logo ১৭ মে ২০২৫
জামাতে নামাজ আদায়ের ফজিলত
মাওলানা আব্দুস সাত্তার
৩১ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:১১:০০
image




সালাত, আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ দু’আ, তাসবিহ, রহমত কামনা, ইস্তিগফার ও দুয়া, ইত্যাদি।



শারিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট রুকন ও জিকরসমূহকে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্ধারিত সময়ে আদায় করাকে নামাজ বলে। ঈমান ছাড়া অন্য চারটি রুকনের মধ্যে এটা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সার্বজনীন। নামাজকে দ্বীনের খুঁটি বলা হয়, খুঁটি ছাড়া যেমন ঘর হয় না সেরূপ নামাজ ছাড়াও দ্বীন পরিপূর্ণ হয় না।



হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন: ব্যক্তি এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য হলো নামাজ। অতএব যে নামাজ ছেড়ে দিল সে কুফরী করল। [নাসায়ি]



রাসুলুল্লাহ সা. আরো বলেছেন: কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার নামাজের হিসাব নেয়া হবে। যদি তা যথাযথ হয়, তবে সে সফল হলো এবং মুক্তি পেল। যদি তা সঠিক না হয় সে ধ্বংস হলো ও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। [নাসায়ি]



জামাতের গুরুত্ব, পরিপ্রেক্ষিত বর্তমান সমাজ



নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। ঈমান আনার পর আল্লাহর আনুগত্যের রশি গলায় ঝুলানো হলো কি না তার প্রথম পরীক্ষা হয়ে যায় নামাজের মাধ্যমে। আজান হওয়ার সাথে সাথে কালবিলম্ব না করে ঈমান আনয়নকারী ব্যক্তি যখন জামায়াতের সাথে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে গিয়ে নামাজে শামিল হয়, তখন বোঝা যায়, কালেমাপড়ুয়া ব্যক্তিটি আল্লাহর আনুগত্য তথা ইসলামের যাবতীয় অনুশাসন মেনে চলতে প্রস্তুত।



বাস্তব জীবনে নিজেকে মুসলমান হিসেবে প্রমাণ করতে চাইলে অবশ্যই নামাজ আদায় করতে হবে। ঈমানের দাবী পূরণের সর্বোতকৃষ্ট মাধ্যম হচ্ছে নামাজ। যার নামাজ নেই তার পরিপূর্ণ ঈমান নেই। আমাদের সমাজে অনেককে বলতে শোনা যায়, নামাজ পড়ছি না বলে কি আমি মুসলমান নই? নামাজ পড়া না পড়া ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা কত ভয়ঙ্কর কথা। ইসলাম সম্পর্কে কী পরিমাণ দীনতা থাকলে এ ধরনের কথা বলা যায়, তা সহজেই অনুমেয়। অথচ রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে নামাজ ত্যাগ করল সে কুফরী করল। [তাবরানি] উম্মে আয়মান রা. হতে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রাসুল সা. ইরশাদ করেন- ‘তোমরা নামাজ পরিত্যাগ করো না। কেননা, যে নামাজ পরিত্যাগ করে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের জিম্মাদারি হতে সে মুক্ত হয়ে যায়। [মুসনাদে আহমদ ও বায়হাকি] যারা নামাজ পড়ে না অথবা নামাজে অবহেলা, গড়িমসি বা শিথিলতা প্রদর্শন করে তাদের ব্যাপারে কুরআন বলছে: সে সব শ্রেণীর লোকদের জন্য নামাজ অত্যন্ত কঠিন কাজ, যারা আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করতে প্রস্তুত নয়। [সুরা বাকারা-৪৫]



