logo ২৭ এপ্রিল ২০২৫
শ্যাম রাখি না কুল রাখি
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
৩০ মার্চ, ২০১৫ ১১:৫১:৫৭
image


চাইলেই কি সহজভাবে নেওয়া যায়? অনেকদিনের প্রস্তুতি বলে কথা। নির্বাচনী মাঠে জনসমর্থন জোগাতেও তো বেশ সময় দিতে হয়েছে। এখন দলের সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও মনে মনে সব মেনে নিতে পারবেন তারা? ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম, সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার এবং এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী পাননি সরকার দলের সমর্থন। এই তিনজনই চেয়েছিলেন ২৮ এপ্রিলের নগর নির্বাচন ভোটে মেয়র প্রার্থী হতে। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে সরে যেতে হয়েছে নির্বাচনী দৌড় থেকে।

শুরুর প্রশ্নগুলো জনমনে উঁকি দিচ্ছে সঙ্গতকারণেই। ২০১৩ সালের ৬ জুলাই নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানকে হারতে হয়েছিল বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে। এই অকাট্য বাস্তবতার পেছনে কারণ ছিল বটে। ওই নির্বাচনে মেয়র পদে লড়তে চেয়েছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। যিনি সেবার সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দিয়ে নেমেছিলেন নগর নির্বাচনে। মনোনয়নপত্র কিনে তা জমা দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যালট পেপারে আর ঠাঁই হয়নি তার। শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়িয়েছিলেন নির্বাচন থেকে। চোখের পানিতে সমর্থন দিয়েছিলেন ‘বড় ভাই’ আজমত উল্লাহ খানকে।

জাহাঙ্গীর আলমের কান্নাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি অনেকে। বোঝা গিয়েছিল ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। শেষতক নির্বাচনের ফলও বলেছে সেই কথা। তিনবারের নির্বাচিত টঙ্গী পৌরসভার মেয়র আজমত উল্লাহর পরাজয়ের পেছনে জাহাঙ্গীর আলমকে দায়ী করেছিলেন আজমত শিবিরের লোকজন। অনেককে বলতে শোনা গেছে, দলীয় প্রধানের নির্দেশে জাহাঙ্গীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও তার সমর্থকরা কাজ করেছেন মান্নানের হয়ে। আর তাতেই আজমত কিস্তির ভরাডুবি।

প্রার্থী সমর্থন নিয়ে সরকার দলে প্রায় একই ধাঁচের ঘটনা ঘটছে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ থেকে একাধিক নেতা ও সংসদ সদস্য মেয়র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমর্থন তো আর একাধিক নেতা পাবেন না একটি আসন থেকে। বাধ্য হয়ে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও নির্বাচনী মাঠে দলের হয়ে কতটুকু কাজ করবেন? আসলেই কি সম্ভব হবে সব ভুলে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া, সেই প্রশ্নই ভেতরে ভেতরে জোরাল হচ্ছে। আর বাদ পড়াদের মানসিক অবস্থাও শোচনীয়। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ পরিস্থিতি এড়ানো সহজ হচ্ছে না তাদের জন্য।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। নির্বাচনের হাওয়া যবে থেকে বইছে তখন থেকেই কোমর বেঁধে রেখেছিলেন তিনি। মনোনয়নপত্রও কিনেছেন। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্য পদ ছাড়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন মেয়র প্রার্থী হওয়ার সাধ থেকে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গেও কয়েক দফা দেখা করে জানিয়েছেন মেয়র পদে লড়া তার বাসনা। সমর্থন চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘দক্ষিণে আমার প্রার্থী ঠিক হয়ে গেছে। সাঈদ খোকনকে আমি সমর্থন দিয়েছি। তুমি সংসদ সদস্য পদ ছেড়ো না। দলের সমর্থিত প্রার্থীর হয়ে কাজ কর।’ এরপরও পদত্যাগপত্র নিয়ে স্পিকারের দরবারে গিয়েছিলেন হাজী সেলিম। কিন্তু পদত্যাগপত্র নেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, ‘সংসদকে আপনি মাতিয়ে রেখেছেন। আপনাকে সেখানে দরকার আছে।’

