জিলহজের প্রথম দশকের ফজিলত ও আমল
মাওলানা আহমাদুল্লাহ
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১৮:৪৭:৫৬

রমজানের পর দীর্ঘমেয়াদী গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মৌসুম হলো জিলহজের প্রথম ১০ দিন। বছরের যেকোনো দিনসমূহের চেয়ে এই দিনগুলো শ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহর নিকট প্রিয়। মুসনাদে বাযযার ও সহীহ ইবনে হিব্বানে সাহাবী হজরত জাবের রা. হতে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম দিনসমূহ হলো এই দশক। অর্থাৎ জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন। স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা এই মাসের প্রথম দশটি রাতের শপথ করেছেন, এমনকি ভিন্ন ভিন্নভাবে জোড় ও বেজোড় রাতসমূহের শপথও করেছেন। (সুরাতুল ফাজর, আয়াত ২-৩)
সুরাতুল হজ এর ২৮নং আয়াতে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহর নামের স্মরণ করে নির্দিষ্ট দিনসমূহে। সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, নির্দিষ্ট দিন বলে এখানে জিলহজের প্রথম দশককে বোঝানো হয়েছে।–ইবনে কাছীর।
বোখারির বর্ণনামতে রাসুল সা. বলেছেন, ভালো আমলের জন্য আল্লাহর নিকট এই দিনগুলোর চেয়ে প্রিয় কোনো দিন নেই। সাহাবারা প্রশ্ন করলেন- এমনকি আল্লাহর রাহে জিহাদও এই দিনসমূহের ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়? জবাবে ইরশাদ হলো- না, অন্য সময়ে আল্লাহর রাহে জিহাদও এই দশকের ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। অবশ্য যে ব্যক্তি জান ও মাল নিয়ে আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে বের হয়েছেন এবং তার কোনটি নিয়েই ফিরতে পারেননি, তার কথা ভিন্ন।
বিশ্ববিখ্যাত হাদীসবেত্তা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন-জিলহজের প্রথম দশটি দিনের বিশেষ গুরুত্বের কারণ হলো, এই দিনগুলোতে ইসলামের পাঁচটি রোকনের সমাহার রয়েছে। যেমন ঈমান ও সালাত অন্য দিনগুলোর মতো এদিনগুলোতেও বিদ্যমান। জাকাত বছরের অন্য যেকোনো সময়ের মতো এসময়েও প্রদান করা যায়। আরাফার দিনে রোজার নির্দেশনার ফলে ইসলামের আরেকটি রোকন- রোজারও নজির এই দশকে পাওয়া যায়। আর পঞ্চম রোকন বা হজও কোরবানির বিধান তো কেবল এই দশকেই পালনযোগ্য। তাছাড়া এই দশকেই রয়েছে আরাফা ও কোরবানির দিন, আরাফার দিনের দোয়াকে শ্রেষ্ঠ দোয়া বলা হয়েছে। আর কোরবানির দিনকেও বছরের সেরা দিন বলে আবু দাঊদ ও নাসাঈর এক হাদীসে বর্ণিত আছে। সুতরাং মাস হিসেবে রমজান আর দিন হিসেবে এই দশক শ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ। একজন মুসলিমকে তাই ইবাদতের এই বৃহত্তর সিজনের সদ্ব্যবহার করে অন্য সময়ের আমলের ঘাটতি পূরণ করার জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত। আক্ষেপের বিষয়, কোরআন ও সুন্নাহয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া এই ইবাদতের সিজন সম্পর্কে আমাদের সমাজে খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষ ধারণা রাখেন।
জিলহজের প্রথম দশকের ১০টি আমল: (১) সামর্থ্যবান হলে হজ করা। -সুরাতু আলি ইমরান ৯৭ (২) কোরবানি করা।–সুরাতুল কাউসার-তিরমিযী (৩)অধিক পরিমাণে আল্লাহর নামের জিকির করা।–সুরা হজ ২৮। উক্ত আয়াতে নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নামের জিকির করার কথা বর্ণিত হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ তাফসীরবিদ উলামায়ে কেরামের অভিমত হলো- ‘নির্দিষ্ট দিনসমূহ’ বলতে জিলহজের প্রথম দশ দিনকে বোঝানো হয়েছে।
(৪) অধিক পরিমাণে নেক আমল করা। -বোখারি মুসলিম (৫) পাপের পথ না মাড়ানো।–প্রাগুক্ত (৬) কোরবানিচ্ছুক ব্যক্তি এই দশদিন নখ চুল ইত্যাদি কর্তন না করা।–মুসলিম (৭) বেশি বেশি তাকবির তাহমিদ ও তাহলিল পাঠ করা-যথা আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।–আবু দাউদ (৮) আরাফার দিন ফজর হতে আইয়ামে তাশরিকে (ঈদের দিন ও তার পরে আরো তিন দিন) প্রতি নামাজের পর উক্ত তাকবির পাঠ করা।–প্রাগুক্ত (৯) আরাফার দিনে রোজা রাখা।
সহীহ মুসলিমের এক বর্ণনায় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-আরাফার দিনের রোজার ব্যপারে আমি মনে করি, তার বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা এক বছর পূর্বের ও এক বছর পরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। আরাফার দিন ছাড়াও ঈদের দিন ছাড়া প্রথম দশকের বাকি দিনগুলোতেও রোজা রাখাকে মুস্তাহাব বলেছেন ইমাম নববী রহ.। কেননা নফল রোজাও নেক আমলের শামিল। আর হাদিসে এই দশকে সাধারণভাবে নেক আমলের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য হাদীসে স্বতন্ত্র নির্দেশ থাকায় আরাফার দিনের রোযা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
(১০) ঈদের দিনের যাবতীয় সুন্নাতসমূহ পালনে সচেষ্ট হওয়া। রমজান মাস ইবাদতের সিজন, এ বিষয়টি মোটামুটি আমাদের সমাজের সবাই জানেন। কিন্তু জিলহজের প্রথম দশকের গুরুত্ব-তাৎপর্য সম্পর্কে সমাজের বেশির ভাগ লোক জানে না। সম্মানিত পাঠক, জিলহজ তো কতবারই এসেছে জীবনে। আপনার জীবনের একটি জিলহজেও কি কুরআন-হাদিসে বর্ণিত উপরোল্লিখিত গুরুত্বারোপের ছাপ পড়েছে? উত্তর না-বাচক হলে এই জিলহজটি আপনার জন্য সুবর্ণ সুযোগ। কে জানে আগামী জিলহজ আপনার বরাতে আছে কিনা! আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের সব উপায় অবলম্বনের তাওফিক দান করুন।
লেখক: সৌদি আরবের দাম্মামে দাওয়াহ সেন্টারে কর্মরত