চাকরির পাশাপাশি ই-কমার্সে হাত পাকাচ্ছেন তমা। বছর খানেক হল ব্যবসা শুরু করেছেন। খুব বেশি পুঁজি নেই, ফেসবুকে খোলা একটি পেইজের মাধ্যমেও চলে বিকিকিনি। পেইজটিতে লাইক পড়েছে প্রায় দু লাখ। এক বছরের মাথায় এই পর্যায়ে আসা অবশ্য এমনি এমনি নয়। ডলার খরচ করে পেইজটির বিজ্ঞাপণ চালিয়েছেন দিনের পর দিন। লাইক এসেছে একইভাবে। শাড়ি, থ্রি-পিছসহ মেয়েদের অত্যাধুনিক পোশাকের সমাহারও ছিল পেইজটিতে। ছবির সঙ্গে জুড়ে দেয়া দাম। তার নিচে দেয়া মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করে অর্ডার দিলে ক্রেতার ঠিকানায় পৌঁছে যেতো পণ্য। ছোটো একটি চাকরির পাশাপাশি এই ব্যবসা থেকে যা আয় হতো তা দিয়ে পরিবারের ভালই চলতো। তমার ছোটেভাই এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকায়নি। একসময় হন্যে পার্টটাইম জব খোঁজা শ্যামল এখন বোনের ই-কমার্সে সময় দিচ্ছে। ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী পণ্য ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার মূল দায়িত্বটাই পালন করতো সে। কিন্তু গত দশ দিনে আবারও বেকার সময় কাটছে তার। বোনটিরও মন ভাল নেই। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে তমাদের ভার্চুয়াল স্টোরও। বন্ধ বিকিকিনি।
তমার ভাষায়, ‘ব্যবসা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। লাভও যা হচ্ছিল খুব বেশি নয়। যে কারণে নিজস্ব কোনো ওয়েবসাইট করে নেয়ার অবস্থা তৈরি হয়নি। কে জানতো এমন করে হঠাৎ বন্ধ হবে ফেসবুক? তা না হলে বিকল্প কিছু চিন্তা করা যেতো।’
তমার মতো এমন প্রায় কয়েকশ উদ্যোক্তা আছেন যাদের ব্যবসার মূল প্লাটফর্মই ছিল ফেসবুক। ওয়েবসাইট খোলার মত অবস্থা যাদের নেই ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীলতা তাদেরই বেশি। তাছাড়া ওয়েবসাইট যাদের আছে তাদেরও পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য ফেসবুকে আসতে হয়েছে। সেই হিসেবে, ই-কমার্সে মন দিয়েছেন এমন কেউ নেই যে, ফেসবুক বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি তাদের।
গত ১৮ নভেম্বর যুদ্ধপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর আচমকাই বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট, ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগের বেশ কয়েকটি মাধ্যম। ঘণ্টা খানেক বাদে ইন্টারনেট সেবা চালু হলেও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কবে খুলে দেয়া হবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্টরা। তবে শিগগির খুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কিছুদিনের মধ্যে হয়তোবা ফেসবুক খুলে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু হঠাৎ ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে ই-কমার্সসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর কর্মকাণ্ডে তা সহজে পুষিয়ে ওঠার মতো নয়।
অনেকটা ঠাট্টা করেই বলছিলেন একজন আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তা। বললেন, ‘হরতালে দোকানপাট বন্ধ থাকে। ক্ষতি হয় ব্যবসা বাণিজ্যের। একইভাবে অনলাইন জগতে হরতাল চলছে। ভার্চুয়াল স্টোর সব বন্ধ। ব্যবসা বাণিজ্য উঠেছে লাটে।’ তবে এড়িয়ে যাননি বিকল্প পথে ফেসবুকে ঢোকার বিষয়টি। ‘হরতালের মধ্যেও দু-চারটে দোকান-পাট খোলা থাকে। তবে তাদের মধ্যে থাকে আতঙ্ক। এখানেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বিকল্প পথে ঢোকার কারণে রাষ্ট্রের নজরদারির মধ্যে থাকতে হচ্ছে। না জানি আইসিটি আইন লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা, এই আতঙ্ক তো থাকছেই।’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ই-কমার্স একেবারে নতুন না হলেও খুব পুরোনো নয়। তবে ইদানিংকালে ধীরে ধীরে অনলাইন কেনাবেচা জনপ্রিয় হচ্ছে। ঘরে বসে কেনাকাটা যাচ্ছে। সময় বেঁচে যাচ্ছে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রয়োজন সেরে নেয়া যাচ্ছে, আঙুলের ছোঁয়ায়। এটা তো কম কিছু নয়। নগর জীবন, বিশেষ করে ঢাকাবাসীর জন্য উপযোগী অনলাইন কেনাকাটা। যদিও অনলাইন শপের ওপর পুরোপুরি আস্থাশীল হতে পারেননি ক্রেতারা। কারণ, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবসায় এসেছেন এমন লোকের পাশাপাশি ঠকবাজের সংখ্যাও এই কম নয়। অনলাইনে একটি পণ্য দেখালেও সরবরাহ করা হচ্ছে অন্যটি। পণ্যের গুণগত মান নিয়েও থাকে বড়সড় প্রশ্ন।
প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, প্রযুক্তিগত মেধা ও জ্ঞানে আমরা এখনও শৈশবই পার করতে পারিনি। যদিও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক বড় বড় কিছু অর্জন আছে। তবে সামগ্রিক বিচারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়েই আছি বৈকি। এমন উৎকর্ষের সময় যদি কদিন ইন্টারনেট সেবা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা বা বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে অনলাইন নির্ভর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর প্রমাণ মিলেছে গত ১৮ নভেম্বর ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমার অনলাইন নির্ভর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক ঘণ্টার আন্তর্জাতিক ব্ল্যাক আউটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে ব্যবহারকারী ও সেবা গ্রহণকারীকে।
জানতে চাইলে প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘সাইবার ক্রাইমের বিপরীতে নিরাপত্তার যে প্রশ্ন আসছে তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়ের অনেকেই সংশ্লিষ্ট। তবে এও ঠিক মাথা ব্যথা হবে বলে তা কেটে ফেলাও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।’ তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট সিকিউরিটি তো আজকের ইস্যু নয়। অনেক আগে থেকেই আমরা এনিয়ে কথা বলছি। উন্নত বিশ্বের মডেল এক্ষেত্রে আমরা কাজে লাগাতে পারি। অন্যরা যদি সাইবার ক্রাইম থেকে বেঁচে থাকার উপায় আয়ত্তে আনতে পারে, আমরা কেন পারবো না?’
