদিন তো হলো।

হুম, ঠিক বলেছেন। কিন্তু আবার কোনো ঝামেলায় আটকে যায়...

: না, বোধহয় এবার আটকাবে না। তাছাড়া মনে হচ্ছে লড়াইটা জমবে আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগেই। বিএনপি এখনো তো ঝেড়ে কাশল না। তবে পত্রপত্রিকায় যতটুকু পড়েছি, বোধহয় নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার অপেক্ষায় আছে তারা।

কর্মজীবন শেষে অবসরে যাওয়া এসব মানুষের কৌতূহলই প্রমাণ দিচ্ছে ডিসিসি নির্বাচন এখন নগরবাসীর আগ্রহের কেন্দ্রে। চায়ের দোকান থেকে বিলাসী বসার ঘরেও এখন কে মেয়র হচ্ছেন সে আলোচনা।

বৃহস্পতিবার অফিস শেষে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ ছিল গণপরিবহনে। রাস্তাতেও ছিল যানজট। রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে রীতিমতো হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়েছে। বাসের জানালার ফাঁক গলিয়ে এক মোটরসাইকেল আরোহী এক যাত্রীকে প্রশ্ন করলেন-‘ভাই কী হয়েছে?’

: আর কী, ঢাকার মেয়র কে হবে এই নিয়ে তর্কবিতর্ক। যে যার পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। তফসিলের খবর নেই, এখনই শুরু হয়ে গেছে দৌড়ঝাঁপ। আসলে নির্বাচন মানেই তো আমাদের কাছে উৎসব। এই ছোঁয়াই লেগেছে সবার মনে।

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০০২ সালের এপ্রিলে। এরপর টানা প্রায় ১০ বছর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। আওয়ামী লীগ সরকার গত মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরও প্রায় তিন বছর ঢাকার নগর পিতা ছিলেন খোকা। পরে ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হয়। এরপর তফসিলও ঘোষণা হয়। কিন্তু সীমানা ও ভোটার তালিকা সংক্রান্ত জটিলতা কাটিয়ে আজও সম্ভব হয়নি ডিসিসি নির্বাচনের আয়োজন করা।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরো অনেক আগেই ডিসিসি নির্বাচন করা দরকার ছিল। ঢাকার মতো একটি রাজধানী শহর দীর্ঘদিন এভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া পরিচালিত হওয়ায় নগরীর অনেক উন্নয়ন থমকে আছে।  

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তারপরও কোনো অগ্রগতি হয়নি। পরে এ বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ডিসিসি নির্বাচন দ্রুত শেষ করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। এর পরই নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টরা।

নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা না হলেও সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীরা আদাজল খেয়েই নেমেছেন মাঠে। যে যার জায়গা থেকে চালিয়ে যাচ্ছেন জনসংযোগ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে দলের সমর্থন দিয়েছে ডিসিসি উত্তর ও দক্ষিণের দুই প্রার্থীকে। উত্তরে আওয়ামী লীগের সমর্থন মিলেছে ব্যবসায়ী আনিসুল হকের ভাগ্যে। দক্ষিণে সমর্থন গেছে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ খোকনের ঘরে। এখানেই শেষ নয়। আওয়ামী লীগ দল সমর্থিত দুই প্রার্থী ঠিক করে দিলেও বিএনপি এখনো নীরব সিটি নির্বাচন নিয়ে। তাহলে কি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পাবেন এই দুই প্রার্থী? নির্বাচনের মাঠের হাওয়া বলছে উল্টো কথা। লড়াই করেই জিততে হবে নগরপিতাকে।

তবে এখন পর্যন্ত যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে লড়াইটাও হবে শুধুই আওয়ামী লীগে! উত্তরে প্রার্থী হওয়ার চিন্তা করছেন সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার। অনেকটা সন্তর্পণে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন তিনি। এখন প্রকাশ্যেই বিলবোর্ড সেঁটে জানান দিচ্ছেন তিনিও মেয়র হতে চান।