‘অভিমানী’ হাজী সেলিম ফেসবুকের পাতায় তুলে ধরেছিলেন নিজের মনের কষ্ট। ‘পদত্যাগেও বাধা দেওয়া হলো আমাকে। এখন আমার মেয়র প্রার্থী হওয়া অনিশ্চয়তার মুখে।’ সেই যে চুপ হয়ে গেলেন হাজী সেলিম আর মুখ খুললেন না। সন্তর্পণে দেশ ছাড়লেন। গত ২৬ মার্চ ফেসবুকের পাতায় দেওয়া এক স্ট্যাটাসে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখেন, ‘আমি চিকিৎসার জন্য মাদ্রাজের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করলাম। আমি মাদ্রাজে চিকিৎসা শেষ করে মাজার জিয়ারতের উদ্দেশে আজমীর শরীফ যাব। আমার মেয়র নির্বাচনের জন্য গত কয়েকদিন শরীরের ওপর অনেক নির্যাতন করেছি। ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার সঙ্গে আমার ঢাকার লক্ষ লক্ষ কর্মী, সমর্থক, ভক্ত এবং পাড়া-মহল্লার মা-বোনরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আমি তাদের কাছে ঋণী এবং কৃতজ্ঞ। আমি যাতে চিকিৎসা এবং আজমীর শরীফে মাজার জিয়ারত শেষ করে আবার আপনাদের মাঝে ফিরে এসে আপনাদের সেবা করতে পারি এর জন্য দোয়া করবেন।’

এই স্ট্যাটাস তিনি লিখেছেন দেশের বাইরে বসেই। হাজী সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী সোহেল জানান, ২৫ মার্চ রাতেই মাদ্রাজের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন মেয়র পদে নির্বাচনে আগ্রহী এই নেতা।

মুখ ফুটে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা না দিলেও সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসে ঠিকই বোঝা যাচ্ছে, ঢাকার নগর পিতার নির্বাচনে আর দেখা যাবে না তাকে।  ইঙ্গিতবাহী বক্তব্য ও হঠাৎ দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমানো মোটেও ভালোভাবে নিচ্ছেন না তার অনুসারী-অনুগামীরা। দলের জন্য এই ত্যাগ বড় কিছু হলেও তার সমর্থকরা দেখছেন নিজেদের ‘পরাজয়’ হিসেবে। হাজী সেলিম ঠিকই বুঝতে পেরেছেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে গিয়ে তিনি বিরাগভাজন হবেন অনুসারী-অনুগামীদের। নিজেও ভুগবেন আত্মদহনে। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতেই যে দেশ ছেড়েছেন পুরান ঢাকার জনপ্রিয় এই মুখ, সে কথা আর বলে দেওয়ার দরকার নেই।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘দলের চোখে হয়ত হাজী সেলিম যোগ্য প্রার্থী নন। কিন্তু দক্ষিণ ঢাকাবাসী তো বলছে ভিন্ন কথা। গত জাতীয় নির্বাচনেও তো তার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। দলের ‘হেভিওয়েট প্রার্থী’ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে টপকে ‘হাতিতে চড়ে’ ঠিকই পৌঁছে গেছেন সংসদে। বিপদে-আপদে ঢাকাবাসীর পাশে থাকা এই মানুষটির জনপ্রিয়তা তো কোনো অংশেই দল সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনের চেয়ে কম নয়। বরং নিমতলীর ট্র্যাজেডির সময় যখন হাজী সেলিম ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরে চাল-ডাল কিনে পাঠাচ্ছিলেন তখন তো খোকনকে একদিনের জন্যও চোখে দেখেনি ঢাকাবাসী। সেই প্রতিদান কি মানুষ দেবে না?’ আওয়ামী লীগের এই নেতার কথায় স্পষ্ট আভাস মিলছে হাওয়া বদলের। মুখে মুখে দলের সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার কথা বললেও হাজী সেলিম শিবিরের লোকজন বিপরীত পথে হাঁটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

