টানা দুই বছর ধরে আবাসন খাতে চলছে মন্দাভাব। মালিকরা বিক্রি করতে পারছেন না ফ্ল্যাট। আর তাই কমেছে দাম। তবু মিলছে না ক্রেতা। কেবল বাড়ি নয়, জমির ক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে একই অবস্থা। ক্রেতা কম, তাই ধীরে ধীরে কমছে দাম। কমেছে মূল্যস্ফীতিও। কিন্তু বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র।
বেড়েই চলেছে বাড়িভাড়া। বরং নানা অজুহাতে প্রতি বছর মালিকরা বাড়াচ্ছেন বাড়িভাড়া। এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও এর কোনো প্রয়োগই নেই। ভাড়াটিয়ারাও আইনের বিষয়ে জানেন না তেমন, তাই অভিযোগ করার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকলেও সেখানে অভিযোগ পড়ে না বললেই চলে। আইন অনুযায়ী এক মাসের অগ্রিম ভাড়া দিতে হলেও ঢাকার বাড়িওয়ালারা এখন তিন মাসের কমে অগ্রিম নিচ্ছেন না। বাড়ির মালিকরা করও সেভাবে পরিশোধ করছেন না বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বারবার প্রতিবেদন এলেও সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আর এ কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি অবসানের কোনো আভাস নেই।
মতিঝিলের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছেন এ টি এম আবদুল খালেক। বেতন পেতেন মাসে ২০ হাজার টাকা। স্ত্রী, এক ছেলে ও ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘদিন ভাড়া ছিলেন খিলগাঁও তিলপাপাড়ার একটি বাসার দ্বিতীয় তলায়। ২০০৪ সাল পর্যন্ত দুটি কক্ষ এবং ড্রয়িং-ডাইনিংসহ ভাড়া দিয়েছেন ৭ হাজার টাকা। কিন্তু এরপর বাড়ির মালিক বাড়িভাড়া বাড়ালেন ৩ হাজার টাকা। কয়েক বছরের ব্যবধানে ভাড়া করলেন ১৩ হাজার টাকা, এক বছর পর আবার ১৫ হাজার টাকা। দফায় দফায় বাড়িভাড়া বাড়লেও আবদুল খালেকের বেতন বাড়েনি তেমন। এখন তিনি ওই কোম্পানিতে পাচ্ছেন ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু ছেলেমেয়ে বড় হওয়ায় বেড়েছে তাদের লেখাপড়ার খরচও।
এর মধ্যে বিয়ে দিয়েছেন বড় মেয়ে পপির। একমাত্র ছেলে বাবলু মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ছোট মেয়ে প্রিতম পড়ছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ আর বাড়িভাড়ার ক্রমাগত বাড়তি চাপে শেষ পর্যন্ত ছাড়তে হলো দীর্ঘদিন থাকা বাড়িটি। বাসাভাড়া নিলেন তুলনামূলক কম ভাড়ায় মাদারটেকের অনুন্নত একটি জায়গায়।
আবদুল খালেক বলেন, ‘কি আর করব বলেন, নিজের বেতনে তো এত টাকা দিয়ে বাসাভাড়া নেওয়া সম্ভব নয়। ছেলেমেয়েদেরও তো পড়াশোনায় টাকা লাগে। তাই বাধ্য হয়েই বাসাটি ছাড়তে হলো।’
বাড়িভাড়া লাগামহীন বেড়ে যাওয়ায় আবদুল খালেকের মতো অনেক চাকরিজীবী শহরে বাচ্চাদের পড়ার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কোনো ফ্ল্যাটে না থেকে পরিবার নিয়ে চলে যাচ্ছেন শহর থেকে দূরে আশপাশের এলাকায় বা গ্রামে।