ওদিকে দক্ষিণে মাঠ ফাঁকা পাননি প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফপুত্র সাঈদ খোকনও। তবে বেশ শক্ত প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। এই প্রতিপক্ষ যদি হন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম, তাহলে তো লড়াইটা কঠিন হওয়ারই কথা।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কার্যত ‘একতরফা’ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে ১১ হাজার ৯৯৫ ভোটে হারিয়ে হাতি মার্কায় জয় আনেন হাজী সেলিম। যে কারণে তাকে দুর্বল প্রতিপক্ষ ভাবার সুযোগ নেই বলেই মনে করেন ডিসিসি দক্ষিণবাসী।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী সমর্থন চূড়ান্ত করলেও এখনো ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি বিএনপি। তারা বলছে, তাদের সর্বপ্রথম দাবি জাতীয় নির্বাচন। তারা এখন ওই নির্বাচনের দিকেই তাকিয়ে আছেন। ডিসিসি নিয়ে আপাতত কিছু ভাবছেন না তারা। তবে ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে না গেলেও পরবর্তীতে গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঠিকই দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। সেই হিসেবে শেষ পর্যন্ত ডিসিসি নির্বাচনেও তাদের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিএনপি হয়ত আন্দোলনের কৌশলের অংশ হিসেবেই এখনো ডিসিসি নিয়ে কিছু বলছে না। দলটি তফসিল ঘোষণার পরই হয়ত দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি চিন্তা করবে।

পারবেন তো সাঈদ খোকন?

২০০৭ সালে এক-এগারোর জরুরি অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পাল্টে গিয়েছিলেন সাঈদ খোকনও। আওয়ামী লীগ ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টিতে (পিডিপি)। পিডিপির ঢাকা মহানগর কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এই সাংগঠনিক সম্পাদক। তার সঙ্গে দলের বেশ কিছু নেতা-কর্মীও যোগ দিয়েছিলেন পিডিপিতে। এরপর সাঈদ খোকন বছরখানেক সক্রিয় ছিলেন দলটিতে। পরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাঈদ খোকনের বিষয়টি নগর আওয়ামী লীগে আবার আলোচনায় আসে। ওই সময় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন নগর কমিটির নেতারা। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক চিঠিতে নগর কমিটিকে সাঈদ খোকনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আলোচনা স্থগিত রাখতে বলেছিলেন। চিঠিতে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদ খোকনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এরপর গত কয়েক বছরে খোকনের বিষয়ে আর কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, সাঈদ খোকন যে আওয়ামী লীগের বড় কোনো নেতা হয়ে উঠেছেন তা নয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে মানববর্ম রচনা করা ছাড়াও নানা কারণে প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাবোধ রয়েছে। এ কারণে তিনি হানিফপুত্র খোকনের বিষয়টিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেন। ফলে খোকনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি।

তবে দল ত্যাগ করার পর কোনো ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশ না করেই পুনরায় দলে তার নিজের জায়গা ফিরে পাওয়ার চেষ্টাকে সহজভাবে নেয়নি নগর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী। পাশাপাশি সাঈদ খোকনের দলীয় আনুগত্য নিয়েও প্রশ্ন আছে তাদের মধ্যে। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি যে আবারও বিতর্কিত কিছু করে বসবেন না, এই নিশ্চয়তাও কে দেবে?  

দলীয় আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, দলের গঠনতন্ত্রের ৫৫ ধারায় বলা আছে, ‘আওয়ামী লীগের কোনো সদস্য অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হইতে পারিবেন না কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সহিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমতি ছাড়া কোনোরূপ রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখিতে পারিবেন না।’ পিডিপিতে যোগদান করে এ ধারাটির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেন খোকন। ৪৬(ক) ধারায় আছে, ‘কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলী বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থি কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করিলে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল, কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় বোর্ড বা সংসদীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ তাঁহার বিরুদ্ধে যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’

