logo ২৬ এপ্রিল ২০২৫
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি: বলা সহজ, করা কঠিন
বোরহান উদ্দিন
২৮ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:২৫:৩১
image


আধুনিক নগর জীবনে নানা সমস্যা থাকবেই। কিন্তু ঢাকার সমস্যা যেন পাহাড়সম। নিত্য যানজটে স্থবির রাজধানীতে সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছা দায়। চলার জন্য নেই আরামদায়ক গণপরিবহন, নেই ভাড়ার শৃঙ্খলা। কিন্তু নগরীর মূল সমস্যা কি কেবল পরিবহনে যন্ত্রণা? না, ক্রমাগত বাড়তে থাকা বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ নেই। অলিগলির সড়কের একটি বড় অংশই ভাঙাচোরা, মশার যন্ত্রণা, গৃহস্থালি আর কারখানা বর্জ্যে পুঁতিগন্ধময় নানা এলাকার পরিবেশ, বেদখল হয়েছে বেশিরভাগ খেলার মাঠ, পার্কগুলোর পরিবেশও ভালো নয় কোনোভাবেই। নগরীর চারপাশ ঘিরে থাকা নদীগুলোও দখল-দূষণে বিপর্যস্ত। বিদ্যুৎ সরবরাহে উন্নতি হলেও পানি সরবরাহে ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। প্রতি গ্রীষ্মে চাহিদা মতো পানি না পেয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষকে থাকতে হয় দুর্ভোগে। আবার লাইনে যে পানি আসে তাও মানসম্মত নয়। এসব সমস্যায় ক্রমেই বসবাসের জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে অযোগ্য শহরের তালিকায় নাম ওঠেছে ঢাকার।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের মূল সমস্যা জলাবদ্ধতা আর যেখানে-সেখানে পড়ে থাকা ময়লা আবর্জনা। সামান্য বৃষ্টিতেই নগরী তলিয়ে যায় পানির নিচে। এর বাইরে আছে ছিনতাই, সরকারি সম্পত্তি দখল করে মানুষের চলাচলে বিঘœ। এসব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে আগেই। নগরবিদরা এগুলোর সমাধানে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়সহ বিশেষ সরকারি উদ্যোগের সুপারিশ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু সে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ জন্য নগর সরকারের দাবি ওঠেছে নানা সময় সরকার দলের পক্ষ থেকেই। কিন্তু প্রধান দুই দল সরকারে থাকাকালে তাদের দল থেকে নির্বাচিত মেয়রের এই দাবি অগ্রাহ্য করেছে সরাসরি। আর এসবের বদৌলতে সমস্যাসংকুল নগরীর নাগরিক যন্ত্রণা উপসমের বদলে বেড়েই চলছে দিনে দিনে।

কিন্তু এবার বুঝি সব সমস্যার অবসান হতে চলেছে। অন্তত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের নির্বাচনী অঙ্গীকার বিবেচনায় আনলে সেটিই মনে হবে। সর্বরোগ অবসানের মতো করেই নগরীর সব সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার করছেন প্রার্থীরা। যেসব সমস্যার সমাধান হয়নি চার দশকে যেন তাদের ভোট দিলেই সেগুলোর সমাধান করে ফেলবেন তারা পাঁচ বছরেই। অথচ এসব সমস্যার সমাধানে ক্ষমতা বা এখতিয়ার আদৌ মেয়র বা কাউন্সিলর প্রার্থীদের আছে কি না সে প্রশ্নটির ধারেকাছেও যেন যাচ্ছেন না কেউ। স্বপ্ন দেখিয়ে ভোট আদায়ই প্রাধান্য পাচ্ছে তাদের কাছে।

প্রার্থীদের কেউ স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ধূসর নগরকে সবুজে সবুজে ছেয়ে দেওয়ার, কেউ বলছেন নারীবান্ধব নগর গড়বেন তিনি, কেউ বলছেন দুর্নীতি দূর করবেন, কেউ আশ্বাস দিচ্ছেন পরিবেশের উন্নতির, জলাবদ্ধতা দূর করার, কেউ বা বলছেন, শিক্ষা বিস্তার করবেন তিনি, স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লব বইয়ে দেওয়ার কথাও বলছেন কেউ। এসেছে অধিবাসীদের নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারও।

বরাবরই একই চিত্র

প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তৈরি হয় এমন প্রত্যাশা। আর প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার আশায় বইয়ে দেয় প্রতিশ্রুতির বন্যা। ভোটাররাও সচরাচর বিবেচনা করেন না, তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি আদৌ নির্ধারিত সময়ে প্রার্থী বা দলের পক্ষে রাখা সম্ভব কি না। ভোটের পর নির্বাচিত প্রার্থীর কাছে যাওয়া হয় না ভোটারদের। আর দেখা যায় কয়দিন পর থেকেই কথা না রাখার অভিযোগ ওঠে নির্বাচিতদের বিরুদ্ধে।

