ঢাকা: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অনুমোদিত ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত আবাসিক এলাকাতেও চলছে একই কার্যক্রম। কিন্তু সরকারের একটি সংস্থার নিয়মের কারণে ট্রেড লাইসেন্স দিতে পারছে না ঢাকা সিটি করপোরেশন। আর এ কারণে রাজস্ব হারাচ্ছে সংস্থাটি। নগর কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে বারবার তাগাদা দিলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না রাজউক।
স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০০৭ সালের ১২ আগস্ট ঢাকা মহানগরীর রাজউক, গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয়, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আবাসিক এলাকায় নতুন কোনো ট্রেড লাইসেন্স অর্থাৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নাবায়ন না করার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর পর থেকে নির্দিষ্ট আবাসিক এলাকায় পুরনো প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দিতে পারেনি ডিসিসি।
ঢাকার উত্তরা, বনানী, গুলশান, বারিধারা ও মিরপুরসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ২০০৭ সাল থেকে ট্রেড লাইসেন্স দেয়া বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দেয়া নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানছে না কেউই। নিজ বাড়ির নীচে, বাসাবাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে হরদম চলছে অফিস, দোকান-পাট, কারখানা, বুটিক হাউস, বিউটি পার্লারসহ নানা ধরণের বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
বনানীর আবাসিক এলাকার থাকেন রিনিয়া আফরোজ। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘একটু শান্ত পরিবেশ থাকার আশায় বছর আগে এই এলাকায় ফ্লাটটি কিনেছিলাম। কিন্তু এলাকাটাকে এখন আর আবাসিক বলে মনে হয় না। আশপাশে দোকান পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অফিসসহ এই ভবনেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফলে দিনভর মানুষের আনাগোনা লেগেই আছে’।
নিয়মবহির্ভূতভাবে আবাসিক এলাকায় দেয়া হচ্ছে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের অনুমোদনও। ফলে দুর্ঘটনাও কম হচ্ছে না।
২০১৩ সালে গুলশান আবাসিক এলাকায় এমনই একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সময় এলাকাবাসী বহুবার অভিযোগ করেছিলেন। ২০১৩ সালে ১৮ মে গুলশান আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে গেস্ট হাউজ বা হোটেল নির্মাণ বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউক, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়নি কোনো কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালের ৮ নভেম্বর সৈয়দ আবুল হোসেনের বাড়ি সংলগ্ন সিক্স সিজন হোটেলের ১৬ তলায় (বাড়ি নং-১৯, রোড নং-৯৬, গুলশান-২, ঢাকা-১২১২) শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র মেরামত করতে গিয়ে বিস্ফোরণে একজন নিহত ও দুইজন আহত হন। কয়েকমাস আগেও ঘটেছে এমন দুর্ঘটনা।
কত ভবনের রাজস্ব পাচ্ছে না জানেই না ডিসিসি
আবাসিক এলাকায় কতগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার সঠিক হিসেবও নেই রাজউকের কাছে। আর আবাসিক এলাকায় সিটি করপোরেশন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন না করায় মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য ট্রেড লাইসেন্সও করাতে পারছেন না। ফলে বছরের পর বছর রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সিটি করপোরেশন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গুলশান, অঞ্চল-৩ এর কর কর্মকর্তা লিয়াকত আলী মিয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, আবাসিক এলাকায় যতগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আছে সবগুলো অবৈধ। তাদের কারোই লাইসেন্স নাই। আমাদের কাছে অনেকেই আসেন তাদের প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স করতে। কিন্তু আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করার নিষেধাজ্ঞা থাকায় ২০০৭ সাল থেকে তাদের কাউকেই ট্রেড লাইসেন্স দিতে পারছি না। এতে সরকারও বছরের পর বছর অনেক রাজস্ব হারাচ্ছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘হয় আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান একেবারেই উঠিয়ে দেয়া হোক নয়তো তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেয়া হোক।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপসচিব ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মমতাজ উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে বহুবার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউকের কাছে বলেছি। দুইবার বিষয়টি নিয়ে বৈঠকও হয়েছে তাদের সঙ্গে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। তবে আরেকটি বৈঠক আছে তাদের সঙ্গে। আশা করি তখন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে।’
