logo ২৭ এপ্রিল ২০২৫
সিটি নির্বাচন: বিএনপি অংশ নিলে পাল্টে যাবে সবকিছু
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২৪ মার্চ, ২০১৫ ০০:২০:৩৫
image


বিএনপি ঢাকা সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাবে কি না তা নিয়ে এখনো সংশয় রয়ে গেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর নতুন সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা দলটি এতদিন বলে আসছে, জাতীয় নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেও। তবে টানা হরতাল-অবরোধ দৃশ্যত ব্যর্থ হওয়ার পর তৈরি হয়েছে নতুন এক পরিস্থিতির, যেখানে দলের ভেতর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে জোর আলোচনা তৈরি হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তো বলেই দিয়েছে, বিএনপি সিটি নির্বাচনে যাচ্ছে।

৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করতে না পেরে ‘অবরোধ চলবে’ ঘোষণা দেওয়ার পর বিএনপি জানায়, পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত অবরোধ চলবে। এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার জানানো হয়, যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা অবধি চলবে কর্মসূচি। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে অবরোধের পাশাপাশি সব কার্যদিবসে হরতালও দেয় দলটি।

টানা কর্মসূচি ঘোষণা করেও আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতিতে বিএনপি পৌঁছতে পেরেছে কি না, সে প্রশ্নের কোনো জবাব নেই দলের নেতাদের কাছে। নেতারা জানান, দৃশ্যত কর্মসূচি ব্যর্থ হওয়ার পরও বিএনপি হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক পরাজয় স্বীকার না করার জেদ থেকে। তবে কর্মসূচি থেকে সরে আসার বিষয়ে দলেও কথা হচ্ছে। কিন্তু বিকল্প বের করতে পারেনি দলটি।

তাহলে বিএনপির সরে আসার সুযোগ কী? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিএনপিকে দিতে পারে এই সুযোগ। হরতাল-অবরোধে নাশকতা, পুলিশের অভিযানে দলের নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশই আত্মগোপনে। ব্যবসা-চাকরি নিয়ে বিপাকে তারা। কিন্তু প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না তারা গ্রেপ্তারের ভয়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি সিটি নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থন দিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যাবে পুরোপুরি। দলের সমর্থনে আত্মগোপনে থাকা নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পাবে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এমরান হুসাইন বলেন, ‘বিএনপির অবশ্যই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আসা উচিত। কারণ, বিএনপি আন্দোলন করছে জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার দাবিতে। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। তাছাড়া তারা যদি এই নির্বাচনে না যায় তাহলে তারা আরও কোণঠাসা হয়ে যাবে।’

তাহলে সরকার বা নির্বাচন কমিশন কি বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবে? এ বিষয়ে সরকার দলের নেতারা কিছু বলছেন না। আর জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশন চায় সবাই নির্বাচনে অংশ নিক। কিন্তু এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। দলীয়ভাবে কিছু হয় না। তাই কাউকে ভোটে আসার বিষয়ে কমিশনের কোনো উদ্যোগ থাকবে না।

দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলমান হরতাল-অবরোধ থিতিয়ে গেছে। কিন্তু বিএনপির দাবি আদায়ের কোনো অগ্রগতিই নেই। আপাত ব্যর্থতাই এখন আন্দোলনের ফল। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলন আর সামনে টেনে নেওয়ার মানেই হয় না। কিন্তু কোনো যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে মাঠ থেকে সরে যাওয়াও তো রাজনৈতিক বিপর্যয়। তাই সিটি নির্বাচনে গেলে বিএনপির জন্য ‘সাপেবর’ হবে। নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলে আন্দোলনে ক্ষান্ত দেওয়ার মওকা পাবে দলটি।

বিএনপির নীতি-নির্ধারণীতে ভূমিকা রাখেন এমন কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে বিষয়টি নিয়ে। মুখে তারা সরাসরি না বললেও কথায় মনে হয়েছে, বিএনপির ভেতরের কেউ কেউ মনে করছেন সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে পারে তাদের জন্য সম্মানজনক ‘এক্সিট পয়েন্ট।’ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা হয়েছে তাদের।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের নিরঙ্কুশ জয়ের কথাটিও আলোচনা হয়েছে। এখনও জনসমর্থন দিনদিন সরকারের বিপক্ষে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। এই সুযোগটাও কাজে লাগাতে পারলে ফলাফল ইতিবাচক হবে। তবে এখন করণীয় ঠিক করতে পারেনি দলটি।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গত ১৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে নতুন কোনো বার্তা দেননি কথাটি মোটেও ঠিক নয়। একটু চিন্তা করলে এর মধ্যে নতুন কিছু পাওয়া যাবে। খালেদা জিয়া বলেছেন, সংলাপের উদ্যোগ নিলেই চলমান রাজনৈতিক সংকটের সুরাহা হবে। শর্ত হিসেবে তিনি বলেছেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দ্রুত সংলাপের আয়োজন করা।

