logo ২৩ এপ্রিল ২০২৫
পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
১৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০৩:২৩
image

পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল সাম্প্রতিক সময়ের চোরাগোপ্তা হামলা নিয়ে। একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলা থেকে বাদ যাচ্ছেন না পুলিশ সদস্যরাও। কী হচ্ছে এসব? ঢাকার বাইরে কর্মরত ওই পুলিশ কর্তা মুঠোফোনে বলেন, ‘সাধারণ মানুষ আর পুলিশের মধ্যে তফাত কি খুব বেশি? ব্যবধান তো অস্ত্রে। হঠাৎ কেউ হামলা করলে প্রতিরোধে একজন কনস্টেবল কী এমন করতে পারে বলুন? পাল্টা হামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে যেটুকু সময় দরকার, তাও তো কেউ পায়নি।’


পুলিশ কর্মকর্তার কথার যুক্তি আছে বৈকি। কিন্তু হামলার কবলে পড়া পুলিশ সদস্যদের আত্মরক্ষায় কতটুকু প্রস্তুতি ছিল? আশুলিয়ার বারইপাড়ায় যখন হামলা হলো তখন পুলিশের কাছে অস্ত্র ছিল, গুলি ছিল না। দুর্বৃত্তরা যখন হামলে পড়ল তল্লাশি চৌকির পাঁচজন পুলিশের ওপর, তখন প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। দুজনকে যখন কুপিয়ে জখম করছিল দুর্বৃত্তরা, তখন প্রাণভয়ে শালবনে পালিয়ে গেছেন বাকি তিন সদস্য। গাবতলীতে যখন হামলা হলো, তখনও হামলাকারীদের ধারালো অস্ত্রের কারণে হার মেনেছে পুলিশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ঘাটুরায় সন্ত্রাসীদের গুলির মুখে পিকআপ ভ্যান নিয়ে খাদে পড়েছে পুলিশ। অথচ পাল্টা গুলি ছুড়ে দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে পারেনি তারা। প্রশ্ন, শারীরিক কসরতে এতটাই অপ্রশিক্ষিত দেশের বড় এই বাহিনীটির সদস্যরা?


পুলিশের ওপর হামলা নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার ও বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন কর্তারাও। আতঙ্ক ছড়িয়েছে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের ভেতরেও। চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পরিবার-পরিজনদের কপালেও। স্বজনকে কর্মক্ষেত্রে পাঠিয়ে তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় প্রহর পার করেন কাছের মানুষ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কমতি নেই সাধারণ মানুষের মধ্যেও। পুলিশ যখন নিজেই নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন সাধারণের জান-মালের দায়িত্ব তাদের ওপর কতটা নিশ্চিতে অর্পণ করা যায়?


পুলিশের সাবেক প্রধান এম এনামুল হক বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলা তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের হামলাগুলো মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। এটি আতঙ্কের বটে।’ তিনি বলেন, ‘চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণে শুধু অস্ত্র পরিচালনাই নয়, খালি হাতে কীভাবে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে তাও শেখানো হয়। তবে ইদানীং পুলিশের ওপর যেভাবে হামলা হচ্ছে তা মোকাবেলা করার মতো সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ কারিকুলামেরও পরিবর্তন আনার সময় হয়েছে।’


২০১৩ সালের শুরু থেকে জামায়াত-শিবিরের আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তুতেও পরিণত হয়েছিল পুলিশ। যেখানেই আন্দোলন সেখানেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। দিনের আলোতে রাজশাহীতে এক পুলিশ সদস্যের হেলমেট খুলে নিয়ে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়ার ছবি গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে। এছাড়া রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সময় পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও চোখে পড়ে। চট্টগ্রামেও পুলিশের ওপর হামলা করেছিল হেফাজতে ইসলাম। মিছিলের নামে ভাংচুরে বাধা দেওয়ায় পুলিশ সদস্যের বুকে উড়ে গিয়ে লাথি মারার দৃশ্য এখনও অনেকের চোখে লেগে আছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের বেপরোয়া আচরণেরও সমালোচনা হয়েছে।