নগরের কয়েকটি আবাসিক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এরকম বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তাদের প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স থাকলেও নবায়ন নেই তাদের। আবার কারো কারো নেই লাইসেন্স।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মুদি ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার নিজের বাড়ির নীচতলাতেই দোকান দিয়েছি। এখানে তো আর অতিরিক্ত খরচের দরকার হয় না। অন্য জায়গায় দোকান দিলে তো খরচ বেড়ে যাবে।আমরা ট্রেড লাইসেন্স করতে গিয়েছিলাম কিন্তু তারা দেয়নি।’
রাজউক অনুমোদিত অধিকাংশ আবাসিক এলাকার ভবনে আট বছর ধরেও লাইসেন্স ছাড়াই অফিস পরিচালিত হচ্ছে বলে ভবন কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন। কোনো ভবনে পাঁচটি, আবার কোনো ভবনে ২৫টির বেশি অফিস আছে।
বেশ কিছু এলাকা ঘুরে কয়েকটি লিফলেটও দেখা যায় যেখানে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভাড়া দেয়ার বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। আর বিভিন্ন পত্রিকায় চোখ রাখলেও এসব বিজ্ঞাপন দেখা যাবে।
আবাসিক এলাকা বনানী এ ব্লকের ২৩ নম্বর রোডের ৮৮ নম্বর বাড়িতে গত জানুয়ারি মাসে ‘ঝাল’ নামের একটি রেস্টুরেন্টও উদ্বোধন করা হয়। এক বছর আগে এটি ফ্ল্যামিংগো নামে একই জায়গায় ছিল। সেই প্রতিষ্ঠানের নামে করা ট্রেড লাইসেন্স ‘ঝাল’ এর নামে নবায়নের দাবি করেছেন এর কর্মকর্তা শাহীন জানান।
২০০৭ সাল থেকে বন্ধ থাকা ট্রেড লাইসেন্সের নবায়ন কিভাবে আপনারা পেলেন, এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে যান ওই কর্মকর্তা।
মিরপুর অঞ্চল-২ এর কর কর্মকর্তা আবদুল আলিম বলেন, ‘এই এলাকায় কিছু কিছু ওয়ার্ডে ট্রেড লাইসেন্স নিষিদ্ধ। কিন্তু এলাকা ঘুরলে মনে হবে এটি আবাসিক নয়, বাণিজ্যিক এলাকা। আমরা তাদেরকে ট্রেড লাইসেন্স দিতে পারছি না আবার উচ্ছেদও করতেও পারছি না’।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের অঞ্চল-৫ এর কর কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে ২৯, ৩১ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ড আবাসিক হওয়ায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন অমান্য করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গত ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা থাকলেও এখনো কিছুই হয়নি। এটা রাজউকের দায় কিন্তু তারা কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
উত্তরা অঞ্চল-১ ঘুরেও এরকম চিত্র দেখা গেল। এ বিষয়ে রাজউক উদাসীন বলে কর কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছিল যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নবায়ন করা যাবে কি না। কিন্তু এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়নি।’
অবৈধভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যবস্থা তো নিচ্ছিই। কিন্তু ব্যবস্থা নিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। যারা আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন তাদের বহুবার নোটিশ দেয়া হয়েছে, এমনকি জরিমানাও করা হয়েছে। কয়েকজনকে উচ্ছেদও করা হয়েছে। এর আগে ২০১২ সালে উত্তরার ১৩নং সেক্টরে আবাসিক এলাকায় পরিবেশ দূষণ ও অবৈধভাবে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড করায় দৈনিক প্রথম আলোর স্বত্বাধিকারী ট্রান্সকম গ্রুপের মালিকানাধীন কেএফসি রেস্টুরেন্ট ও পিজা হাট নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ২১ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছিল।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বনানী, গুলশান এলাকায় যারা থাকেন তারা এতই প্রভাবশালী যে তাদের সঙ্গে পারা যায় না। তারা হাইকোর্ট থেকে কিভাবে সেটা আবার উদ্ধার করে নেয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।’
ডিসিসির দাবির প্রেক্ষিতে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অবশ্যই তাদের উচ্ছেদের চেষ্টা করবো।কিন্তু তাদের লাইসেন্স নবায়ন কিংবা লাইসেন্স দেয়া সম্ভব নয়। কারণ আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকলে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশও নষ্ট হয়।‘
এ সময় আবাসিক এলাকায় কতগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার সঠিক হিসেব রাজউকের কাছে নেই বলে তিনি জানান।
১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন জ্ঞানী ব্যক্তি ও সিভিল সোসাইটি নিয়ে এই ট্রাস্ট পরিচালনা করা হতো। এরপর ১৯৬০/৬১ সালের দিকে প্লট ও ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা করে কার্যক্রম চালানো হয়। পরে ১৯৮৭ সালে এর নামকরণ পাল্টে রাখা হয় রাজধানী উন্নয়ন করপোরেশন (রাজউক)।
(ঢাকাটাইমস/৯ মার্চ/ ইরা/ডব্লিউবি)