আমাদের জানা দরকার, নামাজ পড়া বা না পড়া ব্যক্তিগত ব্যাপার তো নয়-ই, নামাজ একা একা আদায় করারও সুযোগ নেই। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত: রাসুলুল্লাহ সা. বলেন: যে ব্যক্তি আজান শুনে ওজর ছাড়া মসজিদে না গিয়ে একাকী নামাজ আদায় করল, তার নামাজ কবুল করা হবে না। লোকেরা বলল, ওজর কী? রাসুলুল্লাহ সা. বললেন : ভয় ও রোগ। [আবু দাউদ] এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, নামাজ একাকী নয়, বরং জামায়াতের সাথেই পড়তে হবে। হযরত জিবরাইল আ. রাসুলুল্লাহ সা.-কে নামাজের শিক্ষা দেয়ার সময়ও জামায়াতের ব্যবস্থাপনার সাথে নামাজ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া কুরআনেও যতবার নামাজের প্রসঙ্গ এসেছে ততবারই নামাজ কায়েম করার কথাই এসেছে। নামাজ কায়েম একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। নামাজ কায়েমের একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করা। কেউ ব্যক্তিগতভাবে নামাজ আদায় করলে নামাজ কায়েম হয়েছে এ কথা বলা যাবে না।



সুরা বাকারার প্রথম পাঁচটি আয়াতে মুত্তাকিদের যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে সেখানে দ্বিতীয় গুণটি হলো: যারা (ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে) নামাজ প্রতিষ্ঠা করে। এখানেও নামাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। আর কোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তা একা একা সম্ভব নয়, সেখানে সঙ্ঘবদ্ধতা তথা জামায়াত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।



পবিত্র কুরআনের সুরা আল কলমের ৪২ ও ৪৩ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যেদিন কঠিন সময় উপস্থিত হবে এবং লোকদের সিজদা করার জন্য ডাকা হবে, তখন তারা সিজদা করতে পারবে না। তাদের দৃষ্টি হবে নিচু, লাঞ্ছনা-অপমান তাদের ওপর চেপে বসবে। তারা যখন সুস্থ ও নিরাপদ ছিল (দুনিয়াতে), তখন তাদের সিজদা করার জন্য (জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য) ডাকা হতো (কিন্তু তারা তাতে সাড়া দিত না)।’ আয়াত দুটিতে কিয়ামতের চিত্র বর্ণিত হয়েছে। হযরত কা‘ব আল আহ্বার রা. বলেন, এ আয়াত কেবল নামাজের জামাতে অনুপস্থিত থাকা লোকদের প্রসঙ্গে নাজিল হয়েছিল। তাবেয়িনদের ইমাম সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব রহ. বলেন, তারা আজান শুনত অথচ সুস্থ-সবল থাকা সত্ত্বেও জামাতে হাজির হতো না।



আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আর নামাজ কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং নামাজে রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।’ [বাকারা-৪৩] আর এর প্রতি অবমাননা এবং তা আদায়ে অলসতা মুনাফিকের আলামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।



ইরশাদ হচ্ছে- ‘মুনাফিকরা অবশ্যই প্রতারণা করছে আল্লাহর সাথে অথচ তারা প্রকারান্তরে নিজেদেরই প্রতারিত করছে । বস্তুতঃ তারা যখন নামাজে দাড়ায় তারা দাড়ায় একান্ত শিথিলভাবে।’ [সুরা নিসা-১৪২] অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- ‘তারা নামাজে আসে আলস্যভরে।’ [সুরা তওবা : ৫৪]



জামাআতের সাথে নামাজ পড়ার আগ্রহ ও উৎসাহ প্রদানে এবং তার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, অপর দিকে জামাআত বর্জন ও জামাতের সাথে নামাজ আদায়ে অবহেলাকারীর বিরুদ্ধেও তার অবহেলার ক্ষেত্রে সতর্কতকারী হাদিস এসেছে।



জামাআতে নামাজ আদায়ের ফজিলত ও ফলাফল



জামা‘আতে নামাজ আদায়ের ফজিলত ও মর্যাদা অনেক। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ: ১- নামাজ পাপমোচন এবং মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ - আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আমি কি তোমাদের এমন বিষয় জানাব না, যার মাধ্যমে আল্লাহ গুনাহসমূহ মোচন করে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? সাহাবায়ে কিরাম রা. বললেন : হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল ! তিনি বললেন : তা হচ্ছে কষ্টের সময়ে যথাযথভাবে অযু করা, মসজিদের দিকে বেশি বেশি পদচারণ করা এবং এক নামাজের পর অন্য নামাজের অপেক্ষায় থাক। এটাই হল সীমান্ত প্রহরা। [তিরমিযি : ৪৮] অন্য হাদিসে এসেছে : আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে বর্ণিত , রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি জামা‘আতের সাথে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যায়, তার আসা এবং যাওয়ায় প্রতি পদক্ষেপে গুনাহ মিটে যায় এবং প্রতি পদক্ষেপে নেক ‘আমল লেখা হয়। [আহমাদ : ৬৩১১]