অতীতে পুলিশকে বাঁশের লাঠি দিয়ে কিংবা অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তার বাঁট দিয়ে পেটানোর নজির থাকলেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে অতর্কিত কুপিয়ে হত্যার ঘটনা নতুন। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটনাগুলোর মধ্যে কিছুটা সময়ের ব্যবধান থাকলেও আঘাতের কৌশল ছিল একই। ধারালো অস্ত্র নিয়ে কুপিয়ে হত্যা ও আহত করা হয়েছে পুলিশ সদস্যদের। তল্লাশি চৌকিতেই হয়েছে হামলাগুলো। সাধারণ কনস্টেবল থেকে শুরু করে মিলিটারি পুলিশও বাদ যায়নি দুর্বৃত্তদের কবল থেকে। প্রতিটি ঘটনার পরই পুলিশের নানা দুর্বলতার চিত্র সামনে এসেছে। কোথাও অস্ত্র ছিল না পর্যাপ্ত। অস্ত্র থাকলেও ছিল না গুলি। আবার পাঁচজনকে একসঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হলেও দু-তিন জন ছাড়া বাকিরা ছিলেন মুঠোফোন কিংবা চা পানে ব্যস্ত। পুলিশ কর্মকর্তারাও বলছেন, মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের শারীরিক ফিটনেস সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে এমনটা বলা যাবে না। নিয়মিত ডিউটির বাইরেও প্রতিদিন অতিরিক্ত তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় দিতে হয়। রাজপথে যাদের ডিউটি তাদের জন্য বিষয়টি অমানবিকও বটে। কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দিতে হয়। বসার মতো কোনো ব্যবস্থাও থাকে না অনেক জায়গায়।


সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশকেই কেন হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন, পুলিশের ওপর কারণে-অকারণে হামলার পেছনে রয়েছে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা। এর প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে চেষ্টা চলছে পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার। কারণ, বিগত সময়ে দেশে রাজনীতির নামে যেসব নৈরাজ্য চালানো হয়েছে তা কঠোর হাতে দমন করেছে পুলিশ। তাই এই বাহিনীকে কোনোভাবে দুর্বল কিংবা আতঙ্কিত করে দিতে পারলে ভবিষ্যতে আরও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সম্ভব হবে বলে মনে করছে দুর্বৃত্তরা।


এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ‘পুলিশের ওপর কারা হামলা করছে তা পরিষ্কার। ২০১৩ সালে যারা পুলিশের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে সেই গোষ্ঠীই এই কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘যখন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেখছে কোনোভাবেই সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টলানো যাচ্ছে না তখন তারা এই পথ বেছে নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনোভাবেই তাদের ষড়যন্ত্রকে সফল হতে দেওয়া যাবে না।’


সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনও বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যারা বানচাল করতে চান পুলিশের ওপর হামলা তাদেরই কাজ। তিনি বলেন, ‘ঘরে-বাইরে বিদেশি নাগরিকসহ বিভিন্ন মানুষ খুন হচ্ছেন। এসব ঘটনার তদন্ত করবে পুলিশ। কিন্তু যারা তদন্ত করবে কিংবা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে তারাই এখন হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এতে তাদের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। একটি মোটিভেটেড গ্রুপ পরিকল্পিতভাবে এগুলো ঘটাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তারা বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে পারে।’


জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা প্রমাণ করে সবকিছু বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের অংশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা মানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ওপর হামলা। যারা এটি করতে চান তাদের উদ্দেশ্য দেশের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া।’ তিনি বলেন, জনগণের উচিত হবে এই দুর্বৃত্তদের রুখে দেওয়া। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যদের কোনো গাফিলতি থাকলে তাও খতিয়ে দেখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।


চোরাগোপ্তা হামলা, সতর্ক পুলিশ, তারপরও হামলা!


গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে কূটনৈতিকপাড়ায় ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লাকে হত্যার মাধ্যমে সূত্রপাত হয় সাম্প্রতিক সময়ের হত্যাকাণ্ডের। এর মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে একইভাবে রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ১৩টি বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দুই বিদেশি নাগরিক ও দুই পুলিশ সদস্যসহ নৃশংস খুনের শিকার হন অন্তত ২২ জন। গত ৪ নভেম্বর ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারের আশুলিয়ায় বারইপাড়া চেকপোস্টে কর্তব্যরত অবস্থায় খুন হন পুলিশ কনস্টেবল মুকুল হোসেন। আহত হন নুর আলম নামে পুলিশের আরেক সদস্য। তার চিকিৎসা চলছে।