শুরু থেকে বিএনপি বলে আসছিল, সংলাপ হলেই হবে না বরং এর আগে সরকারকে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। বিএনপি নেত্রীর এখনকার বক্তব্য বলতে দলটি এখন এ ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় হয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত এতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা হরদম আউড়িয়ে গেলেও সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেছেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সরকার। এ থেকে অনুমেয় যে, বিএনপি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটা সম্মানজনক পথ খুঁজছে। যেন সাপও না মরে লাঠিও না ভাঙে।

তবে সরকারি দলের মনোভাব তার উল্টো। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, বিএনপির আন্দোলনে ব্যস্ত থাকার সুযোগটাই লুফে নিতে চাইছে তারা। বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে আওয়ামী লীগ ‘একতরফা’ নির্বাচনের সুবর্ণ সুযোগে নিজেদের পছন্দের লোককে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নগরপিতার আসনে বসাবে। অন্যদিকে নির্বাচনী আমেজ শুরু হলে বিএনপির আন্দোলন আরও একঘরে হয়ে যাবে। কারণ, সরকারি দল ভালো করেই বুঝতে পারছে নির্বাচনের মাঠে বিএনপির তুলনায় তারা দুর্বল। তবে শেষতক যদি বিএনপি নির্বাচনে চলেই আসে তাহলে সিটি নির্বাচন না হওয়ার আশঙ্কাও উঁকি দিচ্ছে কারো কারো মনে।

নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির মধ্যে ইতিবাচক মতই বেশি। দলের বেশ কয়েকজন নেতা খালেদা জিয়াকে সরাসরি বিষয়টি বলেছেন। কিন্তু এখনও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন দলীয় প্রধান। চেয়ারপারসনের সঙ্গে রাজধানীর গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থান করছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে আমি জানি না। তফসিল ঘোষণা হয়েছে। আমরা দেখেছি। সিদ্ধান্ত জানাবো।’

দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি গণতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক দল। নির্বাচন আন্দোলনেরই অংশ হতে পারে। তবে সিদ্ধান্ত হবে দলের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে।’  

দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপির নেতা-কর্মীরাও চাইছেন সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পর চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পেয়েছে বিএনপি। জনসমর্থন বিবেচনায় এখনও নিজেদের এগিয়ে রাখছে দলটি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গেলে বিএনপি ভালো করবে এই বিশ্বাস দলের নেতা-কর্মীদের। নির্বাচনে জিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামকে যদি দখলে নেওয়া যায় তবে আগামী দিনের আন্দোলনে তা কাজে আসবে। যদিও গাজীপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বিএনপি সমর্থিত মেয়ররা কেউ ভালো নেই। মামলা-মোকদ্দমা ও অসুস্থতার কারণে এখন তারা বেকায়দায়।

এতকিছুর পরও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে এখন আতঙ্ক ভর করেছে। সরকার যেভাবে তাদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে তাতে সঠিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নেওয়া কষ্টসাধ্য। এখন নির্বাচনে অংশ নিলে নেতা-কর্মীদের আতঙ্ক কেটে যাবে।’ সোমবারতো তিনি আরও একটু এগিয়ে বলেছেন, সিটি নির্বাচনে বিএনপির অংশ যাবে। এ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রতি বিএনপির সমর্থন থাকবে।

২০১২ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর মেয়র পদে বিএনপির অনেকের প্রার্থী হওয়ার গুঞ্জন ছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক স¤পাদক আসাদুজ্জামান রিপন, অর্থবিষয়ক স¤পাদক আবদুস সালাম, যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।

এবার নির্বাচন নিয়ে দলীয়ভাবে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত না হলেও ইতিমধ্যেই ঢাকা উত্তর সিটিতে আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং দক্ষিণে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লাহর নাম শোনা যাচ্ছে। তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।