অবশেষে দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের মধ্যদিয়ে জাতির দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান হলো কিছুটা। তবে এর মধ্যদিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের আসার ক্ষেত্রে আরও একধাপ অগ্রসর হলো বাংলাদেশ।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গর্বে লুকিয়ে আছে কলঙ্কের এক ইতিহাসও। নিজ দেশ যখন আক্রান্ত, এ দেশের ছাত্র, যুব ও জনতা যখন অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবেলা করছে তখন এই মাটিতে বড় হওয়া কিছু মানুষ দাঁড়িয়েছিল শত্রুর পক্ষে।
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিতে হেন কোনো কাজ নেই যে তারা করেনি। শেষ পর্যন্ত বাঙালির বুদ্ধিভিত্তিক অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে তালিকা ধরে খুন করেছে একের পর এক বুদ্ধিজীবীকে। ইতিহাসের ভিন্নতম সেই হত্যাযজ্ঞের বিচার আদৌ হবে কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে বছরের পর বছর। তবে ৪৪ বছর পর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আদালত মৃত্যুদ- ঘোষণা করে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের। রায়ও কার্যকর হলো। আদালতের এই ঘোষণা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনদের মনের ক্ষত উপশম করছে কিছুটা হলেও।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এর আগেও দুটি ফাঁসির দ- কার্যকর হয়েছে। সাজা পেয়েছেন জামায়াতের দুই নেতা। যার একজন ছিলেন একাত্তরে আলবদর বাহিনীর ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। অপরজন সাজা পেয়েছেন ঢাকার মিরপুরে গণহত্যায় সহযোগিতার দায়ে। তবে মুজাহিদই প্রথম ব্যক্তি যার ফাঁসির দ- দেওয়া হয়েছে কোনো নির্দিষ্ট অপরাধে নয়, বরং বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত আলবদর বাহিনীর ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির’ কারণে। বিশ্ব ইতিহাসে এভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নজির নেই। তালিকা ধরে ধরে বাঙালির চিন্তার জগতকে শূন্য করে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র শত্রুপক্ষ সফল করেছিল তার মূলে ছিল এদেশের কিছু মানুষ। স্বাধীনতার পর পালিয়ে যাওয়া এই অপরাধীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আলী আহসান মুজাহিদ তাদেরই একজন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজাহিদ ছিলেন জামায়াতের সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের দ্বিতীয় প্রধান নেতা। এই ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়েই গঠিত হয় একাত্তরের খুনি বাহিনী আলবদর। আর আলবদর বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান সংগঠকও ছিলেন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারি নথিপত্র বলে, ইসলামী ছাত্রসংঘের সে সময়ের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি আলী আহসান মুজাহিদ সারা দেশ চষে বেড়িয়ে আলবদর বাহিনীতে যোগ দিতে নেতা-কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর তাদের গড়ে তোলা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র¿¿শস্ত্র পেয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তারা। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নির্মমতার জন্য কুখ্যাত হয়ে উঠে জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত বাহিনীটি।
’৭৫ এর পটপরিবর্তনে রাজনীতিতে ফেরা
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পরাজয় যখন অত্যাসন্ন তখন অন্য নেতাদের সঙ্গে পালিয়ে যান মুজাহিদ। তার সে সময়ের অনুসারীদের কেউ কেউ ফাঁস করেছেন পলায়নের আগে মুজাহিদের কর্মকা-। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরে আলবদর বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র বর্তমান শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটে আলবদর কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দেন মুজাহিদ। পরিস্থিতি বেগতিক জানিয়ে নেতা-কর্মীদের আত্মগোপনের নির্দেশ দিয়ে সুযোগ বুঝে প্রকাশ্যে আসার কথা বলেন এই আলবদর নেতা।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সেক্রেটারি থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি হন মুজাহিদ, একইভাবে আলবদর বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বও পান তিনি। বিভিন্ন নথিপত্র আর সাবেক অনুসারীদের বক্তব্য বলছে, শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটে সে ভাষণের পর পালিয়ে যান মুজাহিদ। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সুযোগ বুঝে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোর অন্য নেতা-কর্মীদের মতো প্রকাশ্যে আসেন মুজাহিদও। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ার পর সামনে আসেন মুজাহিদসহ একাত্তরে আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির দায়িত্বে থাকা নেতারা। যারা একসময় এদেশের স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না, তারা পরবর্তীতে রাজনীতির খেলায় গাড়িতে উড়িয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তকে অপমান করেছে তাদের ঔদ্ধত্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষজন এমনটাই মনে করেন।
২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক জোট গড়ার পর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পান মন্ত্রিত্ব। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বানিয়ে দেওয়া হয় একাত্তরে আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক মুজাহিদ। ইতিহাস কথা বলে। এই তো আট বছর আগের কথা। তখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে যুদ্ধাপরাধীরা। ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। অতীতেও কোনো যুদ্ধাপরাধী ছিল না।’ পতন হয়েছে তার এই দম্ভোক্তি ও মিথ্যাচারের। কারণ এখন পর্যন্ত মুজাহিদের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মামলায় বারবার দ-িত হতে হয়েছে তাকে। সর্বশেষ উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়েও বহাল রয়েছে মুজাহিদের মৃত্যুদ-। অপরাধ একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা ও সহযোগিতা করা।
এর আগে রায়ের ব্যাখ্যায় মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরা হয়। আলবদর বাহিনীতে তার অবস্থান প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাত্তরে ছাত্রসংঘের সদস্যরা আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। যেহেতু মুজাহিদ ছাত্রসংঘের ঊর্ধ্বতন নেতা ছিলেন, এ জন্য আলবদর ও ছাত্রসংঘ দুটি সংগঠনের ওপরই তার কর্তৃত্ব ছিল। মুজাহিদ একাত্তরে রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ক্ষমতাধারী ছিলেন, আর এ ক্ষমতার জন্যই তিনি আলবদর বাহিনীকে দিক-নির্দেশনা দিতে পারতেন। তবে তিনিই এ বাহিনীর একমাত্র নেতা ছিলেন না।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, এ জন্য আলবদরের কোনো আনুষ্ঠানিক নথিতে মুজাহিদের নাম থাকা জরুরি নয়। সব ধরনের নথি ও সাক্ষ্য মূল্যায়ন করে বোঝা যায়, মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর সব ধরনের কর্মকা- স¤পর্কে ¯পষ্ট ধারণা রাখতেন। অবস্থানগত কারণেই আলবদর গঠন থেকে শুরু করে হত্যা-নিধনযজ্ঞের শেষ পর্যন্ত এ বাহিনীর ওপর তার কর্তৃত্ব ছিল। সেলিম মনসুর খালেদের আলবদর বই অনুসারে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর উদ্দেশে ‘শেষ ভাষণ’ দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আসামির সঙ্গে আলবদর বাহিনীর অনানুষ্ঠানিক ঊর্ধ্বতন-অধঃস্তন সম্পর্ক রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। আলবদর সদস্যদের ওপর মুজাহিদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং আলবদরের কর্মকা- স¤পর্কে তিনি স¤পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন।
চার দশক পর বিচারেও স্বস্তি
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। দালাল আইন বিলুপ্তের পর ছাড়া পায় দ-িত ও বিচারের অপেক্ষায় থাকা প্রায় ১১ হাজার বন্দি। আর এক পর্যায়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতাপ শুরু হয় সমাজ, রাজনীতিতে। তবে যুদ্ধাপরাধী আর বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের দাবি বন্ধ হয়নি কোনোদিন। যদিও আদৌ বিচার হবে কি না, সে নিয়ে সংশয় ছিল সব সময়। এমনকি ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জেতার পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরও নানা সংশয়-সন্দেহ ছিল সমাজে। তবে সব সংশয়ের অবসান হয়েছে। একে একে রায় ঘোষণা এবং দ- কার্যকর শুরু হয়েছে। দীর্ঘকাল পরে এসে অপরাধীর মৃত্যুদ-ের রায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনদের মনে সান্ত¦না এনে দিয়েছে।