এর আগে ২২ অক্টোবর রাতে খোদ রাজধানীর গাবতলীতে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান পুলিশের এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা। গত ৩ নভেম্বর কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ঘাটুরা এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে পুলিশের পাঁচ সদস্য আহত হন। গত ১০ নভেম্বর ঢাকার কচুক্ষেতে একজন মিলিটারি পুলিশকে (এমপি) কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়।


সর্বশেষ গত ১১ নভেম্বর ফরিদপুর শহরে মোটরসাইকেলে করে কারাগারের ডাক নিয়ে যাওয়ার সময় কারারক্ষী আসাদুজ্জামানের পিঠে ক্ষুর দিয়ে আঘাত করে হামলাকারী পালিয়ে গেছে। এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি তটস্থ করে তুলেছে সরকারকেও। সাম্প্রতিক সময়ে টার্গেট কিলিংসহ সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা মোকাবেলায় সরকার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছে। সারা দেশে নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং কূটনৈতিক এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। বাড়ানো হয়েছে টহল ও চেকপোস্টসহ গোয়েন্দা নজরদারি। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক জরুরি বৈঠক শেষে দেশের সব কটি রেঞ্জের ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারের কাছে ই-মেইল বার্তায় সাত দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও থামছে না হামলা।


হামলাকারীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে


টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। প্রতিটি ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পিত এসব হামলার ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেপথ্য নায়করা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রতিটি ঘটনার পরপরই নড়েচড়ে বসছে প্রশাসনযন্ত্র। র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারে দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। ঘটনার ক্লু মিলেছে, শনাক্ত হয়েছে কিংবা দুর্বৃত্তরা গোয়েন্দা জালে রয়েছে বলে মিডিয়ার কাছে নানা তথ্য দিচ্ছেন তারা। তবে একটি ঘটনার তদন্ত শুরু করার পরপরই দুর্বৃত্তরা আইনশৃঙাখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঝানু কর্মকর্তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আরেকটি নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মানসিক চাপে পড়ছেন মাঠপর্যায়ে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা। এদিকে একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটলেও তাদের কেন গ্রেফতার করা যাচ্ছে না এমন প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে সাধারণ মানুষের মনে।


জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে। ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশকে আরও সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে চৌকিগুলোতে। হামলাকারীরা ধরা অবশ্যই পড়বে। তাদের খোঁজা হচ্ছে।


যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালই লক্ষ্য?


আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের ওপর একের পর এক হামলার পেছনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। কারণ, ইতিপূর্বেও যুদ্ধাপরাধীদের রায়কে ঘিরে সহিংসতা চালিয়েছে জামায়াত-শিবির। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বরং অতীতের ধারবাহিকতাই বটে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াত যখন প্রকাশ্যে দলীয় কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন তারা এই চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নিয়েছে। এদের ব্যাপারে শতভাগ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, গাবতলীতে এএসআই  ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত মাসুদ রানা জানিয়েছেন, তিনি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।


আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বলছেন ওই ঘটনার সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের চূড়ান্ত রায় সময়ের ব্যাপার। এখন পর্যন্ত তার ফাঁসি বহাল আছে। জামায়াত রাজপথে এর প্রতিবাদ করতে পারছে না। কিন্তু পুলিশের ওপর হামলা করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে একটি অস্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে। যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার সহজ হয়।


স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও এর সঙ্গে একমত। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতেই পুলিশের ওপর এই হামলা চালানো হয়েছে’।


তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন নাম দিয়ে একই গোষ্ঠী এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। তারা কখনও আনসারুল্লাহ বাংলাটিম, কখনও আইএস, কখনও আল কায়েদা ইত্যাদি নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করছে’।


স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গোয়েন্দা পুলিশ শিগগিরই দল গঠন করে জঙ্গিদের ধরার কাজ শুরু করবে। এরা মানবতার শত্রু, মানুষের শত্রু। নৃশংসভাবে এরা ছুরিকাঘাত করে পুলিশকে হত্যা করেছে। চেঞ্জিং আওয়ারে এই ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই হামলা হয়।’ আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘ব্লগার-প্রকাশকদের উপর যেভাবে হামলা হয়েছে সেই একই কায়দায় আশুলিয়ায় পুলিশের উপর হামলা হয়েছে।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা সবকটি হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করছি। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী বসে নেই। কাজ করছে।’