বস্তুতপক্ষে ভোটের সময় প্রার্থীরাও ভুলে যান তাদের ক্ষমতার সীমারেখা। দিয়ে যান নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি। ২০১০ সালে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলম। পাঁচ বছরে তার প্রধান প্রতিশ্রুতি জলাবদ্ধতা নিরসনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন মনজুর। আগের তিন দফায় এই সমস্যার সমাধান দিতে তার পূর্বসূরি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীও। ২০ বছরে যে সমস্যার সমাধান হয়নি পাঁচ বছরেই তার সমাধানের অঙ্গীকার করেছেন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির। এবারও কি এটি শুধু প্রতিশ্রুতিই থেকে যাবে নাকি এর বাস্তবায়ন দেখতে পাবে চট্টগ্রামবাসী, এর জবাব দেবে সময়।

২০০৮ সালে খুলনা সিটি নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার আবদুল খালেক। পাঁচ বছরে তিনিও তার প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। নগরীর সড়ক উন্নয়ন হলেও নাগরিক আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিল ঘটেনি পুরোপুরি। ভোটের আগে খুলনার বন্ধ কল-কারখানাগুলো চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন খালেক। কিন্তু এই ক্ষমতা তার ছিল না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া যে কাজ করা সম্ভব নয়, সেটি করার আশ্বাস দিয়ে রাখতে পারেননি খালেক।

২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে এই পূরণ না হওয়া অঙ্গীকারের জন্য জবাবদিহি করতে হয় তালুকদার আবদুল খালেককে। অপ্রত্যাশিতভাবে বড় ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। এই নির্বাচনে জয়ী বিএনপি নেতা মনিরুজ্জামান মনিও ভোটের আগে ২১ দফার ইশতেহার ঘোষণা করেন। কিন্তু এক বছরে তার কিছুই করা হয়নি। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, ধীর গতিতে রাস্তা ও নালা সংস্কারে ক্ষোভ তৈরি করেছে নগরীতে। জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।

তালুকদার আবদুল খালেকের মতোই নিজের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে খালিশপুরে শিল্পাঞ্চল পুনরুজ্জীবনের পদক্ষেপ নেওয়া, শিল্প ও কলকারখানা স্থাপনে সহযোগিতা দেওয়া, শিক্ষার উন্নয়ন, সুন্দরবন রক্ষায় ভূমিকা নেওয়া, শিশু ও প্রবীণ এবং প্রতিবন্ধীদের সহায়তায় পরিকল্পনা নেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মেয়র মনিরুজ্জামান মনি।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগেও প্রতিশ্রুতির জোয়ারে নগরবাসীকে ভাসিয়েছিলেন বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তার ২০ দফা ইশতেহারের মধ্যে ছিল রাজশাহীর স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, রাজশাহীতে একটি আইটি ভিলেজ গড়া, একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং খেলাধুলার মান বৃদ্ধিতে বিকেএসপির শাখা খোলা। কিন্তু এর কোনোটির কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি গত এক বছরে। আসলে এই বিষয়ে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নেওয়ার কোনো এখতিয়ারই নেই।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে বিজয়ী আরিফুল হক চৌধুরী দিয়েছিলেন ১১ দফা ইশতেহার।  এর মধ্যে আছে সাইবার সিটি গড়ে তোলা, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট স্থাপন করা।



সর্বরোগের ওষুধ আছে তাদের কাছে!

কয়দিন পরেই ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচারণা। জাতীয় নির্বাচনের ঢঙে নগরের নানা সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলোর প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেছেন মেয়র প্রার্থীরা।

তবে ইশতেহারের বেশিরভাগই সিটি করপোরেশন আইনে বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রচলিত আইনের সংশোধন ও নগর সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমেই কেবল প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব।

মোটামুটি সবার ইশতেহারে ঢাকাকে বাসযোগ্য, নিরাপদ, যানজটমুক্ত, পরিচ্ছন্ন করে গড়ে তোলার বিষয়টি উঠে এসেছে। ঢাকাকে উন্নত বিশ্বের আধুনিক শহরের মতো করে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে তাতে। সব প্রার্থীই চাচ্ছেন প্রতিশ্রুতির দিক দিয়ে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে। কিন্তু ইশতেহারে এমন কিছু প্রতিশ্রুতির বিষয় উঠে এসেছে যা কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব।