পিডিপিতে যোগ দিয়ে সাঈদ খোকন আওয়ামী লীগ ও এর সভাপতি শেখ হাসিনা সম্পর্কে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন, যা সে সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেননি বা ক্ষমা চাননি খোকন।

তবে এসব অভিযোগ মানতে রাজি নন সাঈদ খোকন। তিনি বলেন, ‘আমি পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। দলের সভানেত্রীসহ সিনিয়র সব নেতাই জানতেন। তারা ঘটনার আগের-পরের বিষয়ও জানেন। তাদের কাছে আমি আগে যেমন ছিলাম এখনো তেমন আছি।’

ডিসিসি দক্ষিণবাসীর মধ্যেও সাঈদ খোকনকে নিয়ে নানা মুখোরোচক আলোচনাও আছে। অনেকে রাজনীতির ‘ফুলবাবু’ বলেও সম্বোধন করেন। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, ‘খোকন সাহেব থাকেন বনানীর সাহেবপাড়ায়। মন চাইলে এলাকায় আসেন, না চাইলে আসেন না। তবে এখন নির্বাচনী মৌসুমে ঘন ঘন এলাকায় আসছেন। কিন্তু মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর দেখা যাবে ডিসিসি দক্ষিণের মানুষকে ছুটতে হবে উত্তরে। কারণ খোকন সাহেবের বাসা সেখানেই।’ লালবাগের এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যখন শতাধিক মানুষ মারা গিয়েছিল তখন সাঈদ খোকনের চেহারাও আমরা দেখিনি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাঈদ খোকন বলেন, ‘আমার পৈতৃক বাসা কিন্তু দক্ষিণে। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার মা বনানীর বাসায় থাকেন। মায়ের বুক বলে তো একটা কথা আছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই এলাকায় থাকি। মায়ের সঙ্গে থাকার জন্যই রাতে এখানে আসি। জনগণের যেমন দাবি আছে তেমনি মায়েরও তো দাবি আছে। এই ছাড়টুকু আমি জনগণের কাছে পাব বলে বিশ্বাস করি।’

এর আগেও ২০১২ সালে ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দক্ষিণের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই নির্বাচন আর হয়নি।

শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হাজী সেলিম

দক্ষিণের আরেক মেয়র প্রার্থী হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মুখে কিছুটা সমালোচনা থাকলেও পুরান ঢাকাবাসীর কাছে বেশ জনপ্রিয় তিনি। স্থানীয় ও দলীয় সূত্র জানায়, সুখে-দুঃখে সব সময় ঢাকাবাসীর পাশে থাকেন হাজী সেলিম। সেবার জন্য মানুষকে এসে তার দুয়ারে ধরণা দিতে হয় না। বরং রাতদুপুরে বিপদে-আপদে ছুটে যান মানুষের কাছে। তাছাড়া ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও একজন তিনি। এই শিল্পপতির ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোও ডিসিসি দক্ষিণ এলাকার মধ্যে।

ঢাকারবাসীর অনুরোধে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাতিতে চড়ে জাতীয় সংসদে গিয়েছিলেন। এবারও ঢাকাবাসীর অনুরোধে ডিসিসি নির্বাচনেও অংশ নিতে যাচ্ছেন তিনি।

জানতে চাইলে হাজী মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘পুরান ঢাকাবাসীর দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে ডিসিসি দক্ষিণ নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নেব। ঢাকার ঐতিহ্যকে অক্ষুণœ রাখতে মানুষ আমাকে মেয়র হিসেবে দেখতে চায়। আমি নির্বাচিত হতে পারলে মানুষের চাওয়ার শতভাগ মূল্যায়নের জন্য চেষ্টা করব।’