আর যারা শহরে থাকছেন তাদের অনেকেই সাবলেট থাকছেন। অর্থাৎ একটি ফ্ল্যাটের রুম ভাগ করে থাকছেন একাধিক পরিবার।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দেয়ালগুলোতে টু-লেট লাগানো লিফলেটগুলোতে এই সাবলেট লেখা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। যেখানে লেখা আছে দুই কি তিনজনের ফ্যামিলি, একরুম ভাড়া হবে। আর এসব একরুমের সাবলেটের ভাড়াও এলাকাভেদে ৫ হাজার কিংবা ১০ হাজার টাকার মধ্যে। পুরনো ভবন কিংবা বাড়িতে ভাড়া কিছুটা কম হলেও মোটামুটি দেখতে ভালো ফ্ল্যাটগুলোর ভাড়া তো আকাশছোঁয়া।
এলিফ্যান্ট রোড, নূরজাহান ভিলায় ১২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে ৪-৫ মাস আগে থাকতেন কয়েকজন বন্ধু মিলে। যার ভাড়া ছিল ১৯ হাজার টাকা। সার্ভিস চার্জ ৪ হাজার টাকা এবং অন্যান্য বিল মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। বন্ধুদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা কেউ পড়াশোনা করছি আবার কেউ বা ছোট চাকরি। কিন্তু যে বেতন তাতে নিজেই চলা দায়। বাড়িভাড়া এত বেশি যে, কয়েকজন বন্ধু মিলেই ফ্ল্যাট নিতে হয়েছে। তবুও একেকজনকে দিতে হয়েছে ৫ হাজার টাকা করে। ফলে বাসাটি ছেড়ে দিয়ে এখন তুলনামূলক কম ভাড়ায় মগবাজার এসেছি।’
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ১৩০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে সর্বনি¤œ ২০ থেকে ২৬ হাজার টাকা। বড় মগবাজার ও আশপাশের এলাকায় নেওয়া হচ্ছে ২৮ হাজার টাকা। রামপুরা-বনশ্রী ও আশপাশের এলাকায় ২০ হাজার টাকা। আর অভিজাত এলাকা বারিধারা, গুলশান, বনানী ও আশপাশের এলাকায় পুরনো বাড়িতে কিছুটা কম নেওয়া হলেও অ্যাপার্টমেন্ট বা নতুন বাড়িতে নেওয়া হচ্ছে ৩৫ হাজার টাকার বেশি, আর ডুপ্লেক্সের বাড়িগুলোতে প্রায় দেড় লাখ টাকা। যে যেমন পারছে নিজের ইচ্ছায় ভাড়া আদায় করছে।
রাজধানীর বড় মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকায় ১৩৭৮ বর্গফুট এবং ১৩০০ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাটের ভাড়া মালিক চাইলেন ২৮ হাজার টাকা। এর বাইরে সার্ভিস চার্জ দিতে হবে আরও ৫ হাজার টাকা। আর গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল তো আলাদা আছেই। অর্থাৎ সব মিলিয়ে মাসে ভাড়া পড়বে ৩৬ হাজার টাকার মতো।
রামপুরার হাজীপাড়া এলাকার নতুন রাস্তায় একাধিক বাড়ির চিত্রও একই। মো. খোকন তিনতলা বাড়ির মালিক। বাড়িটি কিছুটা পুরনো। ভাড়া দিবেন নিচতলায় ছোট দুই রুমের ফ্ল্যাট। সঙ্গে একটি ছোট বারান্দা। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিলসহ ভাড়া ১১ হাজার টাকা। তবে তিনি ভাড়ার রসিদ দেন না বলে জানান।
ফার্মগেটের একটি ছয়তলা ভবনে দুটি শয়ন কক্ষ এবং ড্রয়িংরুমে ছয়জন মিলে থাকছেন। বিল ছাড়া ভাড়া ১৮ হাজার টাকা। ভাড়া বেশি ও বেতন অনুযায়ী তা দেওয়া সম্ভব নয় বলে তারা এভাবে কয়েকজন মিলে থাকছেন। ফলে একেকজনের ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা লাগছে বাড়িভাড়া। অনেকে আবার সাবলেটও থাকছেন। অর্থাৎ একটি ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে আরেক ভাড়াটিয়া রুম ভাড়া নিচ্ছেন। এতে দুই ভাড়াটিয়ারই টাকা বাঁচছে।