ঢাকা দক্ষিণে এক মেয়র প্রার্থীর ইশতেহারে বলা হয়েছে ঢাকাকে আধুনিক, উন্নত ও বিশ্বমানের মহানগর গড়ে তুলবেন তিনি। তার ইশতেহারে অগ্রাধিকার দেওয়া পাঁচটি বিষয় হলো : ১. যানজট নিরসন, ২. পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সেবা নিশ্চিত করা, ৩. দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গা, ৪. পরিচ্ছন্ন, দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর মহানগরী প্রতিষ্ঠা এবং ৫. দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং নাগরিকদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা।

আরো অসংখ্য প্রতিশ্রুতি আছে এই নির্বাচনী ইশতিহারে। এর মধ্যে আছে ডিজিটাল মহানগরী তৈরি, সবার জন্য নিরাপত্তা সৃষ্টি, বস্তি উন্নয়ন ও হরিজন সম্প্রদায়ের মানবিক মর্যাদা ও সমতা সৃষ্টি, আবাসন সমস্যার জরুরি সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ, ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সন্ত্রাস প্রতিরোধ, ক্রীড়া ও চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্র তৈরি, ধর্মপালন ও সুশাসন নিশ্চিত করা।

ঢাকা উত্তরে সরকার সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী আনিসুল হক তার ইশতেহারে বলেছেন, নির্বাচিত হলে সবুজ, নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর ঢাকা মহানগরী উপহার দেবেন তিনি। সিটি করপোরেশনে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এর বাইরে ঢাকা থেকে শিল্প কারখানাকে সরিয়ে নেওয়ার মতো কথাও বলছেন তিনি।

তার ইশতেহারের নাম ‘সমস্যা চিহ্নিত’, ‘এবার সমাধান যাত্রা’। তিনি বাসযোগ্য ঢাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বায়ু দূষণ, নারীর নিরাপত্তাহীনতা, পরিবহন, স্বাস্থ্য ও বিনোদন সমস্যা চিহ্নিত করে এসব সমস্যা সমাধানের উপায়ও জানিয়েছেন আনিসুল হক।

তবে এই প্রার্থী জানেন, মেয়রকে ২৮ ধরনের কাজ করতে দেওয়া হলেও তার আইনি ক্ষমতার অভাব রয়েছে। নগরীতে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা মোট ৫৬টি সরকারি সংস্থার কাজ। এর বেশিরভাগই সিটি করপোরেশনের অধীনে। প্রায় সময়ই দেখা যায় সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতায় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে লেগে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই সড়ক কাটা হয় একাধিকবার। আবার বর্ষাকাল আসলেই শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। নগরবাসীর জীবনকে সহজ করার কথা বলে নেওয়া এ সব প্রকল্প এভাবেই ভোগান্তি বাড়ায় নাগরিকদের।

ঢাকা উত্তরের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল তার নির্বাচনী ইশতেহারে খাদ্যে ভেজাল রোধ, সুলভ খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিবহন, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়ন, বিনোদন, জনস্বাস্থ্য, ডিজিটাল সেবা, জননিরাপত্তা, দুর্যোগ মোকাবেলা, নগর প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ক্ষমতা আদৌ মেয়রের আছে কি না, ইশতেহার ঘোষণার সময়ই সে প্রশ্নের মুখে পড়েন তাবিথ আউয়াল। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমিও জানি সিটি করপোরেশন মেয়রের পক্ষে ইশতেহারের সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আমি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাদের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন যে পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তার মধ্যে আছে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা। অথচ সিটি করপোরেশনের বর্তমান আইনে এই তিন সেবার ক্ষমতা মেয়রকে দেওয়া হয়নি। রাজধানীতে সুপেয় পানি সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা, যা স্থানীয় সরকারের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি, যা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরেকটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডেসকো ও ডিপিডিসি নামের দুটি সংস্থার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

সাঈদ খোকন ঢাকার পানি নিষ্কাশন ও নালা ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকীকরণ ও এই ব্যবস্থাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। আরও দিয়েছেন দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও নাগরিকের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করারও অঙ্গীকার।

আর ঢাকা দক্ষিণের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে তার স্ত্রী ১০ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে আছে নাগরিক সেবা, নাগরিক বিনোদন, যানজট নিরসন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা খাত, পরিবেশ উন্নয়ন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তির ঢাকা, সমাজসেবা, জননিরাপত্তা, নগর পরিকল্পনা ও সুশাসন নিশ্চিত করা।

