যুক্তরাজ্য সফর শেষে দুই মাস পর দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। চিকিৎসার জন্য সে দেশে যাওয়ার কথা জানালেও রাজনৈতিক দিক থেকেও সফরটি বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন দলটির নেতা-কর্মীরা। বিশেষ করে বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা খালেদা জিয়ারই বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে দলের কৌশল ও অবস্থান নিয়ে আলোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ‘বার্তা’ নিয়েই খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন এমন কথা বলাবলি হচ্ছিল বিএনপিতে। স্বভাবতই নেত্রী ফেরার পর দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিশেষ দিক-নির্দেশনার অপেক্ষায় শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর রাজনৈতিকভাবে গত প্রায় দুই বছর বলতে গেলে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে দেশের অন্যতম প্রধান দলটি। বিশেষ করে সরকার পতনের আন্দোলনে দুই দফায় নজিরবিহীন নাশকতার পর মামলার কারণে নিষ্ক্রিয় শীর্ষ থেকে তৃণমূলের নেতৃত্বের একটি বড় অংশ। এই অবস্থায় দল পুনর্গঠন না করে আন্দোলনে না যাওয়ার মতো নজিরবিহীন ঘোষণাও এসেছে বিএনপি থেকে। স্বভাবতই আন্দোলনে ‘ব্যর্থ’ বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি পাত্তাই পাচ্ছেন না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে। এমনকি বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব বলতে গেলে উড়িয়ে দিয়েছেন সরকার দলের নেতারা। ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও দশম সংসদ নির্বাচনের মতোই শেখ হাসিনার অধীনে হবে সে ঘোষণাও দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দৃশ্যত সরকার দলকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো কৌশল এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি বিএনপি।
এই অবস্থায় আবার ঘোষণা এসেছে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের। ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা হয়েছে। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে দলের অবস্থান কী হবে, দল পুনর্গঠনই বা কীভাবে হবে, এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ও নির্দেশনার অপেক্ষায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর গুলশানে নিজ কার্যালয়ে আগের মতোই যাতায়াত শুরু করেছেন। দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এক দফা আনুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়েছে। এসব আলোচনায় কী প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে, সিদ্ধান্তই বা কী এসেছে, তা জানতে মুখিয়ে আছে কর্মীরা।
গত মঙ্গলবার রাতে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে গিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল কর্মী ফয়েজ। ফয়েজ বললেন, ‘অনেকদিন পর ম্যাডাম দেশে আসছেন। এতদিন তারেক রহমানের কাছে ছিলেন। নিশ্চয়ই দলের জন্য ভালো কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখানে না আসলে জানব কেমনে।’ ফয়েজের মতোই বিএনপি নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, চিকিৎসার পাশাপাশি ছেলের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় কী আলোচনা করেছেন খালেদা জিয়া।
কী বার্তা নিয়ে এসেছেন খালেদা
দলের দুর্দিনে আশান্বিত হওয়ার মতো কিছু একটা শোনার অপেক্ষায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ফেরায় সহসাই কৌশল পাল্টে নতুন কিছু করার নির্দেশনার আশায় তারা। আগামীতে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল কী হবে? মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবেন? দল পুনর্গঠনে কী নতুন কোনো চমক থাকছে? আগামীতে দল পরিচালনায় দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভূমিকাই বা কী হবে? দলের জাতীয় সম্মেলন (কাউন্সিল) হবে কি না? মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারমুক্ত হচ্ছেন কি না? তবে একটি বার্তা এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা।
দলীয় প্রতীকে ভোটের বিরোধিতা করলেও পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের ইতিবাচক মতোভাবের বার্তা পৌঁছে গেছে তাদের কাছে। তবে অন্য জিজ্ঞাসাগুলোর বিষয়ে এখনো অন্ধকারে কর্মীরা। কারণ খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে স্পষ্ট করে এখনো শীর্ষ নেতারা কিছু বলছেন না। নেতারা বলছেন, সবেমাত্র দেশে ফিরেছেন চেয়ারপারসন। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি দূর হয়নি এখনো। আর সব বিষয়ে বিস্তারিতভাবে কথা হয়নি। সব প্রশ্নের জবাব একসঙ্গে পাওয়া যাবে, এমনটাও নয়। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুক বলেন, ‘এখনো চেয়ারপারসনের সঙ্গে সব বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়নি। হলে নিশ্চয় কিছু না কিছু জানাতে পারব। তবে নিশ্চয়ই দলের সার্বিক বিষয় নিয়ে দুই শীর্ষ নেতা (খালেদা জিয়া ও তারেক) কথা বলেছেন।’
গত ১৫ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান খালেদা জিয়া। ফেরেন ২১ নভেম্বর। লন্ডনে থাকাকালে গোটা সময় তিনি তারেক রহমান ও প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটিয়েছেন।
সফরের শুরুর দিকে লন্ডন বিএনপির নেতারা সাক্ষাতের সুযোগ পেলেও পরে তারেক রহমানের নির্দেশনার বাইরে কেউ সুযোগ পাননি। এর মধ্যে কেবল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন খালেদা জিয়া। এছাড়া নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, বিদেশি ও প্রকাশক হত্যার পর নিন্দা জানিয়ে তার পক্ষ থেকে একাধিক বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। শুরুর দিকে দ্রুত সময়ে চিকিৎসা নিয়ে খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন এমনটা বলা হলেও পরে দফায় দফায় পেছানো হয় তার দেশে ফেরার তারিখ। একাধিকবার বিমানের বুকিং দেওয়া হলেও তা বাতিল করা হয়।
