মাতৃভাষা চর্চা ও ইসলাম
জহির উদ্দিন বাবর
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১৯:০৪:৫৯

মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানবসভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে দান করেছেন ভাষার নেয়ামত। সব প্রাণিরই নিজ নিজ ভাষা আছে, নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময়ের মাধ্যম জানা আছে; কিন্তু মানুষের ভাষার মতো এত স্বচ্ছন্দ, সহজাত ও সমৃদ্ধ ভাষা অন্য কোনো প্রাণির মধ্যে নেই। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, সেরা জীব হওয়ার মাহাত্ম্য।
প্রথম মানুষ হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টির পর সর্বপ্রথম তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, 'হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করার পর যত ভাষা দুনিয়ায় আছে, সবকিছুর জ্ঞান তাকে তিনি দান করেছেন।' আল্লাহর নেজাম হলো, প্রতিটি মানুষই ভাষার নিয়ামতসহ জন্মগ্রহণ করে। দুনিয়ার আলো-হাওয়ায় চোখ খুলেই মায়ের ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়। একসময় নিজেও মায়ের মতো করে, মায়ের ভাষায় কথা বলা এবং স্বচ্ছন্দে মনের ভাব প্রকাশে পারঙ্গম হয়ে ওঠে। এভাবেই মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়েছে ভাষা। আর মানুষের ভিন্নতার কারণে ভাষায়ও এসেছে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য। সময়, স্থান ও মানুষের এই বিচিত্রতার কারণেই পৃথিবীতে অস্তিত্ব লাভ করেছে কয়েক হাজার ভাষা।
মর্যাদার বিচারে সব ভাষাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রত্যেকের কাছে তার মায়ের ভাষা সেরা। মহান স্রষ্টা নিজেও মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুগে যুগে মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষায় যোগ্য ও দক্ষ করে পাঠিয়েছেন। যখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, তা নবীদের মাতৃভাষায় করেছেন। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে_ 'আমি সব রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তাদের আমার বাণী স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে।' (সূরা ইব্রাহিম)
প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জ্ঞান না থাকার পরও আল্লাহর রাসূলের মুখনিঃসৃত কথাগুলো ছিল ভাষাশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে, ভাষা-সাহিত্যের মানদণ্ডে অত্যন্ত উঁচুমাপের। আজও আল্লাহর রাসূলের মুখ দিয়ে বের হওয়া হাদিসগুলো সাহিত্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। প্রত্যেক নবী-রাসূলের ভাষাকেই আল্লাহতায়ালা সুমিষ্ট ও সাবলীল করেছিলেন, যাতে লোকরা সহজেই বুঝতে পারে। আর দাওয়াতে দ্বীনের কৌশলও হলো সুমিষ্ট ও বোধগম্য ভাষায় দাওয়াত উপস্থাপন করা। এ জন্য একজন দা'য়ীর বড় গুণ হলো, তার মাতৃভাষায় যথার্থ যোগ্যতা অর্জন করা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে আমরা গর্বিত। পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যমণ্ডিত ভাষাভাষী আমরা। মুসলিম অধ্যুষিত বিশাল এই জনপদের ভাষা হিসেবে বাংলার সঙ্গে ইসলামী ভাবধারা ও আবহ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। উৎপত্তিগতভাবে যা-ই হোক, মুসলিম সমাজে প্রচলিত ভাষাই মুসলমানদের ভাষা। সে ভাষা মায়ের মতোই আপন, গভীর মমতায় নিবিষ্ট।
নিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সে ভাষা চর্চা করলে তা ইবাদত হিসেবেই গণ্য হবে। কোনো নবী বা আসমানি কিতাব যদি এ জনপদে অবতীর্ণ হতো তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তা বাংলাতেই হতো। স্রষ্টার দান হিসেবে ভাষা সবই সমান।
বিশেষ কোনো কারণে কোনো কোনো ভাষা মহীয়ান হয়ে ওঠে। যেমন_ আরবি ছিল জাহেলি যুগের বর্বর মানুষের ভাষা, আবু জাহেল ও আবু লাহাবদের ভাষা; কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং পবিত্র কোরআনের স্পর্শ পেয়ে সে ভাষা শ্রেষ্ঠত্বের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। অবহেলিত ও ঐতিহ্যহীন অনেক ভাষা চর্চার ব্যাপকতার কারণে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক ভাষাভাষীর দায়িত্ব হলো, নিজ নিজ মাতৃভাষাকে চর্চার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করে তোলা। আমাদেরও উচিত, হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রিয় ভাষা বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মহীয়ান করে তোলার জন্য আকুল প্রয়াস চালানো।
(ঢাকাটাইমস/২০ফেব্রুয়ারি/জেবি)