২- নামাজ বান্দাকে শয়তান থেকে হিফাজত করে এবং তার প্ররোচনা থেকে নিরাপদ রাখে



-আবূ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি : যে গ্রামে বা মরুপ্রান্তরে তিনজন লোক অবস্থান করে অথচ তারা জামা‘আত কায়েম করে নামাজ আদায় করে না, শয়তান তাদের উপর চরে বসে। কাজেই জামা‘আতে নামাজ আদায় করা একান্ত অপরিহার্য। কারণ বাঘ দলছুটা বকররীটিকেই উদরস্থ করে। [আবূ দাউদ : ৪৬০]



৩- নিফাক থেকে পরিত্রাণ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি



– রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : এশা ও ফজরের নামাজ মুনাফিকদের নিকট সবচেয়ে বেশি ভারী বোঝা বলে মনে হয়। [বুখারি ও মুসলিম : ১৪১১] রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: যে ব্যক্তি একাধারে চল্লিশ দিন পর্যন্ত প্রথম তকবীরের সাথে জামা‘আতে নামাজে আদায় করে, তার জন্য দু’টি মুক্তি রয়েছে : জাহান্নাম থেকে মুক্তি আর নিফাক থেকে মুক্তি। [তিরমিযি : ২২৪] ইবনে মাসউদ রা. বলেন : এক সময় আমাদের অবস্থা এমন ছিল যে, একমাত্র প্রকাশ্য মুনাফিক ব্যতীত আর কেউ জামা‘আতে নামাজ আদায় করা থেকে বিরত থাকেনি। [মুসলিম : ১০৪৬]



৪- কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ



-বুরায়দাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: অন্ধকার রাতে মসজিদে গমনকারীদের জন্য ক্বিয়ামত দিবসে পূর্ণ নূরের সুসংবাদ দাও। [আবূ দাউদ : ৪৪৭]



৫- জামা‘আতে নামাজ আদায়কারী আল্লাহর হিফাজতে



-উমামাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তিন ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মায়, তন্মধ্যে মসজিদে গমনকারী ব্যক্তি। সে আল্লাহর জিম্মায় থাকে ; এমনকি তার মৃত্যু হলে তাকে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অথবা তাকে ছাওয়াব বা গনীমত প্রদান করে (বাড়িতে) ফিরিয়ে দিবেন। [আবূ দাউদ : ২১৩৩]



তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি সকালের নামাজ জামা‘আতের সাথে আদায় করে, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকে। যে আল্লাহর জিম্মাকে অবমাননা করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। [দারেমী : ৩৩৬৭] একটু ভেবে দেখুন ! যে ব্যক্তি সকল ফরজ-নামাজ জামা‘আতের সাথে মসজিদে আদায় করে তার অবস্থা কত কল্যাণময় হতে পারে ?