স্বজন হারানোর বিচার পেয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি অনেকে। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে মনের বেদনা হালকা করার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। দীর্ঘদিন ভেতরে পুষে রাখা দুঃখের অবসান হতে চলেছে যেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ বলেন, ‘বাবাকে ভালোভাবে মনে পড়ে না। কিন্তু বাবাকে হত্যার পর মুজাহিদরা যে দম্ভোক্তি করেছেন, তাতে করে নিজেকে অসহায় মনে হতো স্বাধীন এই দেশে। স্বাধীনতাবিরোধীরা মন্ত্রী হয়েছেন। গাড়িতে দেশের পতাকা উড়িয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তকে অপমান করে দম্ভের সঙ্গে চলাফেরা করেছেন, যার মধ্যেও ছিল পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়ন।’
তিনি বলেন, ‘মৃত্যুদ-ের রায়ের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম একটি স্বচ্ছ ইতিহাস জানার সুযোগ পেল। এই ইতিহাস প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারসহ অন্যান্য শহীদ পরিবার দীর্ঘ আন্দোলন করেছি। এই স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় আসীন হলে এবং শহীদ জননী জাহানার ইমামের মৃত্যু হলে সেই আন্দোলন কিছুটা চুপ হয়ে যায়। আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। সেই আন্দোলন আবার শুরু হয়। সারা দেশের মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হয়। ফলে এই বিচারকাজ বেশ ত্বরান্বিত হয়। আজ এই বিচারের জন্য আমি সারা দেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ।’ তবে নিরাপত্তাহীনতার কথাও জানালেন শহীদের এই স্বজন। বললেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি। আর যারা সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের মামলার সাক্ষী, তারা তো চরম নিরাপত্তাহীনতায়। কারণ সাকার অনেক লোকজন। আর মুজাহিদের তো জামায়াতই আছে। তারা এখন বিভিন্ন নামে জঙ্গিবাদ চালাচ্ছে।’
শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক আলীম চৌধুরীর মেয়ে চিকিৎসক নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘একাত্তরে দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে এই প্রথম কোনো মামলায় দেশ চূড়ান্ত রায় পেল। শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান হিসেবে এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো এ রায়।’ তিনি বলেন, ’৭১-এর ভিকটিম পরিবারের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই মামলার বিচারকাজে অংশ নিয়েছেন এবং সাক্ষ্য দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় স্বাধীনতাবিরোধীরা এখন অনেক বিত্তশালী ও ক্ষমতাধর। নানা অপকর্মে তারা পারদর্শী। শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেহেতু অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন, সরকারের উচিত তাদের ঝুঁকিমুক্ত করা।’
রায়ে খুশি রাষ্ট্রপক্ষও। চূড়ান্ত রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘একাত্তরের ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর তিন দিনে যত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে, তা বিশ্বের আর কোথাও হয়নি। বুদ্ধিজীবীদের কথা মনে পড়লে মন বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য যদি কোনো বিচারের রায় না পেতাম, আমাদের হতাশাটা অব্যাহত থাকত। একজনকেও (মুজাহিদ) যে সাজা দেওয়া হলো, সেটাই আমাদের স্বস্তি, সান্ত¡না।’ মুজাহিদের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, এতে করে ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। এ কারণে জাতি সুপ্রিম কোর্টের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। কিন্তু কথা হলো, এখনো নানাভাবে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে সাক্ষীদের। আমিও সার্বক্ষণিক শঙ্কায় থাকি। স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারি না। আমাকে ঘুরতে হয় পুলিশি নিরাপত্তায়। সরকার এখন পর্যন্ত এই সাক্ষী ও ভিকটিমদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা করেনি।’
তথ্যপ্রমাণে একাত্তরে আলী আহসান মুজাহিদ