এর মধ্যে হঠাৎ বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশের ক্রান্তিকাল ও সংকটের কথা চিন্তা করে চিকিৎসা শেষ না করেই চেয়ারপারসন দেশে ফিরছেন। আর ২১ নভেম্বর ঢাকায় নামেন খালেদা জিয়া। তার দেশে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর করা হয় মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-িত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায়।
ধীরে চল নীতিতে বিএনপি
দলের বিভিন্ন সূত্রের খবর বলছে, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি সাংগঠনিক অবস্থা, জাতীয় সম্মেলনসহ দলের নানা বিষয় নিয়ে তাদের ছেলের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেছেন খালেদা জিয়া। এর পাশাপাশি দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ও সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে মা-ছেলের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। দুর্নীতির মামলায় সাজা হলে বা অন্য কোনো কারণে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনার বিষয় নিয়েও কথা হয়েছে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে। নিষ্ক্রিয় নেতা-কর্মীদের সক্রিয় করার কৌশল নিয়েও কথাবার্তা হয় দুজনের মধ্যে। দলের সাংগঠনিক পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক কর্মসূচি অল্প সময়ের মধ্যেই স্পষ্ট হবে বলে আশা করছেন নেতা-কর্মীরা।
বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনে কৌশলগত ভুল ছিল। আবার দল পুনর্গঠন না করেই নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে হঠাৎ ‘চূড়ান্ত আন্দোলনে’ যাওয়ার ঘোষণার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করা ঠিক হয়নি। এই বিবেচনায় এবার ভেবে-চিন্তে এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েই আগাবে বিএনপি। তবে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত দ্রুতই হতে পারে। যেমন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করার ব্যাপারে তারেক রহমানেরও সমর্থন পেয়েছেন খালেদা জিয়া। এ ছাড়া দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি থেকে বেশ কয়েকজন প্রবীণ নেতাকে বাদ নিয়ে নতুন মুখ আনার ব্যাপারেও তারা একমত হয়েছেন। একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিভিন্ন মহানগর, জেলাসহ সর্বস্তরের দলের পুনর্গঠিত কমিটিতে তুলনামূলক তরুণ, ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের আনারও সিদ্ধান্তও হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হবে ধীরে ধীরে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপিকে এখন বেশ কয়েকটি বিষয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশেষ করে সাংগঠনিক পুনর্গঠন, জাতীয় সম্মেলন, ৫ জানুয়ারি সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিকে ঘিরে কর্মসূচি প্রণয়ন এবং পৌরসভা নির্বাচনে প্রচারের কৌশল নির্ধারণ। তবে দল পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক গ্রেপ্তার অভিযান বাধা বলে মনে করে বিএনপি। নাশকতার হাজারো মামলার হুলিয়া জারি থাকায় মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা দিশেহারা। পৌরসভা নির্বাচনে গেলে তারা দলের প্রার্থীদের পক্ষে নামতে পারবেন কি না, প্রার্থীরাই বা প্রচারে থাকতে পারবেন কি না সেসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা থাকলেও জবাব নেই কারও কাছে।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, দল গোছানোই এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য। আপাতত বড় কোনো কর্মসূচিতে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দল ও জোটকে যার যার অবস্থান থেকে শক্তিশালী করার বার্তা আসতে পারে। সরকারবিরোধী জনমত সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পেশাজীবী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন খালেদা জিয়া। বুধবার রাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অপ্রগতি সম্পর্কে দলের প্রধানকে অবহিত করেন তিনি। কার্যক্রম চালাতে গিয়ে কোথায় কোথায় তিনি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, সে বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে।
সূত্র মতে, পুনর্গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্তরা একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেছেন। এতে বলা হয়েছে, দলের প্রভাবশালী নেতাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের প্রায় ২০টি জেলায় কেন্দ্রের নির্দেশ দেওয়ার পরও পুনর্গঠনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই এসব জেলার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের নেতারা নিশ্চিত করেছেন, দলের পর জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন খালেদা জিয়া। পরে লন্ডন সফরসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে শিগগিরই সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন তিনি। তাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐক্য গড়ার আহ্বানও জানাতে পারেন বিএনপি নেত্রী।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশকে গভীর সংকট থেকে উত্তরণে খালেদা জিয়া আবারও জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানাবেন। একই সঙ্গে দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানাবেন। পাশাপাশি দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতেও তিনি ভূমিকা রাখবেন।’- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।