রংপুর: শিক্ষার নগরী বলে খ্যাত রংপুরে চলছে কোচিং বাণিজ্য। এই কোচিং ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন থেকে চলা বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের গোমর ফাঁস হয়েছে। তৎপর হয়ে উঠেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত এবং শিক্ষার্থীদের সাথে লাখ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে তিন চিকিৎসক, তিন কোচিং শিক্ষক এবং এক কোচিং সেন্টারের এমডিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১৩।
গত শনিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত রংপুর বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।
এদিকে, র্যাবের এই আটক অভিযানে অন্য কোচিং সেন্টারের মালিকরা অনেকটা গা ঢাকা দিয়েছেন।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্র বলছে, রংপুরে মেডিকেল কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে বাণিজ্যে এগিয়ে আছে ছাত্রশিবির নিয়ন্ত্রিত রেটিনা কোচিং সেন্টার। এরা নগরীর ধাপ এলাকায় নিজস্ব সম্পত্তির উপর ৬ তলা ভবন বানিয়ে এ ব্যবসা চালিয়ে আসছে।
এরপরের অবস্থানে রয়েছে প্রাইমেট মেডিকেল ভর্তি কোচিং। এই কোচিং সেন্টারের এমডি মঞ্জুরুল রশিদকে আটক করেছে র্যাব। এ ছাড়াও ডক্টরস, মেরিট, ইউনিকেয়ারসহ নামে বে-নামে ১৩টি মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে মেডিকেল ভর্তি হোম টিচিং নামের আরেক বাণিজ্য।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্য মতে, এই কোচিং সেন্টারের কর্তা ব্যক্তিরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে নানাভাবে জড়িত। সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে দুই চারজনকে মেডিকেলে চান্স পাইয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
শুধু মেডিকেল কোচিং সেন্টারই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টারগুলোরও প্রায় একই অবস্থা।
র্যাবের দাবি, এবারের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র দেয়ার নাম করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১২/১৫ লাখ টাকা করে নেয়া হয়েছে। রংপুরে পরীক্ষার আগের দিন ধাপ এলাকার ডা. মোন্নাফ আলীর বাড়িতে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেখানে প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষায় পাস করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
এই সূত্র ধরেই প্রথমে লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার কাশিরাম গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে রংপুর মেডিকেলের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. শরিফুল ইসলাম অন্তুকে আটক করা হয়। তার স্বীকারোক্তিনুযায়ী ধাপের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে রংপুর মহানগরীর উত্তর সোনাকুড়ি সরকারপাড়া এলাকার ইউনুস আলী সরকারের ছেলে রংপুর মেডিকেলের সার্জারি বিভাগের সহকারী চিকিৎসক ডা. জিল্লুর হাসান রনি, রংপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিসার ডা. মোস্তাফিজার রহমান পাভেল, ধাপ পট্টিপাড়ার এলাকার আব্দুল কাদেরের ছেলে প্রাইমেট মেডিকেল কোচিংয়ের এমডি মনজুর রহমান, মিঠাপুর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের গোলজার হোসেনের ছেলে এ ওয়ান মেডিকেল কোচিংয়ের শিক্ষক আদিলুর রহমান আদিল, একই উপজেলার মুরারীপুর গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে এ ওয়ান কোচিং সেন্টারের শিক্ষক জামিল উদ্দিন ও কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ির উপজেলার নাগদহ গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে সাজরাতুল ইয়াক্কি রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
স্থানীয় সূত্র বলছে, রংপুরে যেসব মেডিকেল কোচিং সেন্টার রয়েছে এর মধ্যে এ-ওয়ান কোচিং সেন্টার একেবারেই নতুন। এর আগে কখনও এই নাম শোনা যায়নি। তাদের ধারণা প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রটি হয়তো এই কোচিং ব্যবসায় বসেছে।
জানা গেছে, উচ্চশিক্ষায় ভর্তিকে কেন্দ্র করে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কোচিং সেন্টারগুলো তিন মাসেই কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব কোচিং সেন্টারে না আছে শিক্ষার মান, না আছে পড়াশোনার অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। এরপরও তারা চালিয়ে যাচ্ছে রমরমা বাণিজ্য। স্কুল-কলেজের কোচিং বন্ধে সরকারের দায়সারা পদক্ষেপ দেখা গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিক্যালে ভর্তি কোচিং বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার। ফলে প্রতিবছর গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন কোচিং সেন্টার। বেরিয়ে আসছে জালিয়াতের নানা তথ্য।
সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে কোচিং করতেই হবে-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এমন মানসিকতার কারণেও বেড়ে চলেছে এই কোচিং বাণিজ্য। বর্তমানে ইউসিসি, প্যারাগন, ইউনিএইড, ইউনিএইড মনির, আইকন প্লাস, সংশপ্তক, থ্রি ডক্টরস, য়েজ, ওমেকা, আইকন, মেডিকো, প্রাইমেট, সানরাইজ, রেটিনা, ভার্সিটি, পজিট্রন, সাইফুরস, ফোকাস, অ্যাডমিশন প্লাস ও উদ্ভাসসহ অর্ধশতাধিক কোচিং সেন্টার এই রমরমা বাণিজ্য করছে। এগুলো ভর্তি মৌসুমের তিন মাসেই এই বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, কয়েকটি কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধ এরই মধ্যে প্রশ্ন ফাঁসসহ পরীক্ষা কেন্দ্রে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতা করার অভিযোগও রয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যালে ভর্তিকে সামনে রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো ভর্তি ফি আদায় করে থাকে এসব প্রতিষ্ঠান। একই ভর্তি কোচিং নিয়ে কোনোটি আদায় করছে ১০ হাজার, আবার কোনোটি ১২ হাজার টাকা।
অভিযোগ আছে, কোচিং সেন্টারগুলো ভর্তির চান্স পেয়েছে-এমন শিক্ষার্থীদের টাকা দিয়ে কিংবা অনেক সময় বাসায় মিষ্টি নিয়ে গিয়ে ছবি তুলে এনে প্রকাশ করছে। কয়েকটি কোচিং সেন্টারের প্রসপেক্টাসে হিসাব করে দেখা যাবে, দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যত আসন নেই তার চেয়ে বহুগুণে চান্স পেয়েছে।
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ ঢাকাটাইমসকে জানান, নামে-বেনামে এই কোচিং সেন্টারগুলো আমাদের মেধাবীদের নানাভাবে নষ্ট করছে। অভিযোগ আছে বিভিন্ন অনিয়মের। তাই তিনি এসব কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তোলেন।
র্যাব-১৩ রংপুর ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর আশরাফ ঢাকাটাইমসকে জানান, আমাদের কাছে অনেক তথ্য আছে কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে। আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব।
(ঢাকাটাইমস/২৩সেপ্টেম্বর/আরআই/জেবি)