logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
কোনও আলো নেই বলে ঘুমাতেছি ...।
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ১৬:৪০:০৪
image


‘মানুষ মেরেছি আমি, তার রক্তে আমার শরীর

ভরে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার

ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু

হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর

কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে

বধ করে ঘুমাতেছিÑতাহার অপরিসর বুকের ভিতরে

মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী

সকলকে আলো দেবে মনে করে অগ্রসর হয়ে

তবুও কোথাও কোনও আলো নেই বলে ঘুমাতেছি ...।’

জীবনানন্দের সেই বিপন্ন বিস্ময় এখন ভর করেছে মুক্তচিন্তার মানুষের মনে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক নির্মল সেন লিখেছিলেন ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। আজ কয়েক যুগ পরে এসেও এ কথাই কণ্ঠ দুয়ারে কড়া নাড়ছে। কেউ কি আছেন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দেবেন? এটা নিষ্ফল আবেদন। একটা স্বাধীন ভূখ-ে মানুষের ‘মানুষ’ পরিচয়টি এখন নির্বাসিত। মানুষের মূল্যায়ন হচ্ছে চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাস দিয়ে। আস্তিক-নাস্তিকের কঠিন দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে সমাজের মাঝে। উগ্রবাদীদের হামলায় একের পর এক খুন হচ্ছেন মুক্তচেতনার মানুষ। তাদের শরীর থেকে ঝরা রক্ত জমাট বাঁধছে রাজপথে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের চিন্তাগুলো এখনও ছড়ানো-ছিটানো।  গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে বেরোনোর পথে কি লেখক অভিজিৎ রায় ভেবেছিলেন এভাবে রক্তাক্ত হতে হবে স্বজাতির অস্ত্রের আঘাতে? স্ত্রী রাফিদা আহমেদও একটিবার ভেবেছিলেন স্বামীর রক্তাক্ত নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়বে আর মানুষ দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? কখনো কি ভেবেছিলেন অন্ধ আর বধির মানুষের কাছে রাফিদার আর্তচিৎকার পৌঁছবে না? গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া স্থির ছবিতেও যেন শোনা যাচ্ছে রক্তাক্ত রাফিদার আর্তচিৎকার। সবাই আছে, আবার কোথাও কেউ নেই।

প্রায় এক দশক আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একইভাবে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। ওই ঘটনাস্থলের প্রায় ১০ গজের মধ্যেই ঘটলো অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনা। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দার।  ২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার গোপীবাগে নিজ বাসায় আধ্যাত্মিক নেতা লুৎফর রহমানসহ ছয়জন খুন হন দুর্বৃত্তদের হাতে। একই বছরের ৮ আগস্ট ঈদুল ফিতরের আগের দিন সন্ধ্যায় খুলনার পূর্ব নগরীর খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের নর্থ জোনের একটি বাড়িতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক (ডিডি) তৈয়েবুর রহমান ও তার ছেলেকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ওই ব্যক্তি তৈয়ব ‘হিজবুল্লাহ’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গত বছরের ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর পূর্ব রাজারবাগে একই কায়দায় খুন হন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকী। সবকয়টি খুন হয়েছে একই কায়দায়। পুলিশ বলছে, আঘাতগুলো এমনভাবে করা হয়েছে যে, টার্গেট করা ব্যক্তির পক্ষে আর বাঁচার উপায় থাকে না, আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন।

উগ্রবাদী হামলায় মৃত্যুর ঘটনা একের পর এক ঘটলেও কোনোটিরই বিচার শেষ অবধি গড়ায়নি। খুনিরাও থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিজিৎ রায় হত্যার ছক কষা হচ্ছিল বছরখানেক আগে থেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে নানাভাবে। দীর্ঘদিন ধরেই অভিজিতের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল খুনিচক্র। শফিউর রহমান ফারাবী নামের এক ব্যক্তি প্রকাশ্যেই অভিজিতের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছিলেন। এই ফারাবী ব্লগার রাজিবের জানাজা পড়ানো ইমামকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এজন্য মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়েও গেছেন ফারাবী। তারপর থেকে ফেসবুক, ব্লগে ক্রমাগত মুক্তচিন্তা ও গবেষণামুখী মানুষকে হত্যার হুমকি দিয়ে বেরাচ্ছে ফারাবীচক্র। দেশে তো তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ দমনের জন্য আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ কোথায়? সরকারের এত এত নজরদারি ব্যবস্থা কোথায়? দেশের একজন নাগরিককে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়ার পরও কেন খুনিচক্রকে আগেভাগে নজরদারিতে আনা যায়নি? কেন খুনের পর খুনিরা বুক ফুলিয়ে পালিয়ে গেল? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কেউ কি আছেন?

আমরা মুখে মুখেই বলি বাক-স্বাধীনতা ও নাগরিকের নিরাপত্তার কথা। আসলে নিরাপত্তা কোথায়? মুক্ত মত প্রকাশের সব পথ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আর যাই হোক চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার কথা প্রায়ই বলেন এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে বসে থাকা ব্যক্তিরা। কিন্তু ভেতর ভেতরে আমরা যে এত সাম্প্রদায়িকতার জালে জড়িয়ে গেছি সেই খবর কি রেখেছেন কেউ? যদি জেনেই থাকেন তাহলে কেন এত পিছিয়ে থাকা? জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে, জঙ্গিবাদ দমনে দেশ এগিয়ে গেছে এমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে আর কতকাল? ওদিকে যে সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদীদের ভয়াল থাবা গোটা জাতির ওপর ভর করেছে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার পথও খুঁজে বের করতে হবে। কাজটা সহজ নয়। তবুও দেশকে এগিয়ে নিতে আর বসে থাকা চলবে না। এ দায় রাষ্ট্রযন্ত্রের। নাগরিকের নিরাপত্তা সংরক্ষিত আছে সংবিধানে। আর এই সংবিধান বুকে আঁকড়ে যারা ক্ষমতায় আছে, নাগরিক নিরাপত্তা তো তাদেরই দিতে হবে। তা না হলে অভিজিৎ, রাজিব, ফারুকীদের আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে না।