চট্টগ্রাম: মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির মুখে এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী)। বর্তমানে বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও চট্টগ্রাম তথা উত্তর চট্টগ্রামের জনপদে তার ব্যক্তিগত প্রতাপ দীর্ঘ দিনের। মাঝে করেছেন জাতীয় পার্টি, একবার খুলেছিলেন নিজের দলও। তাঁর পরিচিতির প্রধান উৎস কিন্তু তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী। যিনি ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন।
স্থানীয় বয়োজৈষ্ঠ্যদের মতে, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ফজলুল কাদের চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। এই অবদানকে পুঁজি করে রাজনীতিতে ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনের উত্থান এরশাদ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী হওয়ার মধ্য দিয়ে। এ সময় তাঁর রাজনীতির গণ্ডি ছিল শুধুমাত্র জন্মভূমি রাউজানে। সন্ত্রাসের জনপদ ছিল তখন এলাকাটি। বিশেষ করে তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট অনুসারীদের সাথে বন্দুকযুদ্ধ, মারামারি ও খুনোখুনি ছিল নিয়মিত ঘটনা। আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গেও তখন ঘটে প্রাণঘাতী নানা সহিংসতা।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী সন্ত্রাসীদের মধ্যে ফজল হক, কানা খুইশ্যা, বিধান বড়ুয়া ছিল অন্যরকম আতঙ্কের নাম। অপরদিকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছিল ইকবাল বাহিনী। এদের মধ্যে বিধান বড়ুয়া বর্তমানে কারাগারে থাকলেও ফজল হক বাহিনীর গুলিতে নিহত হন ইকবাল। ফজল হক পালিয়ে আছেন মধ্যপ্রাচ্যে।
মন্ত্রী হওয়ার পর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাজনীতি প্রসারিত হয় রাঙ্গুনিয়ায়। শুরুতে প্রতিপক্ষ ছিলেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। যাদের সাথে রাঙ্গুনিয়া কলেজে প্রায় বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটত তাঁর অনুসারীদের।
রাঙ্গুনিয়ায় আগ্নেয়াস্ত্রের প্রথম দর্শন ঘটে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীদের হাতে। যখন তখন সেখানে, সেখানে বোমাবাজি হতো তখন। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা যুবসংঘ নামে আজে-বাজে লোকের সংগঠন গড়ে তোলে শুরু হয় সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতন।
এদের মধ্যে আলাপ হয় কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাথে। তারা জানান, ওই সময় যুবসংঘের লোকজনই ছিল রাঙ্গুনিয়ার শাসক। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বাররা তখন সালিশ করতে পারত না। যুবসংঘই করত সালিশ-বিচার। যা ছিল একতরফা। থানা-পুলিশের সাহায্য চেয়েও যুবসংঘের হাতে নির্যাতিত মানুষ কোনো সহায়তা পেত না। বিচারের নামে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যানকে ধরে এনেও রোয়াজারহাটে টিন শেড ঘরের বিমে বেঁধে পিটিয়েছে এই যুব সংঘের নেতাকর্মীরা।
যার খেসারত দিতে হলো ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সভাপতি ও শ্রমিক নেতা মো. ইউসুপ নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে হারিয়ে দেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। অথচ আগের নির্বাচনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এই আসন থেকে জিতেছিলেন অনায়াসে।
তবে নির্বাচনের এই হারে বোধোদয় হয় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। এরশাদের পতন আসন্ন দেখে জাতীয় পার্টি ছেড়ে তখন চট্টগ্রামে এনডিপির রাজনীতি শুরু করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তাতে দমে আসে রাঙ্গুনিয়া যুবসংঘ। বন্ধ হয় অস্ত্রের ঝনঝনানি। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অনেকেই আওয়ামী লীগে ফিরে যায় তখন। যাদের নিয়ে ছাদেক চৌধুরীর নেতৃত্বে সংগঠিত হয় রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ।
পরে অবস্থা বেগতিক দেখে তখন বিএনপিতে যোগ দেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ধানের শীষ প্রতীকে আবারও সাংসদ নির্বাচিত হন ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তখন রাঙ্গুনিয়ায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছিলেন ছাদেক চৌধুরী। যিনি মাত্র পাঁচ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিলেন।
এরপর সন্ত্রাসের রাজনীতি থেকে দূরে সরতে থাকেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তবে শুরু করেন ছলনা আর কূট-কৌশলের। তারই অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের বর্তমান রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার কাদের নগরে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাড়ি। যেখানে বসে রাঙ্গুনিয়ার রাজনীতি করতেন তিনি।
বিএনপির সাংগঠনিক কাজ, অনুসারীদের নিয়ে ব্যক্তিগত বৈঠক, নির্বাচনী মেজবান থেকে শুরু করে রাঙ্গুনিয়ার সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতেন এই বাড়ি থেকেই। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাদেক চৌধুরীকে হারিয়ে আবারও রাঙ্গুনিয়া থেকে আবার সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। পরবর্তী সময়ে তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সাধারণ মানুষ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাছান মাহমুদের কাছে বিপুল ভোটে হারেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
