২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর দুই দলের বাইরে বিকল্প শক্তি গড়া আর পরিবর্তনের ডাক দিয়ে দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘প্রকৃত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি’তে দেশ চালানো আর দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর ঘোষণা দেওয়া ইউনূসের রাজনীতি আর করা হয়নি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর।
ইউনূসকে সে সময় যারা ‘অগণতান্ত্রিক’ শাসনের সময় ‘গণতান্ত্রিক’ দল গঠনে প্ররোচনা আর সাহায্য- সহযোগিতা করেছিলেন তারাই আবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার আসার পর তুলে নেন সেই সমর্থন।
আর রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে তিনি পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে আফসোস করে বলেছিলেন, তাকে গাছে তুলে দিয়ে মই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কারা তাকে সে সময় গাছে তুলেছিল সেটা অবশ্য বলেননি ইউনূস।
জরুরি অবস্থা জারি চলাকালে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ থাকায় কেবল ইউনূস নয়, দল গঠন করেছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম, সাবেক বিএনপি নেতা ফেরদৌস আহমেদ কোরেশিও। জরুরি অবস্থা চলাকালে দুই দলকে নানা সমালোচনা করে আলোচনায় থাকা এই তিন ‘রাজনীতিবিদ’ পরে আর আলোচনায় থাকতে পারেননি। পরিবর্তনের ডাক দিয়ে রাজনীতিতে নামা সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম তার দল নিয়ে যোগ দিয়েছেন বিএনপি-জামায়াত জোটে। আর ফেরদৌস আহমেদ কোরেশির প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টি-পিডিপির কোনো নড়াচড়াই নেই।
মুক্তিযুদ্ধের পর যখনই গণতান্ত্রিক শাসন বিঘিœত হয়েছে বা দেশে সংকট তৈরি হয়েছে তখনই রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে এমন মানুষ স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি বা করার সম্ভাবনা নেই। তবে এ রকম সব চেষ্টাই যে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় থাকাকালে সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান গঠন করেন জাগদল। পরে আরও কয়েকটি দল মিলে প্রতিষ্ঠিত হয় বিএনপি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সেনা ছাউনিতে জন্ম নেওয়া দলটি অবশ্য জনপ্রিয় হয় এবং জনগণের ভোটে ক্ষমতায়ও আসে ।
বিএনপিকে উৎখাত করে জিয়াউর রহমানের পথ ধরেই ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ৯ বছর ক্ষমতায় থাকলেও গণআন্দোলনে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর জাতীয় পার্টি অবশ্য সেভাবে সুবিধা করে উঠতে পারেনি রাজনীতিতে।
এর মধ্যে জন্ম হয়েছে আরও অনেক দলের।
সব কয়টি দলই প্রতিষ্ঠার সময় প্রকৃত গণতন্ত্র, জনগণের শাসন, আইনের শাসন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে প্রকাশ্যে কিন্তু আড়ালে-আবডালে অগণতান্ত্রিক শক্তির সাহায্য-সহযোগিতা, আর্থিক লেনদেন করেছে। এসব কথিত জনগণের দলের নেতৃত্বে চাকরিতে থাকা বা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন দলছুট গুরুত্ব হারানো রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এমনকি সাংবাদিক, নাগরিক বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বা অন্য কোনো পেশাজীবীও। যার কোনো কোনোটি শুরুর দিকে আলোচনায় থাকলেও পরে হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
এরপরও চেষ্টা থেমে যায়নি নতুন দলের জাল বোনার। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে পাশ কাটিয়ে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে চেষ্টা হয়েছে নতুন কিছু করার। যারা প্রকাশ্যে নিজেদের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের চেয়ে আলাদা বলে দাবি করতেন। গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।
মধ্যরাতে টিভি টক শো থেকে শুরু করে, সভা-সেমিনার, সেম্পোজিয়াম, পত্রিকার পাতায় লেখা কলামে গণতন্ত্রের বুলি দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন হরহামেশাই। গণতন্ত্রের বাইরে গিয়ে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার পাঁয়তারাও করেছেন সময়ে সময়ে। তাদের মুখে কড়া সমালোচনাও শোনা গেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নানা কাজের।
গণতন্ত্র হুমকির মুখে দাঁড়িয়েÑএমন আতঙ্কের বাণীও দিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। ‘সুশীল সমাজ’ হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে এই গোষ্ঠীর। কিন্তু সম্প্রতি নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও সাবেক ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা ও অজ্ঞাত একজনের ফোনালাপ সুশীল সমাজকে দাঁড় করিয়েছে জনতার কাঠগড়ায়।
প্রশ্ন ওঠেছে, আসলেই কি তারা বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে আলাদা? নাকি তাদের চেয়েও ভয়ংকর তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল? তা না হলে ‘লাশের’ বিনিময়ে ও সেনা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা কীভাবে করলেন তারা?