একাত্তরে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ভূমিকা কী ছিল তা উঠে এসেছে ওই সময়কার রাষ্ট্রীয় গোপন দলিলেও। সাপ্তাহিক এই সময়-এর ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘একাত্তরের গোপন দলিলে’ পাওয়া গেছে তার সম্পর্কে অনেক অকাট্য প্রমাণ। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর রংপুরে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের এক সভায় আলবদর বাহিনী গড়ে তুলতে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন। তিনি তখন জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে ইয়াহিয়া সরকারকে মাসে দুবার গোপন প্রতিবেদন পাঠাত। ‘ফর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তান’ নামে অক্টোবরের দ্বিতীয় ভাগের প্রতিবেদনে (১৩ নভেম্বর ১৯৭১ স্বরাষ্ট্র সচিব স্বাক্ষরিত) মুজাহিদের এই নির্দেশের কথা উল্লেখ করা আছে। ওই সভায় মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘ইসলামবিরোধী শক্তিদের প্রতিহত করতে হবে।’ তিনি যুবকদের সংগঠিত করে আলবদর বাহিনীতে যোগ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এ এস এম সামছুল আরেফিনের লেখা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান বইয়ের ৪২৮ পৃষ্ঠায় মুজাহিদকে পূর্ব পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য এদেশীয় দোসরদের নিয়ে গঠিত হয় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। জামায়াতের নেতা-কর্মীরাই মূলত এসব বাহিনীর সদস্য ছিলেন। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীসহ ডানপন্থি অন্যান্য দলেরও কিছু সদস্য এসব বাহিনীতে যোগ দেন। আলবদর ও আলশামস বাহিনী ছিল জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ আছে এই দুটি বাহিনীর বিরুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজি তার লেখা ‘দি বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ের ২৩৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আলবদর বাহিনীর সদস্যদের বিশেষায়িত কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। আলশামস বাহিনীকে বিভিন্ন সেতু পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। যেখানেই এই দুই বাহিনী দায়িত্ব পেয়েছে সেখানেই তারা ভালো কাজ করেছে। যেখানে ডানপন্থি দলের শক্তি বেশি ছিল সেখানে এরা আরও ভালো কাজ করেছে।’
১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে আলবদর বাহিনীর ‘বিশেষায়িত কাজের নমুনা পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়, ‘হানাদার পাকবাহিনীর সহযোগী আলবদরের সদস্যরা পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের পর যখন পালিয়ে গেল তখন তাদের হেডকোয়ার্টারে পাওয়া গেল এক বস্তা চোখ। এ চোখ দেশের মানুষের। আলবদরের খুনিরা তাদের হত্যা করে চোখ তুলে বস্তা বোঝাই করে রেখেছিল।’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজামী ও মুজাহিদ সারা দেশ সফর করে পাক সেনাবাহিনীকে সহায়তা দিতে দলের কর্মী-সমর্থকদের আহ্বান জানান। তাদের নানা বক্তব্য সে সময় জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছিল।
’৭১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ফরিদপুরের একই সমাবেশে তিনি (মুজাহিদ) বলেন, ঘৃণ্য শত্রু ভারতকে দখল করার প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের আসাম দখল করতে হবে। এ জন্য আপনারা সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।’
একই সালের ২৫ অক্টোবর এক বিবৃবিতে মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘আমরা আজ ইসলামবিরোধী শক্তির এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আমরা জাতির স্বার্থে এবং এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মোৎসর্গের শপথ গ্রহণ করব।’ ৭ নভেম্বর ‘বদর দিবস’ পালন উপলক্ষে বায়তুল মোকাররমের সামনে ঢাকা শহর ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে এক জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। জমায়েতে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছাত্রসংঘের পক্ষ থেকে চার দফা ঘোষণা করেন। ঘোষণায় বলা হয়, এই ঘোষণা বাস্তবায়িত করার জন্য শির উঁচু করে, বুকে কোরআন নিয়ে মর্দে মুজাহিদের মতো এগিয়ে চলুন। প্রয়োজন হলে নয়াদিল্লি পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আমরা বৃহত্তর পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করব।’
৪ ডিসেম্বর এক যুক্ত বিবৃতিতে মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গতকালের বেতার ভাষণকে অভিনন্দন জানিয়ে আমরাও ঘোষণা করছি যে, এ দেশের ছাত্র-জনতা ’৬৫ সালের মতো এবারও ই¯পাতকঠিন শপথ নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে যাবে।’