তিনি খুব বেশি আলোচনা ছিলেন না কখনই, নেতিবাচক কাণ্ডে বারবারই সমালোচনার কেন্দ্রে এসেছেন। তবে ঢাকা সিটি নির্বাচনকে ঘিরে নতুন করে আলোচনার বিষয় হয়েছেন। তাকে মেয়র পদে দেখতে মিরপুর, মহাখালী এলাকায় পোস্টার-বিলবোর্ডও চোখে পড়েছে। কিন্তু দল যখন ঢাকা সিটি উত্তর থেকে ব্যবসায়ী আনিসুল হককে সমর্থন দিল তখন চুপসে গেছেন কামাল আহমেদ মজুমদার। তারপরও চেয়েছিলেন একাই নির্বাচন করবেন। তার আগে তো ছাড়তে হবে সংসদ সদস্য পদ। পদত্যাগের আগে পরামর্শের জন্যই গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে। হালে পানি পাননি।

দলীয় প্রধান বলে দিয়েছেন, পাগলামো না করে যেমন আছেন তেমন থাকুন। দলের পক্ষে দুজনকে সমর্থন দেওয়া সম্ভব নয়। আগেই প্রার্থী ঠিক হয়ে গেছে। এমন বাস্তবতায় সংসদ সদস্য পদ হারিয়ে যদি মেয়র নির্বাচনেও জিততে না পারেন তাহলে দুই কূলই যাবে। সব ভেবেচিন্তে তাই কামাল মজুমদার বসে গেলেন। তবে রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বসে যাওয়া মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়।

ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ আসনের সংসদ সদস্য ও সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পরও দলের সমর্থন পাননি তিনি। বরং দলের সমর্থন গেছে আনিসুল হকের মতো কার্যত রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় একজনের ঘরে। ব্যাপারটা হজম করা কামাল মজুমদারের জন্য সহজ নয় বলেই মনে করছেন তার অনুসারীরা। নির্বাচনের মাঠে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিনই।

চারবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনবারই জয়ী হয়েছেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। টানা ১৬ বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে গত সিটি নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবি হয় তার এককালের রাজনৈতিক শিষ্য বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মঞ্জুর আলমের কাছে।

এবার চেয়েছিলেন দলের সমর্থন। বলেছিলেন, ‘জীবনের শেষবেলায় এসে চট্টগ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।’ প্রচার-প্রচারণাও চালিয়েছেন সাধ্যমতো। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর পাল্টে যায় চিত্র। দলের সমর্থন পাননি তিনি। পেয়েছেন আ জ ম নাছির উদ্দিন।

তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সহসভাপতি। ভেস্তে যায় এ বি এম মহিউদ্দিনের সব আয়োজন। বুকে পাথর চেপেই বোধহয় জড়িয়ে নিলেন নাছির উদ্দিনকে। ঘোষণা দিয়েছেন দল সমর্থিত প্রার্থীর হয়ে মাঠে থাকবেন তিনি। কিন্তু এত সহজেই কি মনের দুঃখ ভুলতে পেরেছেন তিনি? এই প্রশ্ন তার আশপাশের মানুষের।

উত্তরটাও জানা, রাজনীতি করতে গেলে অনেক সময় ‘ঢেঁকি’ গিলতে হয়। তাই বলে সবকিছু এত সহজে মন থেকে মেনে নেওয়া যায় না। নির্বাচনের সূর্যটা শেষ বিকালে কালোমেঘে ছেঁয়ে যাবে না তো? কথায় আছে না, এত ভালো ভালো নয়।