ইন্টারনেট অ্যাপ্লিকেশন ভাইবারের ওই ফোনালাপে মান্নাকে বলতে শোনা গেছে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সংঘাতের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলের কথা বলতে।
এটা করতে গিয়ে যদি দুই-তিনটি লাশ পড়ে তাতেও কিছু করার নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া অজ্ঞাত অপর একজনের সঙ্গে ফোনালাপে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখিয়েছেন মান্না। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তার চাওয়া অনুযায়ী সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দিয়ে ফোন করানোর আশ্বাসও দেওয়া হয়।
রাজনীতি-বিশ্লেষকরা বলছেন, মুখে মুখে দুই দলের বিরোধিতা করলেও আদতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কেউ কেউ কোনো একটি নির্দিষ্ট দলের হয়ে কাজ করেছেন। ওই দলের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও দেখছেন। মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপেই ওঠে এসেছে যে, প্রয়োজনে সংঘাতের ও লাশের রাজনীতি থেকেও পিছপা হবেন না তারা। এছাড়া সেনাবাহিনীকে নানাভাবে উসকানি দিয়ে দেশকে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতেও প্রস্তুত আছে সুশীল সমাজ। এটা নিঃসন্দেহে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ। তবে আগেভাগে ষড়যন্ত্রের আলামত প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সহজ হবে।
মান্নার ফোনালাপ প্রকাশের পর সুশীল সমাজের নাগরিকদের মধ্যেও বিভক্তি ফুটে উঠেছে। কয়দিন আগেও যারা এক টেবিলে বসে গণতন্ত্র ও দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন, পটপরিবর্তনে তারাও মান্নাকে নিজেদের লোক বলে স্বীকার করতে জোর আপত্তি দেখিয়েছেন। চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপের জন্য উদ্যোগ নেওয়া নাগরিক সমাজের সঙ্গে মান্নার কোনো ধরনের সম্পর্ক বা সংশ্লিষ্টতা নেই এমন কথাও বলেছেন সংগঠকরা।
নাগরিক সমাজ মঞ্চ মান্নার ফোনালাপের পুরো দায়ভার তার ওপরই চাপাচ্ছেন। এসবের সঙ্গে তাদের কোনো যোগসাজশ নেই এবং মান্নার ফোনালাপের কারণে সংলাপ অনুষ্ঠানে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও মন্তব্য করেন তারা। পাশাপাশি সংলাপের জন্য দুই দলকে এক টেবিলে বসাতে তাদের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে এমনটাও জানিয়েছেন সুশীল সমাজের একাংশ।
তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় নাগরিক সমাজের ঐক্যের উদ্যোক্তাদের একজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতা ঠেকাতে নাগরিক সমাজ যে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তার সঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্নার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি যে কথা টেলিফোনে বলেছেন এটা তার কথা। এর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তার ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা আমাদের কাজ করে যাব।’
মান্নার ফোনালাপ নিয়ে কথা বলতে বিব্রতবোধ করেছেন তার রাজনৈতিক সহকর্মীরাও। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তো বলেই বসলেন, ‘মান্নার নাম নিয়ে কিছু বলতে আমি বিব্রতবোধ করি। তার সাম্প্রতিক কর্মকা- ও টেলিফোন আলাপে জাতি বিস্মিত হয়েছে। দেশ ও জাতি তার কাছে এটা প্রত্যাশা করে না।’ পাশাপাশি এক হাত নিয়েছেন টিভি টক শোর আলোচকদের। বলেন, ‘যারা টক শোতে গিয়ে এত নীতি কথা বলেন, বাস্তবে তারা কী, মাহমুদুর রহমান মান্না নিজেই সেটা প্রকাশ করে দিয়েছেন।’