১৫ অক্টোবর ১৯৭১ সালে দৈনিক সংগ্রাম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মুজাহিদের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘রাজাকার, আলবদর ও অন্য স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর তরুণরা জাতিকে বিশ্বাসঘাতক ও ভারতীয় চরদের হাত থেকে রক্ষা করতে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি ভুট্টো (জুলফিকার আলী ভুট্টো), কাওসার নিয়াজী, মুফতি মাহমুদ ও আসগর খানের মতো রাজনৈতিক নেতারা এসব বাহিনী স¤পর্কে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করছেন। তিনি (মুজাহিদ) সরকারের কাছে একশ্রেণির নেতার এ ধরনের কর্মকা- বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।’
মুজাহিদ ১৯৭০ সালের অক্টোবরে সাংগঠনিক সফরে বের হন। ২৬ অক্টোবর দৈনিক সংগ্রাম-এ ছাপা হওয়া তার বক্তব্যে মুজাহিদ ‘পাকিস্তানের ছাত্র-জনতাকে দুষ্কৃতকারী (মুক্তিযোদ্ধা) খতম করার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।’ ২৭ অক্টোবর মুজাহিদ রংপুর জেলা ছাত্রসংঘের কর্মী সম্মেলনে সবাইকে জিহাদি মনোভাব নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান (দৈনিক সংগ্রাম, ২৮ অক্টোবর, ’৭১)। ৪ ডিসেম্বর মুজাহিদ পাকিস্তান বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সরকারকে প্রতিশ্রুতি দেন, ‘ছাত্রসমাজ ইস্পাতকঠিন শপথ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি লড়ে যাবে’ (দৈনিক সংগ্রাম, ৫ ডিসেম্বর, ’৭১)।
ইতিপূর্বে রায়ে আসামির পরিচিতিতে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই মামলার আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ছাত্রাবস্থায় ইসলামী ছাত্রসংঘে (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন) যোগ দেন। ১৯৬৮-৭০ সালে তিনি ফরিদপুর জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওই বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হন। একাত্তরের অক্টোবরে তিনি ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হন বলে দাবি করা হয়। আসামি ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চারবারই পরাজিত হন। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তিনি সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন।
সাতটি অভিযোগ ও ট্রাইব্যুনালের মূল্যায়ন
মুজাহিদকে মৃত্যুদ- দিয়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে মুজাহিদ আপিল করলে আপিল বিভাগ মুজাহিদের মৃত্যুদ- বহাল রেখে গত ১৬ জুন সংক্ষিপ্ত রায় দেয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ।
সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও বুদ্ধিজীবী হত্যা
মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে হত্যায় সহযোগিতা করা। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর গভীর রাতে আলবদর সদস্যরা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, তার লাশও পরে আর পাওয়া যায়নি। ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর ক্যা¤েপ মুজাহিদ বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করতেন। ওই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- শুরু হয়। প্রথম অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনালের মন্তব্য ছিল এমন, ‘প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ইত্তেফাক পত্রিকার তৎকালীন কার্যনির্বাহী স¤পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করে আলবদর সদস্যরা, যারা ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ‘ডেথ স্কোয়াড’ ও জামায়াতের ‘অ্যাকশন সেকশন’। একাত্তরের সেপ্টেম্বরে তিনি ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে মূলত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সমর্থকদের সমালোচনা করেন।
একাত্তরের ১৬ সেপ্টেম্বর জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম পত্রিকায় ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ শীর্ষক পাল্টা নিবন্ধ ছাপা হয়। ওই নিবন্ধে সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’, ‘ব্রাহ্মণ্যবাদের দালাল’ বলে উল্লেখ করা হয়। ¯পষ্টতই সিরাজুদ্দীনের লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিফলিত হওয়ায় তিনি ঘাতক আলবদর বাহিনীর লক্ষ্যে পরিণত হন। একাত্তরের ২৪ নভেম্বর সংগ্রাম পত্রিকায় আসামির একটি যৌথ বিবৃতি ছাপা হয়, যাতে আসামি ভারতের দালালদের নিশ্চিহ্ন করার আহ্বান জানান। পরবর্তী সময়ে নারকীয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- শুরু হয়।