আরও আগে জাতীয় পার্টি ছাড়ার পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে রাউজানেও শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেন বর্তমান সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরী। যার কাছে একাধিকবার নির্বাচনে হেরেছেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। ওই সময় রাউজানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে তিনি পৈত্রিক ভিটায় গড়ে তোলেন বাইতুল বিল্লাহ নামে এক বাড়ি।
আর চট্টগ্রাম মহানগরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া নগরীর গণি বেকারিস্থ গুডস হিলে গড়ে তোলা বাড়িতে বসে। যেখানে এখন কেউ নেই। দলীয় নেতাকর্মী তো দূরের কথা, পরিবারের কেউ থাকেন না গুডস হিল ও রাঙ্গুনিয়ার বাড়িতে। রাউজানের বাইতুল বিল্লাহও এখন ফাঁকা।
অথচ পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে এক সময় পরিবারের সদস্যদের সাথে এসব বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের আনাগোনাও ছিল রাজ পরিবারের মতো। দলীয় কর্মীদের উঠাবসায় তিল ঠাঁইও পাওয়া যেত না। সেই বাড়ি এখন ফাঁকা। সালাউদ্দিন ক দের চৌধুরী কারাগারে বন্দী হওয়ার পর থেকে ক্রমেই দূরে সরতে থাকে সুসময়ের স্বজন ও নেতাকর্মীরা।
অভিযোগ রয়েছে, ১৯৭১ সালে গুডস হিলের এই বাড়ি ছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্যাতন কেন্দ্র। এই বাড়ির চারপাশে সমাহিত আছেন অসংখ্য নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা। ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন ক দের চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এই গুডস হিলের বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয় র্যাব ও পুলিশ।
গত ১৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার গুডস হিলের এই বাড়িতে গিয়ে কয়েকজন র্যাব ও পুলিশ সদস্যকে প্রহরায় দেখা যায়। একজন র্যাব কর্মকর্তা জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে বাড়ির নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন তারা। এরপর থেকে গুডস হিলে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেয় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ পরিবারের সদস্যরা।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক আবু আহমেদ হাসনাত ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইউসুপ চৌধুরী এই সময়কে বলেন, ‘সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে বিএনপির রাজনীতি করি আমরা। এ সুবাদে গুডস হিল ও রাঙ্গুনিয়ায় গড়ে তোলা বাড়িতে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক কমসূচি পালন করি। কিন্তু ওনাকে গ্রেপ্তারের পর আর সেখানে যেতে পারি না। বাধার মুখে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালন করতে পারি না। অবশ্যই নেতা নেই হিসেবে যাওয়ার প্রয়োজনও যেন আর নেই’।
রাউজানে বাইতুল বিল্লাহ দেখা শোনা করেন তত্ত্বাবধায়ক ফরিদুল আলম। তিনি বলেন, ‘এই বাড়িতে ওনার পরিবারের কেউ থাকেন না’। গত বছর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুর পর লাশ দাফন করতে গিয়েও প্রতিপক্ষের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে বলেও জানান ফরিদুল।
রাঙ্গুনিয়ার বাড়ি দেখাশুনা করেন নুরুল আবছার নামে একজন। তিনি বলেন, ‘সাহেব জেলে যাওয়ার পর থেকে সাহেবের পরিবারের কেউ শুধু রাঙ্গুনিয়ার বাড়িতে নয়, রাউজান ও চট্টগ্রামের বাড়িতেও থাকেন না। তারা সবাই থাকেন ঢাকায়। ওখানে সাহেবের মামলার যাবতীয় কাজ ও ভালো-মন্দ দেখাশোনা করতে হয় তাদের’।
রাঙ্গুনিয়ায় বাড়িটি গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ৫০-৫৫ একর জমির ওপর। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন একর জমি কেনা। বাকিটা সরকারি বনভূমি বা স্থানীয়দের কাছ থেকে জবরদখল করা বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা।
জমি হারা ভুক্তভোগীদের একজন কোদালা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা কাইয়ুম চৌধুরী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর নিজের ও স্বজনদের জমি পুরনায় দখল নেন তিনি। এই সময়কে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আগে সাকা চৌধুরীর পিতা রাজার মত ঘোড়ায় চড়ে রাঙ্গুনিয়ায় আসতেন এবং রাঙ্গুনিয়ার মানুষের সাথে তার সদভাব ছিল। কিন্তু তার ছেলেরা রাউজান, রাঙ্গুনিয়াসহ উত্তর চট্টগ্রামের জনপদে সন্ত্রাস আর দখলবাজির রাজনীতি করে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন। ফলে তার ফাঁসির রায়ে রাঙ্গুনিয়ার সাধারণ মানুষ আনন্দ উল্লাস করছে’।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের নির্বাচনে রাঙ্গুনিয়া থেকে হেরে গেলেও ফটিকছড়ি উপজেলা থেকে চারদলীয় জোট প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে গ্রেপ্তার হন তিনি। ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ১৭ নভেম্বর তা আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
২০১২ সালের ৪ এপ্রিল সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল-১। ওই বছরের ১৪ মে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এরপর দীর্ঘ প্রায় ১৫ মাস ধরে চলা সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয় ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই। এ সময়ের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ৪১ জন, আসামিপক্ষে চারজন।
১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলেও গত ২৯ জুলাই দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। সেই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনও নাকচ করে আপিল বিভাগ।
(ঢাকাটাইমস/২১নভেম্বর/আইকে/জেবি)