দলীয় সূত্র জানায়, বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একাধিক মামলা হয় হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। এরপর তিনি আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রকাশ্যে আসেন হাজী সেলিম। শত বিপদেও দল থেকে সরে যাননি। বরং সব সময়ই দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়েই পথ চলেছেন। তাছাড়া হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মূল ঘাঁটি লালবাগ মাদ্রাসা। বিগত সময়ে ওই এলাকায় হেফাজতের কর্মকা-কে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে সুকৌশলে মোকাবেলা করেছেন হাজী সেলিমের নেতৃত্বেই। যেকোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নিমতলী ট্র্যাজেডির সময়ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে ছিলেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবেও দায়িত্বও পালন করেছেন ঢাকা সমিতির সভাপতি হাজী সেলিম।

এই দুই প্রার্থীর বাইরে নির্বাচনের লড়াইয়ে শোনা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনির নাম। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিসিসি দক্ষিণ নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকাকালে টিভি টক শো থেকে শুরু করে পত্রিকায় লেখা কলামে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করে বেশ বেকায়দায় পড়েছিলেন রনি। সাংবাদিক পেটানোর মামলায় কারাগারেও থাকতে হয়েছে তাকে।  

উত্তরে আনিসুল হক, ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর চেষ্টা

সরাসরি রাজনীতিতে কখনই সরব হতে দেখা যায়নি আনিসুল হককে। ব্যবসায়ী হিসেবেই বেশ সুনাম আছে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এই সভাপতির। টিভি উপস্থাপক হিসেবেও একসময় পরিচিতি পেয়েছিলেন আনিসুল হক। হঠাৎ আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে তার সমর্থন পাওয়া রীতিমতো ‘সারপ্রাইজিং’ বলেই মন্তব্য দলের নেতাকর্মীদের।

দলীয় সূত্র জানায়, ব্যবসায়ী হিসেবে আনিসুল হকের ভালো ভাবমূর্তি থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে নির্বাচনের মাঠে সফল হতে হলে রাজনৈতিক কৌশলও কম গুরুত্বের নয়। নির্বাচনী এলাকার মানুষের মধ্যে তিনি কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন অর্জন করতে পারেন তার প্রমাণ মিলবে ভোটের মাঠেই। তবে নির্বাচনে জয়ী হতে হলে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ছুটতে হবে তাকে।

আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ সুবিধা পেয়েছেন তিনি। টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদনও জুটেছে। এখন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচনও করছেন।

সন্তর্পণে প্রচারণায় কামাল মজুমদার

দল থেকে সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ঢাকা-১৫ আসনের সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার। কিন্তু পাননি। তাই বলে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে যাবেন না তিনি। তার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানায়, দলের সমর্থনকে খুব বেশি বড় করে দেখছেন না কামাল মজুমদার। মেয়র নির্বাচন তার অনেক দিনের স্বপ্ন। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। নগরীর মহাখালী এলাকায় পোস্টার সাঁটা হয়েছে কামাল মজুমদারের পক্ষে। ঝুলেছে বড় বিলবোর্ডও। তবে ঢাকা উত্তরবাসীর মধ্যে কামাল মজুমদার কতটুকু জনপ্রিয় সেই প্রশ্নও উঠছে জোরেশোরে।

দলীয় সূত্র জানায়, কামাল মজুমদারকে মেয়র নির্বাচন করতে হলে সংসদ সদস্য পদ ছাড়তে হবে। তিনি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নেবেন। কারণ ডিসিসি নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলে দুই কূলই হারাবেন তিনি।   

তফসিল নিয়ে দ্বিধায় ইসি

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর নগরজুড়ে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করলেও এখনো তফসিল ঘোষণার কূল-কিনারা করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তফসিল নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে তারা। ইসি চাইলে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন একই দিনে করার জন্য। তবে এর মধ্যে শুরু হবে এইচএসসি পরীক্ষা। সেক্ষেত্রে নির্বাচনীর তারিখ ঠিক করা নিয়েও আছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব।

কমিশন সূত্র জানায়, এখন চলছে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের সম্ভাব্য প্যানেল তৈরির কাজ। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ৫৫ হাজার এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ১৫ হাজারেরও বেশি প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং, পোলিং ও সহকারী পোলিং কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। মধ্য জুনের মধ্যে রোজার আগে এইচএসসি পরীক্ষার ফাঁকে এ তিন সিটি করপোরেশনে ভোট করার পরিকল্পনা ইতিমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন।

আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার দুই ভাগে ৪৩ লাখ ভোটারের বিপরীতে এবার ২ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্র হবে। ১০ শতাংশ অতিরিক্ত নিয়ে প্রায় ৬০ হাজার কর্মকর্তার প্যানেল প্রস্তুত রাখা হবে।

ইতিমধ্যে হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও সরেজমিন পরিদর্শন করে সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্রের তালিকা প্রস্তুতের জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ইসির এ কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে ঢাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, ‘প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং, পোলিং ও সহকারী পোলিং কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুতের নির্দেশনা বুধবার পেয়েছি। পরে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায় তাদের লোকবলের তালিকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’  

ঢাকা উত্তরে ২৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৩২ ভোটার ও দক্ষিণে ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৯৫৯ জন ভোটার রয়েছে। ৪২ লাখ ৮৯ হাজার ৩৮৩ ভোটারের বিপরীতে এবার অন্তত ২ হাজার ১০০’র মতো ভোটকেন্দ্রের প্রয়োজন হবে। কমিশন সূত্র জানায়, প্রায় ৫৫ হাজার ভোটকক্ষের জন্য সমপরিমাণ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার দরকার হবে। প্যানেলে অন্তত ৬০ হাজারের মতো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা রাখা হবে।

মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, ১৬ মার্চের মধ্যে প্যানেল তৈরির কাজ শেষ হবে। যথাসময়ে ভোটকেন্দ্রও চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে। যাতে করে ভোটের নির্দেশনা এলে কোনো অসুবিধা না হয়।

তফসিলের অপেক্ষায় বিএনপি?

বিএনপি ডিসিসি নির্বাচনের তফসিলের অপেক্ষায় আছে? তারা এখনো নগর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে খোলাসা করে কিছু বলেনি। তবে দলীয় সূত্রে জানা যায়, তফসিল ঘোষণার পর ডিসিসি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে কথা বলবে বিএনপি। জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘বিএনপি তাকিয়ে আছে জাতীয় নির্বাচনের দিকে। এই দাবিতে আন্দোলন চলছে। এই মুহূর্তে ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? তাছাড়া সরকার তো বুঝেশুনেই এই নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে। মনে করছে বিএনপি আন্দোলনে ব্যস্ত থাকার ফাঁকে তারা সাজানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় নিজেদের লোক বসাবে। কিন্তু এসব করে বিএনপিকে আন্দোলন থেকে সরানো যাবে না।’

তবে এখন পর্যন্ত যারাই ডিসিসি নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা সবাই চান বিএনপিসহ অন্যান্য দলও নির্দিষ্ট প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নিক।

এর আগেও ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছিল

প্রশাসক থাকা অবস্থায় ২০১২ সালের ২৯ এপ্রিল ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এতে ২৪ মে নির্বাচনের দিন ঠিক করা হয়। কিন্তু ভোটার তালিকা ও সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত জটিলতা থাকায় নির্বাচনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। এরপর ২০১৩ সালের ১৩ মে আদালত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। আবার ওই বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দেয় কমিশন। কিন্তু ঢাকার সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন ঢাকা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় আবারো দেখা দেয় জটিলতা। এরপর নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ডিসিসি নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো উদ্যোগ নেই। সম্প্রতি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচির মধ্যে ডিসিসি নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আরো ৪৫ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। অবশ্য সরকারের চলতি বাজেটে নির্বাচন পরিচালনার জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে।

২০১২ সালে ডিসিসিতে মোট ভোটার ছিল ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৯২৬ জন। দু ভাগে ৯২টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ঢাকা উত্তরে ১২টি, দক্ষিণে ১৯টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড রয়েছে। সম্ভাব্য মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ৯৫৭টি ও ভোটকক্ষ ১০ হাজার ২৫৬টি।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।