ফোনালাপ ফাঁসের পর মান্না নিজেও অকপটে স্বীকার করেছেন সব। তবে তার দাবি, তার কথা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি যেভাবে কথাগুলো বলেছেন সেভাবে গণমাধ্যমে আসেনি। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এই সময়কে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কত লোকের সঙ্গেই আমার কথা হয়। খোকা (সাদেক হোসেন খোকা) ভাইয়ের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এই সময়কে তিনি বলেন, ‘খোকা ভাই বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার চেষ্টা করলে তো সংঘাত হবে। মানুষ মারা যাবে। তখন কথার কথা বলেছি, এখন যদি কেউ মারা যায় তাহলে আপনার কী করার আছে। তার মানে তো এই নয় যে, আমি লাশ চেয়েছি।’
‘অজ্ঞাত’ ব্যক্তির সঙ্গে সেনা হস্তক্ষেপ নিয়ে ফোনালাপের বিষয়ে জানতে চাইলে মান্না বলেন, ‘সে বলেছে, কাদের কাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবে। আমি বলেছি, ঠিক আছে কেউ কথা বললে বলব। এর বেশি কিছু নয়। তাই বলে আমি সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছি এটা কেমন কথা?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদও বললেন এটা মেনে নেওয়ার মতো নয়। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মান্না আমার ছাত্র ছিল। কিন্তু তাই বলে তার এই কথা আমি মেনে নিতে পারি না। একজন শিক্ষক হয়ে কোনো ছাত্রের মৃত্যু কামনা করতে পারি না। লাশের বিনিময়ে ক্ষমতায় যাওয়া যায় না। সংঘাত নতুন সংঘাতের জন্ম দেয়। তাছাড়া সেনা হস্তক্ষেপের যে কথা সে বলেছে তাও মেনে নেওয়ার মতো নয়। স্বাধীন-সার্বভৌম একটি গণতান্ত্রিক দেশে কেন রাজনৈতিক বিষয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থন চাইব? তা হলে গণতন্ত্রের চর্চা হবে কী করে?’
মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সুশীল সমাজ
ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার আগেও দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা করতে দেখা গেছে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। এ মাসের প্রথম দিকে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে চলমান রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে নাগরিক সমাজের ঐক্য ও কার্যক্রম নিয়ে প্রথম উদ্যোগ নেন মান্না। এরপর নাগরিক সমাজের একাংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংঘাতের পথ থেকে সরে আসতে শান্তি-সংলাপের উদ্দেশ্যে চিঠি দেয়। এই চিঠি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকেও দেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে নাগরিক সমাজের এই উদ্যোগ একটি সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদাকে আহ্বায়ক করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়। তবে একটি দলের কাছে অগ্রহণযোগ্য ও সমালোচিত থাকায় ড. কামাল হোসেন এবং মাহমুদুর রহমান মান্নাকে এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়। যদিও তারা দুজন নাগরিক সমাজের এই প্রক্রিয়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। এখন ফোনালাপ ফাঁসের পর সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, ‘মান্না সাহেব যা করেছেন তার দায় তো তারই। এই দায় গোটা নাগরিক সমাজ কেন নিতে যাবে? তাছাড়া আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছি দুই দলের মধ্যে একটা শান্তিপূর্ণ সংলাপের। দ্রুত ফল আশা করলে হবে না। সময় দেওয়া লাগবে।’
নাগরিক সমাজের ঐক্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘একটা মানুষ রাজপথে, টক শোতে সক্রিয় ছিলেন। আমাদের ঐক্য প্রক্রিয়ায় সামনের কাতারে ছিলেন। কিন্তু তার ফোনালাপ সব কিছু ভেস্তে করে দিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, সম্প্রতি সরকারপ্রধান ডিসিসি নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলার পর মান্নাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন নির্বাচন হলেও বিএনপি অংশ নেবে না। এ কারণে মান্না দাঁড়ালে সরকারসমর্থিত প্রার্থীরা হুমকির মুখে পড়বে।