হামলা হলেই গুলি


সম্প্রতি যেখানে হামলা হয়েছে সেখানেই বেকায়দায় পড়েছে পুলিশ। হাতে অস্ত্র থাকলেও কিছু করতে পারেনি। আবার অস্ত্র ছিল গুলি ছিল না অজুহাতে পালিয়ে বেঁচেছে কয়েকজন। এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে নির্দেশনা এসেছে চেকপোস্ট অথবা টহলকালে পুলিশ আক্রান্ত হলেই গুলি চালাতে পারবে। এই নির্দেশনা পুলিশের মনোবলকে আরও দৃঢ় করবে। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্দেশনা দেওয়ার আগে আত্মরক্ষার্থে পুলিশের গুলি চালাতে কোথায় কি বাধা ছিল? পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধীদের মৃত্যুর খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। তাহলে হামলার সময় পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়লে তা কি গ্রহণযোগ্য হতো না? মূলত পুলিশ নিজেদের আত্মরক্ষায় সক্ষমতা হারাতে বসেছে।


গত ৫ নভেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তরে ডিসি এবং এডিসি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি একই সঙ্গে চেকপোস্ট বসানোর সময় অন্তত একটি অস্ত্রের চেম্বারে গুলিভর্তি রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। একই কথা বলেছেন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ।


সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডিএমপি কমিশনার পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। কোনোভাবেই যেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সে ব্যাপারে পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এছাড়া নিরাপত্তা জোরদার করতে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। বৈঠকে ডিএমপি কমিশনার বলেন, টহল বা চেকপোস্টে পুলিশ গুলিবিদ্ধ হবে এবং সন্ত্রাসীরা গুলি করে চলে যাবে, পুলিশ গুলি করবে না, এটা হতে পারে না। নিজেদের রক্ষায় গুলি চালাতে হবে। এক্ষেত্রে কারোর অনুমতি লাগবে না। তিনি পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য না থাকলে চেকপোস্ট না বসানোর জন্যও বলেছেন। তল্লাশি চৌকিতে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরতেও নির্দেশ দেন তিনি।


এর আগে গত ৪ নভেম্বর রাতে তেজগাঁও বিজি প্রেসের সামনে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পরিদর্শনে যান র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। এসময় তিনি বলেন, আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গুলি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নিজের ও অন্যের জীবন রক্ষায় এবং রাষ্ট্রের ও অন্যের স¤পত্তি রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেকোনো মুহূর্তে গুলি করতে পারবেন। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কি করবে তা দেশের পরিচালিত আইনেই বলা আছে। এজন্য বিশেষ নির্দেশের প্রয়োজন নেই। পুলিশ বা যেকোনো বাহিনী যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা আইন দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত। সে আইনে স্পষ্ট করেই বলা আছে কোন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি করতে পারবেন।


পুলিশের শারীরিক সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ


আত্মরক্ষার্থে অস্ত্রের পাশাপাশি শারীরিক সক্ষমতাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিকভাবে শক্তি ও সামর্থ্যবান না হলে কাউকে খালি হাতে মোকাবেলা করাটাও সহজ হয় না। পুলিশের নিত্যদিনের খাবারের তালিকা নিয়েও আছে অসন্তোষ। গণমাধ্যমে প্রায়ই উঠে আসে পুলিশের নিম্নমানের খাবারের কথা। শোনা যায়, পুলিশ সদস্যরা তাদের জন্য বরাদ্দ থাকা খাবার বিক্রি করে সেই টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত টাকা জুড়ে বাইরে থেকে খাবার কিনে খান।


পুষ্টিবিদরা বলছেন, শুধু দোষ চাপালেই হবে না। পুলিশ সদস্যদের শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য কেন কমে আসছে সেটিও ভাবতে হবে। একটি বাহিনীর সদস্যদের সব সময়ই বিশেষ ব্যবস্থাপনায় রাখতে হয়। তাদের শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। যদি তাদের শরীর সুস্থ না থাকে আর মানসিকভাবেও তারা প্রফুল্ল না থাকেন তাহলে ভালো সেবা আশা করবেন কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই।


সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।