আদালত আরও বলেন, ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর একটি দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হওয়া ‘কান্ট্রি কুড নট কেয়ারলেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন (আসামিপক্ষের নথি) খুটিয়ে পড়লে দেখা যায়, যে সশস্ত্র দলটি সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন মুজাহিদ। ‘নেতৃত্বে থাকা’ মানে সবসময় এটা দেখানোর দরকার নেই যে ঘটনাস্থলে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে। যে ব্যক্তি কর্তৃত্ববাদী অবস্থানে থাকেন, তার নির্দেশনা, আদেশ, উসকানি বা প্ররোচনাও নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে পড়ে।
ষষ্ঠ অভিযোগের মূল্যায়নে বলা হয়, আলবদর বাহিনীর নীতিনির্ধারণী অংশে আসামি মুজাহিদের অবস্থান ও আলবদরের কার্যক্রমের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মুজাহিদ নিয়মিত মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদরের ক্যা¤েপ যেতেন। বিশেষত একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ওই আলবদর ক্যাম্পে চরম হতাশা ও কষ্ট নিয়ে দেওয়া তার শেষ ভাষণে তিনি ছাত্রসংঘের সদস্যদের আলবদরে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান এবং তথাকথিত ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের দালাল’, ‘ইসলামের শত্রু’দের নিশ্চিহ্ন করতে বলেন। এতে আলবদর বাহিনীতে মুজাহিদের নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থান এবং ব্যাপক মাত্রার নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে প্রমাণিত হয়।
রায়ে বলা হয়, নাৎসী যুদ্ধাপরাধী অ্যাডলফ আইকম্যান নিজ হাতে কাউকে হত্যা করেননি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন নাৎসী নিধনের মূল কারিগর। আইকম্যান নাৎসী সংগঠন স্টর্ম ট্রুপারস (এসএ), সিকিউরিটি সার্ভিস (এসডি) ও গেস্টাপো বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এই তিনটি বাহিনী ১৯৪৬ সালে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে অপরাধী সংগঠন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। গেস্টাপো বাহিনীর প্রধান হিসেবে আইকম্যানের মৃত্যুদ- হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিভি ও রেডিওর প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধ শেষে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের কয়েকটি কক্ষে রক্তের স্রোত ভেসে যেতে দেখেন, সেই সঙ্গে বর্বরোচিত হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোও পড়ে থাকতে দেখা যায়। এতে বোঝা যায়, ওই কলেজটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি হত্যাপুরী। এতে প্রমাণিত হয় একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আসামি মুজাহিদ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পুণ্য রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তার শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযোগে আসামির বিরুদ্ধে একক ও যৌথ অপরাধের দায় এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায় উভয়ই প্রমাণ করতে পেরেছে। মুজাহিদের বিরুদ্ধে এ দুটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও ট্রাইব্যুনাল আলাদাভাবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেননি। ট্রাইব্যুনাল বলেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যা, পরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি অংশ। বরং পৃথকভাবে সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যার অভিযোগ প্রমাণ হওয়া বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও সহযোগিতা করায় আসামির স¤পৃক্ততার যুক্তিকে আরও জোরদার করে।
বাকচরে হিন্দুদের হত্যা ও নিপীড়ন
সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদ সহযোগীদের নিয়ে ফরিদপুর সদর থানাধীন হিন্দু অধ্যুষিত বাকচর গ্রামে হামলা চালান। সেখানে কয়েকজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়, এক হিন্দুর বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে ওই হিন্দু পরিবার দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। এ অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলে, রাষ্ট্রপক্ষের ১৩তম সাক্ষী শক্তি সাহার সাক্ষ্যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে আসামি মুজাহিদ অস্ত্র হাতে অপরাধস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং তার ইঙ্গিতেই হত্যাকা- সংঘটিত হয়। এটা কখনোই দাবি করা হয়নি যে, মুজাহিদ সেখানে একা ছিলেন, তার সঙ্গে ফরিদপুরের কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক আফজাল, আলাউদ্দিন খাঁ, কালু বিহারীসহ অন্যরা উপস্থিত ছিল। রাষ্ট্রপক্ষের ১২তম সাক্ষী চিত্তরঞ্জন সাহার সাক্ষ্যে এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের এই দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নির্মূল করতেই তারা সেখানে গিয়েছিলেন। আর বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ওই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মূলত বাসভূমি ত্যাগের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বা বাধ্য করা হয়েছে। হিন্দুদের দেশান্তর সংঘটিত অপরাধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয় বরং সেটিই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ¯পষ্টতই, ওই ঘটনায় দুটি পৃথক অপরাধ ঘটানো হয়েছে। একটি হিন্দুদের হত্যা, অপরটি হিন্দুদের নিপীড়ন। পদাধিকার বলে আসামির অবস্থান একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায় এবং একক ও যৌথ অপরাধের দায় প্রমাণ করে।
আলতাফ মাহমুদ, রুমী, বদী, আজাদ, জুয়েল হত্যা
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩০ আগস্ট নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যা¤েপ যান মুজাহিদ। সেখানে বন্দি সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদী, রুমী, জুয়েল, আজাদকে দেখে তারা গালিগালাজ করেন। পরে মুজাহিদের পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে তাদের অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
এ অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী জহির উদ্দিন জালাল ওই ক্যা¤েপ আটক ছিলেন। তিনি শুনেছেন, মুজাহিদ ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে বলছেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণার আগেই বন্দি রুমী, বদী, জুয়েল ও অন্যদের মেরে ফেলতে হবে। ট্রাইব্যুনাল বলে, একটি নির্ধারিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি এ ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। সাক্ষ্য বিশ্লেষণে এটাও প্রমাণিত যে বদী, রুমীদের আটক করে আলবদর সদস্যরা থানায় সোপর্দ করে। তাদের আটক, নির্যাতন ও হত্যায় আলবদর সদস্যদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এ জন্য আলবদরের ঊর্ধ্বতন পদাধিকারী মুজাহিদ কোনোভাবেই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। রুমীদের আটক করার ঘটনা তর্কাতীত, কারণ রুমী স্মারক গ্রন্থ থেকেও তাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সমর্থিত।
ফরিদপুরের রণজিত নাথকে আটক রেখে নির্যাতন
মুজাহিদের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ হলো, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামের রণজিত নাথকে খাবাসপুর মসজিদের কাছ থেকে ধরে পুরনো সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত মুজাহিদের ইঙ্গিতে রণজিতকে একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করে। তবে রাতে রণজিত পালিয়ে যান। এ অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সেনাক্যাম্পে মুজাহিদের নিছক উপস্থিতি প্রমাণ করে না যে, তিনি অপরাধে সহযোগিতা বা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করা এটা প্রমাণ করে যে, ওই কর্মকর্তাদের ওপর আসামির কর্তৃত্ব রয়েছে।
ক্যা¤েপ রণজিতকে দেখে মুজাহিদ বলেন, ‘ইসকো হটাও’। এটা কোনো নির্দোষ উচ্চারণ নয়, বরং এ উচ্চারণ আদেশ বা নির্দেশনা বোঝায়। যদি এটা নির্দোষ উচ্চারণ হতো, তবে রণজিতকে সেনাক্যা¤প থেকে ছেড়ে দেওয়া হতো। বরং এ কথা উচ্চারণের পর তাকে নিয়ে অন্য একটি স্থানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী ও ঘটনার শিকার রণজিত নাথ নিজে ওই ঘটনার সাক্ষ্য দিয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী মীর লুৎফর রহমান ওই সাক্ষ্য সমর্থন করেছেন। রণজিতকে আটকে রাখার ওই ঘটনা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আটকে রেখে নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে।