তবে আওয়ামী লীগ নেতারা এসবে কোনো সমস্যা দেখছেন না। দলটির যুগ্ম সাধারণ সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এই সময়কে বলেন, ‘এত বড় একটা দলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আকাক্সক্ষা অনেকের থাকতেই পারে। তাই বলে সবাইকে তো সমর্থন দেয়া যাবে না। দল ও দলীয় প্রধান যাকে ভাল মনে করেছেন তাকেই সমর্থন দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের পক্ষে কাজ করবেন, কেন্দ্র থেকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না।’ তিনি বলেন, ‘দল করতে হলে সবাইকে অনুগতশীল আচরণ করতে হবে। এ বিকল্প করলে দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’

হাজী সেলিমের সরে দাঁড়ানো বুমেরাং হবে না তো?

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কার্যত ‘একতরফা’ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে ১১ হাজার ৯৯৫ ভোটে হারিয়ে হাতি মার্কায় জয় আনেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। ঢাকাবাসী তার সঙ্গে আছেন, এ দাবি সব সময়ের। এও বলেছেন, তিনি মেয়র প্রার্থী না হলে ঢাকাবাসীর অনেকে আত্মহত্যা করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্তের কাছেই ‘হার মানতে’ হয়েছে তাকে। দল থেকে বাদ পড়ার ঝামেলা এড়াতে সরে দাঁড়িয়েছেন নির্বাচন থেকে। যদিও গত জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করায় পদ হারাতে হয়নি হাজী সেলিমকে।  

তবে আওয়ামী লীগের ভেতরেই প্রশ্ন আছে দক্ষিণে দলের সমর্থিত প্রার্থী নিয়ে। হাজী সেলিমের তুলনায় সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন খুব বেশি যোগ্য তা মেনে নিতে রাজি নন দলের নেতাকর্মীরাই। তারা মনে করছেন, বিএনপি যদি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে দক্ষিণে ‘নড়বড়ে’ এই প্রার্থী দিয়ে আওয়ামী লীগের মুখরক্ষা কঠিন হবে। সেক্ষেত্রে হাজী সেলিম অনেক শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন বলেই পুরান ঢাকার মানুষ মনে করেন।

স্থানীয় ও দলীয় সূত্র জানায়, সুখে-দুঃখে সব সময় ঢাকাবাসীর পাশে থাকেন হাজী সেলিম। সেবার জন্য মানুষকে এসে তার দুয়ারে ধরনা দিতে হয় না। বরং রাত-দুপুরে বিপদে-আপদে ছুটে যান মানুষের কাছে। নিমতলী ট্র্যাজেডির সময়ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে ছিলেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবেও দায়িত্বও পালন করেছেন ঢাকা সমিতির সভাপতি হাজী সেলিম। তাছাড়া ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও একজন তিনি।

এই শিল্পপতির ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোও ডিসিসি দক্ষিণ এলাকার মধ্যে। কোতোয়ালি, সূত্রাপুর এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকাবাসীর অনুরোধে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাতিতে চড়ে জাতীয় সংসদে গিয়েছিলেন। এবার যদি দল তাকে সমর্থন দিত তাহলে তিনি মুখ রাখতে পারতেন।

আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের নেতা-কর্মীরাই বলছেন, দল থেকে সাঈদ খোকনকে সমর্থন দেওয়া হলেও হাজী সেলিমের অনুসারী-অনুগামীরা কখনই তার হয়ে কাজ করবে না। কারণ খোকন শুরু থেকেই সেলিমের প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্বাচনী মাঠে প্রচারণায় ছিলেন। এখন দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে হাজী সেলিম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ঠিকই কিন্তু মনেপ্রাণে তা মেনে নিতে পারেননি। তার বড় প্রমাণ হঠাৎ তার দেশত্যাগ। এ মাধ্যমেই তিনি তার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তাই একাধিক প্রার্থী হলে আওয়ামী লীগের ভোট ভাগাভাগির যে দুশ্চিন্তা করা হচ্ছিলÑএই পরিস্থিতিতে তা পুরোপুরি কেটে যায়নি বলেই মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। বরং হাজী সেলিমকে রেখে খোকনকে দলের সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়েই ফিরতে পারে।  

নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছেন মহিউদ্দিন?

বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মেয়র পদে আসেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। আপাদমস্তক এই রাজনীতিক এর আগে জাতীয় পর্যায়ে একটি নির্বাচনই করেছিলেন ১৯৯১ সালে, তবে ওই সংসদ নির্বাচনে তাকে হারতে হয়েছিল বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের কাছে। বিরোধী দল থেকে প্রার্থী হয়ে ১৯৯৪ সালে সেই যে মেয়র পদে বসলেন, তারপর ২০১০ পর্যন্ত আরও দুটি নির্বাচনে হারতে হয়নি তাকে। ২০১০ সালে দল যখন ক্ষমতায়, তখন নির্বাচনে এক লাখ ভোটে হারলেন এম মঞ্জুর আলমের কাছে। সেবার হেরে দলের মধ্যেও গুরুত্ব হারান মহিউদ্দিন চৌধুরী।

পঞ্চমবারের মতো সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিলেন হারানো অবস্থান ফিরে পেতে। কিন্তু দলের সুদৃষ্টি পড়েনি তার প্রতি। তিনিও ‘হাসিমুখে’ মেনে নিয়েছেন সবকিছু। আসলেই কি তিনি মেনে নিতে পেরেছেন সবকিছু? তাছাড়া চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নাছির উদ্দিন কোনোকালেই মহিউদ্দিনের মতো বর্ষীয়ান নেতার কাছাকাছি ছিলেন না। এখন মহিউদ্দিনের অনুসারী-অনুগামীরাও নাছির উদ্দিনকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না। সেখানে নাছির উদ্দিন ভোটের দৌড়ে জিতে মেয়র নির্বাচিত হবেনÑএমনটা সহজ নয় বলে মনে করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। প্রকাশ্যে কেউ দল সমর্থিত প্রার্থীর বিরোধিতায় না নামলেও ভেতরে ভেতরে তাদের সমর্থন কতটুকু নাছির উদ্দিনের পক্ষে যাবেÑতা দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ২৮ এপ্রিলের ভোট পর্যন্ত।

কামাল এখন কী করবেন?

নিজেকে ঢাকার মেয়র আসনে দেখা ছিল কামাল আহমেদ মজুমদারের স্বপ্ন। তিনি নাকি তার ঘনিষ্ঠদের প্রায়ই বলতেন, ‘কখনও ভাবিনি ফেনী থেকে উঠে এসে ঢাকার সংসদ সদস্য হব। কিন্তু তাই হয়েছি। এখন স্বপ্ন ঢাকার মেয়র হওয়া।’ স্বপ্নটা অধরাই রয়ে গেল যেন। দল থেকে সমর্থন পাওয়ার প্রবল বিশ্বাস ছিল মনে। তবে আশাহত হতে হয়েছে। দল তাকে সমর্থন দেয়নি, দিয়েছে ব্যবসায়ী আনিসুল হককে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বলে কথা। চাইলেও তো আর দলের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হওয়ার উপায় নেই। মুখ বুজেই সহ্য করতে হচ্ছে দলের সিদ্ধান্ত। তা না হলে দলীয় পদ হারানোর আশঙ্কা তো থেকেই যায়।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে কামাল মজুমদার নিজে কিংবা তার কর্মী-সমর্থকরা কতটুকু মেনে নিতে পেরেছেন দলীয় সিদ্ধান্ত? রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ নয়। কারণ, নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ তো বড়ই জটিল। অনেক সময় দলের লোকজনদের কারণেই যে দলীয় প্রার্থীকে হারতে হয় তা তো কারো অজানা নয়। তাছাড়া বিএনপি নির্বাচনে এলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জন্য লড়াইটাও কঠিন হবে। তখন দলের মধ্যে সঙ্গোপনে থাকা বিদ্রোহীরা ‘কাল’ হয়েও দেখা দিতে পারে। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।