রাজধানী হাতিরপুলে ২৮ হাজার টাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন এক দম্পতি। এর বাইরে অন্যান্য বিল মিলিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। তাই একটি কক্ষ ভাড়া দিয়েছেন অপরিচিতজনকে। ওই ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া বলেন, ‘যে টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে তা আমাদের জন্য জুলুম। আমার স্বামীর আয়ে তা সম্ভব নয়। তাই একটি কক্ষ ১০ হাজার টাকায় সাবলেট দিতে বাধ্য হয়েছি।’
এদিকে দফায় দফায় বাড়িভাড়া বাড়লেও অধিকাংশ বাড়ির মালিকই দিচ্ছেন না ভাড়ার রসিদ। কারণ হিসেবে জানা যায়, ভাড়ার রসিদে যে ভাড়া উল্লেখ থাকবে সে অনুয়ায়ী ট্যাক্স দিতে হবে। তাই ট্যাক্স ফাঁকি দিতেই বাড়িওয়ালারা ভাড়ার রসিদ দিচ্ছেন না। যেনতেন একটা ভাড়ার টাকার অঙ্ক বসিয়ে তা ট্যাক্স অফিসে জমা দিচ্ছেন। সরকার ট্যাক্স বাড়িয়েছে এমন অজুহাতসহ বিভিন্ন অজুহাতে বাড়িভাড়া বাড়াচ্ছেন মালিকরা। এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ছাড়া হতে হয়।
অন্যদিকে ট্যাক্সের অজুহাতে বাড়িভাড়া বাড়ালেও তারা ঠিক মতো ট্যাক্সও দিচ্ছেন না। ফলে অনেকের জমে আছে দুই-তিন বছরেরও বেশি সময়ের হোল্ডিংসহ অন্যান্য ট্যাক্স। বনানীতে ১৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে রিনিয়া আফরোজের। দুই বছরের ট্যাক্স জমে আছে তার। গত সপ্তাহে তিনি সিটি করপোরেশনের নোটিশ পেয়ে এসেছেন ডিএনসিসির গুলশানের আঞ্চলিক অফিস-৩ এ। তার ফ্ল্যাটের দুই বছরের ট্যাক্স এসেছে ৪২ হাজার ২৯২ টাকা। আর জরিমানা হয়েছে ৬ হাজার ৩৪৩ টাকা।
ডিএনসিসির গুলশানের আঞ্চলিক অফিস-৩ এর কর্মকর্তা লিয়াকত আলী বলেন, ‘অনেক বাড়িওয়ালাই ট্যাক্স সময় মতো দেন না। আবার সিটি করপোরেশনের নাম ভাঙিয়ে যে যার মতো ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া বেশি নেন ঠিকই কিন্তু আমাদের দেখান কম। তাই সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
লিয়াকত আলী জানান, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে সর্বশেষ ১৯৯১ সালে আইন করা হয়। এটি ১৯৯১ সালের ৩নং আইন নামে পরিচিত। এ আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে-‘এ আইনের বিধানসাপেক্ষে কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মতের বেশি বাড়ানো হলে ওই অধিক ভাড়া কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না। এ ব্যাপারে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে আবেদন করা যাবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মমতাজ উদ্দিন বলেন, ‘আইন থাকলেও বাড়ির মালিকরা তা মানছেন না। অনেকেই বলেন, সরকার হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়েছে। আসলে তা করা হয়নি। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি ৫ বছর অন্তর কাঁচা-পাকা পুরনো বাড়ি ও ভবনে কোনো ট্যাক্স বাড়ানো হয়নি। তবে ২০১২ সালে ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল।
আইন থাকলেও বাড়ির মালিকরা তা মানছেন না। অনেকেই বলেন, সরকার হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়েছে। আসলে তা করা হয়নি। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি ৫ বছর অন্তর কাঁচা-পাকা পুরনো বাড়ি ও ভবনে কোনো ট্যাক্স বাড়ানো হয়নি। তবে ২০১২ সালে ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।