logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
ক্রিকেট, রাজনীতি এবং ...
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ২৩:৫৯:২২
image


‘বড়বাবু বললেন, আমি বললাম। আমি বললাম, বড়বাবু বললেন। শেষকথা বলবেন আপনারা।’ যে ভাবনা থেকে এই লেখার শুরু তার সঙ্গে শুরুর লাইন তিনটিরই কোনো মিল নেই! অবাক হলেন? গোড়াতেই এমন স্বীকারোক্তি পাঠককে ভেতরে নেবে না, এমনটা বলতে পারি। তবে যদি বলি, এর সঙ্গে মিলে যাবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। তবে হয়ত এই ক্রিকেটীয় মৌসুমে দু-একজন পাব, যারা কিছুটা আগ্রহ দেখাবেন বাকিটা পড়তে। আর যদি তার সঙ্গে থাকে রাজনীতি? তবে আরও দুজন হয়ত জুটতে পারে। সে যাই হোক, লেখা যেহেতু শুরু করেছি শেষটাও তো করতে হবে, নাকি?

কবিতার পাঠক অনেক আগেই ধরেছেন, শুরুর লাইন তিনটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। কথাগুলো কবির হলেও এর সঙ্গে যে জাতীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক জীবের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো জড়িয়ে আছে, এ কথা বলতে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। অনেক মত, অনেক পথের ইঙ্গিত আছে কবির ভাষায়। কিন্তু সিদ্ধান্তের ভারও ছেড়ে দেওয়া আছে সাধারণের কাঁধে। কেউ হয়ত এরই মধ্যে টিপ্পনী কেটে বলছেন, ‘বেশ গণতন্ত্র, গণতন্ত্র গন্ধ পাচ্ছি।’ পেতেই পারেন, কারণ জন্ম থেকেই তো এমন বৈপরীত্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা।

শিশুর নাম রাখার বেলাতেও কি সবাই একমত হতে পেরেছিলেন? মায়ের যে নাম পছন্দ তার সঙ্গে হয়ত বাবার পছন্দ মিলছে না। আবার নানু-দাদুরাও আদর করে কত নামেই ডাকেন। ওই যে বললাম, সেই জন্ম থেকেই আছি নানামত আর নানাপথ নিয়ে। এখন চাইলেই কি সম্ভব জাতীয় ও রাজনৈতিক জীবনে এ থেকে বেরিয়ে আসা?

এবার একটু রাজনীতির জানালায় উঁকি দেওয়া যাক। বাংলাদেশের জন্ম থেকেই রাজনৈতিক মতাদর্শে পার্থক্য ছিল। এখনও আছে, থাকবেও। কারো পাল্লা ভারী হবে জনসমর্থনে, আবার কারো জনপ্রিয়তার পারদ থাকবে নি¤œমুখী। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শে পার্থক্য যদি রূপ নেয় ভয়াবহ সহিংসতায়, তাকে কি স্বাভাবিক আচরণ বলা যাবে? বর্তমান পরিস্থিতি এর জ্বলন্ত উদাহরণ। রাজনৈতিক রেষারেষির বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। দলকানা ভাই নিজের ভাইকেও চিনছে না। পেট্রল বোমা মেরে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষোভের আগুন। পুড়ে মরছে আপনার, আমার মতো জীবন্ত মানুষই। একবার কল্পনা করে কেউ কি দেখেছে কী করছি আমরা? বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষও আঁতকে উঠছেন এসব দেখে। রীতিমতো আতঙ্কের নগরী, আতঙ্কের দেশে বসবাস করছি আমরা। সবুজ, সুন্দর, অকৃত্রিম বন্ধনের প্রতীক বাংলাদেশ আজ আতঙ্কপুরী নারকীয় তা-বের উদাহরণ হয়ে উঠেছে। অবাক হয়ে বিশ্ব যেন সেদিকেই তাকিয়ে আছে।

এই দৃষ্টি অন্যদিকেও ঘোরানো যেত। সেই সক্ষমতাও আমাদের আছে। এর প্রমাণও আমরা পেয়েছি গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব আসরে লাল-সবুজের পোশাকে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলার ক্রিকেটাররা। পেট্রল বোমার আগুনের ছবি ফিকে হয়েছে প্রতিশোধ কিংবা শোধের আগুনে। দেশের মাটিতে গত বছরের মার্চের শুরুতে মোহাম্মদ নবীদের কাছে হেরেছিল মাশরাফিরা। সেই হারই উসুল হয়েছে ক্যানবেরার মানুকা ওভালে। আগুনঝরা বোলিংয়ে আফগানিদের দগ্ধ করে ১০৫ রানের জয় ঘরে তুলেছে বাংলাদেশ। এই উল্লাসেই ফেটে পড়েছিল গোটা দেশ। বাংলাদেশ থেকেও ঠিকই সবাই চোখ রেখেছেন ওভালে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য চত্বরে জায়ান্ট স্ক্রিন থেকে শুরু করে ঘরে ছোট টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সবাই। বিশ্বকাপ আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে টাইগার শিবিরের জয়ে আনন্দবার্তা বিলিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, বিএনপি চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে সবাই।

কই এখানে তো ঠিকই সবাই এক হলেন? এমন তো হয়নি শেখ হাসিনা অভিনন্দন জানিয়েছেন বলে খালেদা জিয়া আড়ি ধরে বসে আছেন? বরং কার আগে কে শুভেচ্ছা জানাবেন সেই প্রতিযোগিতাই ছিল তাদের মধ্যে। এ থেকে আবারও প্রমাণ মিলেছে দেশপ্রেমের। দেশপ্রেম তো মুখে বলে হয় না, কাজেই প্রমাণ মেলে।

ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে আমরা যেভাবে এক হয়েছিলাম, যেভাবে হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম, সেই বন্ধন কি চাইলে অটুট রাখা যায় না আমাদের রাজনৈতিক জীবনে? আমরা কি পারি না ক্ষমতার লড়াই ক্ষ্যান্ত দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে একটু স্বস্তি ফেরাতে? বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের জয় আমাদের রাজনৈতিক জীবনে কোনো শিক্ষাই কি রেখে যাবে না?

সাধারণ মানুষের কথাই বিকিকিনি করে ক্ষমতায় টিকে আছি আমরা, ক্ষমতায় যাওয়ার কল্পনাও করছি একই পথে। আবার আগুন দিচ্ছি শ্রমের ঘামে শিক্ত সাধারণ মানুষের শরীরেই। এটাই আমাদের মনুষ্যত্ব,  আমাদের রাজনীতি, আমাদের দেশপ্রেম, মানুষের প্রেম।

শুরু দিয়েই শেষ করছি। যে যাই বলুন শেষ কথা কিন্তু জনগণই বলবে। সেই জনগণের কথা শোনার মতো ধৈর্য শেষতক থাকবে তো বড়বাবুদের? ভুলে গেলে চলবে না, ‘যাইসা কারনি ওইসা ভারনি।’ সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।