৬- ঘরে নামাজ আদায়ের চেয়ে মসজিদে নামাজ আদায় অধিক ছাওয়াবের উপযোগী বানায়



– রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : জামা‘আতের সাথে নামাজ আদায় ঘরে বা বাজারে নামাজের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি ছাওয়াবের অধিকারী বানায়। আর এটা এভাবে যে, যখন সে অযু করে খুব সুন্দর করে এবং (নামাজের জন্য) মসজিদের উদ্দেশো বের হয়। এ অবস্থায় সে যতবার পা ফেলে, প্রতিবারের পরিবর্তে একটি করে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় এবং একটি করে গুনাহ ক্ষমা করা হয়। তারপর যখন সে নামাজ আদায় করতে থাকে, ফেরেস্তাগণ তার জন্য রহমতের দু‘আ করতে থাকেন। যতক্ষণ সে নামাজের জায়গায় বসে থাকে ফেরেশতারা তার জন্য এই বলে দু’আ করেন যে, হে আল্লাহ ! এই ব্যক্তির উপর রহমত নাজিল কর। হে আল্লাহ ! এর উপর দয়া কর। আর যতক্ষণ সে নামাজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, ততক্ষণ সে নামাজের অর্ন্তভুক্ত থাকে।’ [বুখারি ও মুসলিম : ৬১১]  - আবূ উমামাহ রা থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি নিজ গৃহ থেকে পবিত্র হয়ে ফরজ নামাজের জন্য বের হয়, তার ছাওয়াব একজন হজ্জ পালনকারীর ছাওয়াবের সমান। [আবূ দাউদ : ৪৭১]



– জাবির বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : বনু সালামাহ গোত্র মসজিদের কাছে স্থানান্তরিত হতে মনস্থ করল। তিনি বলেন : জায়গা খালি ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এ খবর পৌছলে তিনি তাদেরকে বললেন : হে বনী সালামাহ ! তোমরা তোমাদের বর্তমান বাসস্থানগুলো ধরে রাখ। মসজিদে গমনাগমনের পদক্ষেপগুলো তোমাদের জন্যে লিখে রাখা হবে। তারা বললেন : স্থানান্তরিত হওয়া আমাদের কিই-বা আনন্দ দিতে পারে ! [মুসলিম: ১০৬৯]



৭. জামা‘আতে নামাজ আদায়কারী কিয়ামত দিবসে আরশের নীচে ছায়া পাবেন



– সাহাবি আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা আরশের নিচে ছায়া দান করবেন ঐ দিন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না তাদের মধ্যে একজন হল ঐ ব্যক্তি যার হৃদয় মসজিদের সাথে লাগানো। অর্থাৎ নামাজ ও জামা‘আতের প্রতি অবিচ্ছেদ্যভাবে আগ্রহী। [বুখারি ও মুসলিম : ৬২০]



৮. আল্লাহ তা‘আলা মুসল্লির আগমনে খুশী হন



রাসুল সা. বলেন : তোমাদের মধ্যে যদি কেউ পরিপূর্ণভাবে অযু করে, তারপর শুধুমাত্র নামাজের উদ্দেশ্যেই মসজিদে আসে, তবে আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি এমন খুশি হন যেরূপ খুশি হয় নিরুদ্দেশ ব্যক্তির হঠাত ফেরে আসায় তার পরিবারের সদস্যরা । [ইবনু খুযাইমাহ : ৮১৩১]



৯. জামাতে নামাজ একাগ্রতা অর্জন ও অন্তর বিগলিত হওয়ার উপকরণ



কোন মুসলিম যখন মসজিদে প্রবেশ করে তখন দুনিয়ার সকল ব্যস্ততা থেকে সে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়, অতঃপর সে মসজিদে আগত মুসল্লিদের আল্লাহর সামনে রুকু-সিজদারত অবস্থায় দেখে। জিকির এবং কুরআন তিলাওয়াত প্রত্যক্ষ করে। আল্লাহর কালাম স্বকর্ণে শোনার সুযোগ পায়। এ সব থেকে সে বুঝতে পারে এ ময়দান আল্লাহ ও তার জান্নাত লাভের উদ্দেশে প্রতিযোগিতার ময়দান। আর এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাকারীরাই আন্তরিকতা ও একাগ্রতার সাথে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হয়।



১০. জামাতের সাথে নামাজ আদায় মুসলমানদের মাঝামাঝে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও মহব্বত সৃষ্টি করে।



জামাতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মুসলমানগণ দিন ও রাতে পাঁচবার পরস্পর মিলিত হয়। তাদের মাঝে সালাম বিনিময় হয়। একে অপরের খোজ-খবর নেয়। হাসিমুখে একে অন্যের সাথে সাক্ষাত করে। এ সব বিষয় পারস্পরিক মহব্বত, ভালোবাসা এবং একে অপরের কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দেয়।



১১. আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের নিকট মুসল্লীদের নিয়ে গর্ব করেন



– আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর রা. থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, তোমাদের প্রভু আসমানের দরজাসমূহের একটি দরজা খুলেছেন। সেখানে তোমাদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করে বলেন, দেখ আমার বান্দাদেরকে, তারা একটি ফরযজ আদায় করেছে এবং আরেকটি ফরযের জন্য অপেক্ষা করছে। [আহমাদ, ইবনে মাজাহ্  : ৭৯৩]



১২. এতে অজ্ঞ লোকের জন্য রয়েছে শিক্ষা এবং বিজ্ঞলোকের জন্য রয়েছে উপদেশ



যে ব্যক্তি জামাতের সাথে মসজিদে নামাজ আদায় করে, সে নামাজের আহকাম, আরকান, সুন্নাত ইত্যাদি বিষয়গুলো আহলে ইলম থেকে শিখতে পারে । আহলে ইলমের নামাজ দেখে উক্ত ব্যক্তি নিজের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করে নেয়। এমনিভাবে ওয়াজ-নসীহত শুনে ভাল কাজে উৎসাহিত হয়, মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকে। এতে সে অনেক উপকৃত হয়, যা ঘরে নামাজ আদায় করে আদৌ সম্ভব নয়।



১৩. আল্লাহ তা‘আলা জামাতে নামাজ আদায়ে মুগ্ধ হন



কতই না সৌভাগ্য ঐ ব্যক্তির, যার আমল দেখে সৃষ্টিকর্তা মুগ্ধ হন।



– ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছি : নিশ্চই আল্লাহ তা‘আলা জামাতে নামাজ আদায় করাতে মুগ্ধ হন। [আহমাদ]



১৪. জামাতে নামাজ আদায়ের ছাওয়াব লিখা এবং আসমানে উঠানোর ব্যাপারে ফেরেশতাগণ বির্তক করেন- ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : একরাতে আল্লাহ তা‘আলা এক জ্যোর্তিময় অবস্থায় আমার নিকট এলেন। তিনি বলেন, সম্ভবতঃ তা নিদ্রায় হবে। এসে বললেন : হে মুহাম্মদ ! ঊর্ধ্বজগতে কি নিয়ে বিতর্ক হয় তুমি জান? আমি বললাম না। তিনি বলেন : অতঃপর তিনি আমার হাত ধরলেন, আমি তার শীতলতা আমার বুকে অনুভব করলাম। (অথবা বললেন আমার গলায়) তখন বুঝতে পারলাম আসমান জমিনের মাঝে কি হচ্ছে? তিনি বললেন : হে মুহাম্মদ ! তুমি জান উপর আসমানে কি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে ? আমি বললাম : হ্যাঁ, কাফফারা সম্পর্কে। কাফফারা হল নামাজের পর মসজিদে অবস্থান করা। পায়ে হেঁটে জামাতের জন্য গমন করা, কষ্টের সময়েও পুরোপুরি অযু করা। যে ব্যক্তি এটা করবে সে কল্যাণময় জীবন যাপন করবে এবং তার মৃত্যু মঙ্গলময় হবে। তার গুনাহগুলো মিটে এমন হবে যেন সে তার মায়ের উদর থেকে আজই জন্মগ্রহণ করল। [তিরমিযি : ৩১৫৭]



১৫. এটা মানুষকে ভাল কাজের প্রতিযোগিতায় অভ্যস্ত করে এবং নফলের প্রতি উৎসাহিত করে



– আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যদি লোকেরা জানত আজান এবং প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর মধ্যে কি আছে, আর লটারীর মাধ্যম ছাড়া তা অর্জন করার অন্য কোন পথ না থাকত, তাহলে তারা অবশ্যই লটারী করত। যদি তারা জানত গরমের সময় ভর দুপুরে মসজিদে যাওয়ার কি ফজিলত, তাহলে অবশ্যই তার জন্যে প্রতিযোগিতা করত। যদি তারা এশা ও ফজরের নামাজের মধ্যে কি মর্যাদা আছে জানতে পারত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দু’টি সময়ের নামাজে শামিল হত। [বুখারি ও মুসলিম: ৫৮০]