প্রমাণিত হয়নি দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ
মুজাহিদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ ফরিদপুরের হিন্দু অধ্যুষিত বৈদ্যডাঙ্গি, ভাঙ্গিডাঙ্গি, বালাডাঙ্গি ও মাঝিডাঙ্গি গ্রামে গণহত্যা বা নিপীড়ন এবং চতুর্থ অভিযোগ আবু ইউসুফকে আটকে রেখে নির্যাতন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। দ্বিতীয় অভিযোগের মূল্যায়নে ট্রাইব্যুনাল বলে, রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ, নবম ও ১১তম সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত যে, হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আংশিকভাবে নির্মূলের উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়। নবম সাক্ষী বলেছেন, মুজাহিদ হামলাকারীদের সঙ্গী ছিল।
নিজামীর ফাঁসির অপেক্ষা
চারটি অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির দ- পেয়েছেন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীও। এর একটি বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে। আরও চারটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদ- পেয়েছেন একাত্তরে আলবদর বাহিনীর এই কমান্ডার। মুজাহিদের মতো তিনিও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আলবদর বাহিনী সংগঠন, পরিচালনা, পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে সক্রিয় অংশগ্রহণের অভিযোগও প্রমাণ হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, ‘একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।’ ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে দেওয়া ফাঁসির দ-ের বিরুদ্ধে নিজামীর আপিলের শুনানি শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় দেবে আপিল বিভাগ। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, মুজাহিদ যে দ- পেয়েছেন, আলবদর বাহিনীর শীর্ষ নেতা হিসেবে নিজামীরও একই দ- প্রাপ্য।
বুদ্ধিজীবী হত্যায় দুই খুনির দ- কার্যকর অনিশ্চিত
বুদ্ধিজীবী হত্যায় ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির দ- হয়েছে দুই আলোচিত অপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল নায়ক ছিলেন এই দুইজন। তাদের এই নৃশংস অপরাধের জন্য তারা ‘শুধু এবং শুধুমাত্র’ ফাঁসির যোগ্য। তাদের মৃত্যুদ- না হলে তা হতো বিচারের ব্যর্থতা।
দ-িতদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে আছে সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন, সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হক, সাংবাদিক এ এন এম গোলাম মুস্তাফা, বিবিসির প্রতিবেদন নিজামউদ্দিন আহমদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, খ্যাতিমান চিকিৎসক ফজলে রাব্বি ও চিকিৎসক আলীম চৌধুরীকে তাদের নিজ নিজ বাসভবন থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে মিরপুর বধ্যভূমিসহ বিভিন্ন স্থানে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রসিকিউশনের এক সাক্ষীর সাক্ষ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, চৌধুরী মঈনুদ্দীন মুক্তিযুদ্ধের পর দুইবার বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। একবার জিয়াউর রহমানের আমলে আরেকবার এরশাদের আমলে। এ সময় তাদের পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয়। তিনি সে সময় পাকিস্তান দূতাবাসের গাড়িতে করে এসেছিলেন। এত নৃশংস খুনির জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দেওয়া লজ্জাজনক বলেও মন্তব্য করা হয় রায়ে।
আশরাফুজ্জামান খান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এবং চৌধুরী মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তারা দুইজনই গণমাধ্যমকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই বিচার মানেন না তারা। এ কারণে তারা কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেননি। পরে রাষ্ট্রপক্ষই তাদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিলও করা হয়নি এই দুই আলবদরের পক্ষ থেকে। বরং বিদেশে বসে ‘পারলে সরকার আমাদেরকে ধরে নিয়ে বিচার করুক’ এমন চ্যালেঞ্জও দিয়েছেন একাত্তরের দুই খুনি। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, দ-িতরা বিদেশে পলাতক। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রহণ করবে। - সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।