মেয়র প্রার্থীরা এভাবে সব সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার যে করছেন তাকে অবশ্য খারাপভাবে দেখতে নারাজ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকে যানজটমুক্ত, নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন নগর উপহার দেওয়ার কথা বলেছেন। প্রচলিত আইনে যদি তাদের এ সব বিষয়ে কিছু করার না থাকে তাহলে অবশ্যই আইন পরিবর্তন বা সংশোধনের দাবি তাদেরকেই তুলতে হবে।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মেয়রের কী ক্ষমতা আছে সেটা বড় বিষয় নয়। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারা জনগণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন সেটাই বড় বিষয়। এখন তারা নির্বাচিত হলে সরকারকে চাপ দিতে হবে।’

এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ চাপ দেওয়ার কথা বললেও অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মেয়ররা কোনো বিষয়ে জোর দাবি তুললেও মনঃপূত না হলে তা বিবেচনাতেই নেয়নি সরকার। ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে নগর সরকারের দাবি তুলেছিলেন। বলেছিলেন, নাগরিক সেবার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই সরকারের অধীনে দিতে হবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সে সময়ের মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরীও একই দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু সরকার অগ্রাহ্য করেছে দাবি। তখন বিরোধী দলে থাকা বিএনপি নেতারাও এই দাবির পক্ষেই কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন এই নগর সরকার প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে তারাও।    

২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনে চট্টগ্রামের সমস্যা চিহ্নিত করে ৫২ দফা ইশতেহার দিয়েছিলেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম। কিন্তু এর মধ্যে মূল অঙ্গীকার জলাবদ্ধতার সমাধান পাঁচ বছরে তিনি করতে পারেননি এতটুকু। এই নির্বাচনের আগেও জলাবদ্ধতাসহ ৫৪ দফা অঙ্গীকার করেছেন মনজুর আলম।

আগের মূল অঙ্গীকার জলাবদ্ধতার সমস্যার সমাধান না হওয়ার জন্য ইশতেহার প্রকাশের দিন মনজুর আলম দাবি করেন, কর্ণফুলী নদী খনন না হওয়ায় পূর্ণ সাফল্য পাননি তিনি। আর এই খননের ক্ষমতা তার নেই। আবার পাস করতে পারলে এই নদী খননে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার অঙ্গীকার করেছেন তিনি।  

এভাবে প্রতিশ্রুতি দিলেও স্বভাবতই তা পালন করতে পারেন না। বারবার দেখা গেছে প্রতিশ্রুতি পালন না হলে পরের নির্বাচনে যেমন সেই প্রার্থী হেরে যান, তেমনি রাজনৈতিক নেতা এবং তার দলও পরে সমস্যায়। রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতি রাখেন না এমন একটা কথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমাজে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলেন, ভোটের আগে বাড়িয়ে বলা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এ জন্য ভোটারদেরও দায় আছে বলে মনে করেন তিনি। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো প্রার্থী যদি যানজট নিরসনের কথা না বলেন, তাহলে ভোটাররা ভাববেন এ বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই, আর এ কারণে হয়ত ভোট কম পাবে ওই প্রার্থী। তাই ক্ষমতা থাকুক আর না থাকুক ভোটারদের মূল চাওয়া-পাওয়া নিয়ে নির্বাচনের আগে বলতেই হবে প্রার্থীদের।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান স্বীকার করেন, ভোটের আগে এভাবে বাড়িয়ে বলা উচিত নয় প্রার্থীদের। কিন্তু জনগণ সারা বছর তাদের সব সমস্যার কথা যেহেতু কারও কাছে বলার সুযোগ পায় না, তাই নির্বাচন আসলেই এসব বিষয়ে প্রার্থীদের কাছে অঙ্গীকার চায়। আর প্রার্থীরাও বিষয়টি বুঝতে পেরে কাজ করার আশ্বাস দেয়।  

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবীব বলেন, ‘আমাদের সিটি করপোরেশনের কোনো ক্ষমতা আমরা দেখি না। কারণ সড়কের ধারে বাতি লাগানো আর জ্বালানোর ক্ষমতা থাকলেও ল্যাম্পপোস্টটা পরিবর্তন করতে হলে করবে ডিপিডিসি, না হয় ডেসকো। তাহলে মেয়র কীভাবে বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করবে?’

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘মেয়রকে নগর পিতা বলা হলেও নগরের শাসন তিনি একা করেন না। এর মধ্যে তো রাজউক পিতা, ওয়াসা পিতা, ডেসকো পিতা রয়েছে। নগর পিতা রাস্তা বানায় আর ওয়াসা পিতা এসে তা খুঁড়ে রাখে।’ তিনি বলেন, ‘প্রার্থীরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন জনগণও মনে করেন এগুলো তাদের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নগর সরকার গঠন করা ছাড়া কোনো মেয়রই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।’- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।