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার উপায়ও গণতান্ত্রিক হতে হবে। লাশ ফেলে কিংবা সেনাবাহিনীকে উস্কে দিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনা মোটেও ঠিক নয়। যারা লাশের ওপর দিয়ে হেঁটে ক্ষমতায় যেতে চান, দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের কি কোনো ধরনের চিন্তা আছে? তারা যদি মানুষের কল্যাণ চাইতেন তবে এমন ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাততে পারতেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘সরকারকে যে কেউ রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। কিন্তু মান্না যেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলে আন্দোলন সফল করার কথা বলেছেন, তা ন্যক্কারজনক। তার এই অধঃপতন আমাকে ব্যথিত করেছে। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তার চরিত্র প্রকাশ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা নবজাগরণের মাধ্যমে এখানে সুশীল সমাজের উদ্ভব এবং এই সমাজ এখন অনেক বিস্তৃত। কিন্তু বর্তমানে সুশীল সমাজের নামে কেউ কেউ অরাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় এনে দেশকে বিরাজনীতিকরণ করতে চান, যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য চরম ক্ষতিকর।’
আওয়ামী লীগে নিন্দিত, বিএনপিতে নন্দিত
বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে ফোনালাপ ফাঁসের পর বেকায়দায় পড়া মান্নার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতারাও আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলেছেন মান্নার পক্ষেই। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান মান্না কী বলেছেন তা তো আমি শুনিনি তবে পত্রপত্রিকায় পড়েছি। সেনাবাহিনী কি মান্নার কথায় চলে আসবে? অনেকেই তো অনেক কথা বলেন। এসব তো কথার কথা।’
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, মান্না এখন বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, ‘মান্নাদের মতো লোকজনদের কাছে দেশের মানুষ নিরাপদ নয়। যারা মানুষ হত্যা করতে চায় তারা কীভাবে দেশ ও মানুষের কল্যাণ করবে। আসলে ভালো মানুষের আড়ালে সবাই নিজের স্বার্থটাকে ভালো বোঝেন।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমে যতটুকু জেনেছি তাতে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটি দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র। দেশে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য একটি পক্ষ কাজ করছে। যারা করছে তারা জঙ্গিবাদেও লিপ্ত।’
মান্নার মতো লোক কীভাবে সুশীল সমাজের লোক হয় প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এই নেতা বলেন, ‘সুশীল সমাজ বলতে আমরা বুঝি দেশের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকসহ দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের। যারা কোনো দল না করে, দেশের হয়ে কথা বলবেন। কিন্তু যারা এ ধরনের রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে থেকে তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলেন, তারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হতে পারেন না।’
তিনি বলেন, ‘সংলাপের ব্যাপারে নাগরিক ঐক্যের লোকজন কয়দিন আগে চিঠি দিয়েছেন। আসলে তারা সংলাপ চান না, সন্ত্রাস চান। বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত মান্নার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
ফোনালাপ ফাঁসের পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৩টার দিকে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মান্নাকে। তারপর প্রায় ২০ ঘণ্টা তার কোনো খোঁজ না মিললেও ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে র্যাব মান্নাকে গুলশান থানায় তুলে দেয়। সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাকে। পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাকে আদালতে তুলে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে তা মঞ্জুর করে আদালত। -সাপ্তাহিক এই সময়- এর সৌজন্যে।