অনুরূপভাবে নামাজের সাথে নামাজ আদায় ব্যক্তিকে নফল নামাজ আদায়েও অভ্যস্ত করে তুলে। যে ব্যক্তি নামাজ কায়েমের পূর্বে মসজিদে আসে, সে তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায়ের সুযোগ পায়, সুন্নাত পড়ার সুযোগ পায়, কুরআন তিলাওয়াত, দু‘আ ইসতিগফার ইত্যাদির সুযোগ পায়। আর কিছু না করলেও অন্তত নামাজের অপেক্ষায় চুপ করে বসে থাকতে পারে। আর এ সময় ফেরেশতাগণ তার জন্য এই বলে দু‘আ করতে থাকে যে, হে আল্লাহ ! তুমি তাকে ক্ষমা কর, তার প্রতি রহম কর। আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমাদের কোন ব্যক্তি যখন নামাজের জন্য নিজের মুসল্লায় অপেক্ষা করতে থাকে, তখন ফেরেশতাগণ তার জন্য দু‘আ করতে থাকে যতক্ষণ তার অযু ভঙ্গ না হয়। ফেরেশতাগণ বলতে থাকেন আল্লাহ ! তুমি একে ক্ষমা কর, হে আল্লাহ ! তুমি এর উপর রহম কর। [মুসলিম : ১০৬৩]



নামাজের জন্য দৈনিক সম্মিলন মুসলিমদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ, সহযোগিতা এবং সুন্দর সম্পর্ক স্থাপনের প্রশিক্ষণ দেয়। এটি মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতা, পরিচিতি, যোগাযোগ এবং প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।



জামাতের সহিত নামাজ মুসলিমদের মধ্যে সাম্য, আনুগত্য, সততা এবং প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। কেননা ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, ছোট-বড় একই স্থানে ও কাতারে দাঁড়ায়, যা দ্বারা আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়। দ্বন্দ্ব, বিচ্ছিন্নতা, বর্ণ-জাতি, স্থান ও ভাষাগত গোঁড়ামি বিলুপ্ত হয়।



জামাতের সহিত নামাজ কায়েমের মধ্যে রয়েছে মুসলিমদের সংস্কার, ঈমানের পরিপক্কতা ও তাদের মধ্যে যারা অলস তাদের জন্য উৎসাহ প্রদানের উপকরণ। জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন প্রকাশ পায় এবং কথায় ও কর্মে মহান আল্লাহর প্রতি আহ্বান করা হয়, জামাতের সাথে নামাজ কায়েম ঐ সকল বৃহৎ কর্মের অন্তর্ভুক্ত যা দ্বারা বান্দাগণ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে এবং এটি মর্যাদা ও নেকি বৃদ্ধির কারণ।



সাম্প্রতিক পরিস্থিতি রীতিমতো ঘাবড়ে দেবার মতো। বর্তমানে অনেক মুসলমানই নামাজ আদায়ে দারুণভাবে উদাসীন। জুমার নামাজে মসজিদে উপচে-পড়া ভীড় হচ্ছে ঠিকই তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মসজিদের অধিকাংশ জায়গাই থাকে মুসুল্লিশূন্য। নামাজ বিষয়ে মুসলমানদের অবহেলার আদৌ কোন কারণ থাকতে পারে না। নামাজ বিষয়ে অবহেলার অর্থ ঈমানের একটি মৌলিক দাবি , ইসলামের একটি প্রধানতম নিদর্শন বিষয়ে অবহেলা । আর যারা এ ধরনের অবহেলা প্রদর্শনে অভ্যস্ত তাদের অপেক্ষায় থাকবে মর্মন্তুদ শাস্তি, কঠিন নারকীয় আজাব।



আমাদের পূর্বপুরুষগণ জামা‘আতভুক্তিতে নামাজ আদায়ের প্রতি খুবই যত্নশীল ছিলেন। তাদের নিকট এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম ; এমনকি জামাত ছুটে গেলে খুবই মর্মাহত হতেন। তারা মনোকষ্টে অশ্রু ঝরাতেন। সমবেদনা জানাতেন একে অপরকে জামাত ছুটে যাওয়ার কারণে।