বিকল্প পথে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারি
স্বাভাবিকভাবে ফেসবুকসহ অ্যাপসগুলোর ব্যবহার বন্ধ করে দেয়ায় বিপাকে পড়েছেন লাখ লাখ ব্যবহারকারী। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ২২ লাখ ১৯ হাজার। যার মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহাকারী ৫ কোটিরও বেশি। সেই হিসেবে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপস ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কম নয়। বন্ধ করে দেয়ায় বিপাকেই পড়তে হয়েছে ব্যবহারকারীদের। বিশেষ করে যাদের পেশাগত কিংবা বাণিজ্যিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল ফেসবুক তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোগান্তির কারণ। বাধ্য হয়ে অনেকে বিকল্প পথে (প্রক্সি) ফেসবুক ব্যবহার করছে। এই সংখ্যাও কম নয়। সরকারের দৃষ্টিতেও আছে বিষয়টি। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সাংবাদিকদের বলেছেন, বিকল্প পথে যারা ফেসবুক ব্যবহার করছেন তাদের ওপর সরকারের নজরদারি আছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম হওয়ায় তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখা সম্ভব হচ্ছে। এটাকে অপরাধ বলেও উল্লেখ করে করেছেন তিনি। তবে ইন্টারনেট নির্ভর কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িতদের বক্তব্য হচ্ছে, ফেসবুক বন্ধ করে দেয়ায় ই-কমার্স তথা অনলাইন বাণিজ্যের যে ক্ষতি হচ্ছে তা ক্ষতিপূরণ কে দেবে? বাধ্য হয়ে বিকল্প পথে ঢুকতে হচ্ছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কারো অ্যাকাউন্ট থেকে হচ্ছে কিনা সরকার তা নজরদারিতে আনতে পারে। যারা কারো কোনো ক্ষতি করছেন না তাদের অহেতুক হয়রানি করা ঠিক হবে না।
ফেসবুক ও অ্যাপস বন্ধের পেছনে...
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিপূর্বে উসকানিমূলক নানা তথ্য প্রচার করা হয়েছে। বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। অসত্য ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করে পরিস্থিতি ঠেলে দেয়া হয়েছে অস্থিতিশীলতার দিকে। মুঠোফোন যোগাযোগে নজরদারির কারণে মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে যোগাযোগ করে অপরাধী চক্র। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, অতীতের সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর পরই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। তাছাড়া গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে, জামায়াত নেতা মুজাহিদ এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়কে ঘিরে নাশকতার বড় ধরনের পরিকল্পনা ছিল। এই পরিকল্পনার একটি বড় অংশ ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ঘিরে। এখানে মুহূর্তেই মধ্যে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়ার সুযোগ থেকে যায়। যে কারণে, রায় ঘোষণার পর পরই বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট নির্ভর যোগাযোগের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় মাধ্যম। অপরাধ দমন করতে সরকারের উদ্যোগের ব্যাপারে দ্বিমত নেই প্রযুক্তিবিদদের। আপত্তি হচ্ছে, মাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেয়ায়। কারণ, নজরদারির মধ্যে রেখেও সম্ভব ছিল অপরাধ দমনে। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়ে আছে বড় প্রশ্ন।
ইভেন্ট ম্যানেজ ব্যবসাতেও ভাটা
ফেসবুক বন্ধ করে দেয়ায় বিপাকে পড়েছেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। যাদের ব্যবসা প্রসারের বড় ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। শীত মৌসুমে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিপাকে আছেন তারা। দিনের পর দিন এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকলে এর বিরূপ প্রভাব দীর্ঘদিন থাকবে বলেও আশঙ্কা করছেন ই-কমার্সের উদ্যোক্তারা। জানতে চাইলে ওখানেই ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাহিতুল ইসলাম বলেন, ‘ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বন্ধ থাকায় ই-কমার্স দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ, পণ্যের প্রচার ও প্রসারের অন্যতম মাধ্যম ছিল এটি। এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার আগে সরকারি পর্যায়ে বিষয়টি ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল।’
(ঢাকাটাইমস/২৭নভেম্বর/এফএইচ/এআর)