logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
মগবাজার উড়াল সড়কে বদলে গেছে রাজধানীর চিত্র
তানিম আহমেদ
২৭ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:৩৬:৫৩
image



বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মোস্তফা কামাল। থাকেন বনানীতে। অফিস মতিঝিলে। প্রতিদিন সকালে কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক ব্যবহার করে অফিস যেতে যেতে দুই ঘণ্টা, কখনো বা তার চেয়ে বেশি। ফেরার পথে সময় লাগে আরও বেশি। আট ঘণ্টা অফিস করে যতটা না ক্লান্ত হতেন, তার চেয়ে বেশি ক্লান্তি লাগত পথের যানজট। মোস্তফা কামালের এই পথের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়েছে। আসা-যাওয়ার ভোগান্তি অনেকটাই কমেছে তার। সাতরাস্তা মোড় থেকে রমনা পর্যন্ত উড়াল সড়ক চালু হওয়ার পর আর ফার্মগেট-শাহবাগ হয়ে মতিঝিল যান না তিনি। মহাখালী হয়ে তেজগাঁও হয়ে মগবাজার উড়াল সড়ক ব্যবহার করে আসা-যাওয়া করেন তিনি। আর পথের সময় তার কমে গেছে অর্ধেকেরও বেশি। আগে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টায় আসা-যাওয়া করতে হলেও এখন সময় লাগছে দুই ঘণ্টারও কম।






মোস্তফা কামাল এই সময়কে বলেন, ‘মগবাজার ফ্লাইওভার চালু আমাদের জন্য অনেক স্বস্তি নিয়ে এসেছে। এখন এই পথ ব্যবহার করে কম সময়ে অফিসে যেতে এবং অফিস হতে বাসায় ফিরতে পারি। তবে সকাল বেলা ফ্লাইওভারের হলি ফ্যামিলি অংশে নামার পর কিছুটা জটলায় পড়তে হয়।’মোস্তফা কামালের মতো অনেকেই এখন আশপাশের অন্য সড়কের বদলে মগবাজার হয়ে চলাচল করেন। ফলে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের ওপর চাপ অনেকটাই কমেছে।






কথা হয় আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী সালাহউদ্দিন তানভীরের সঙ্গে যিনি ফ্লাইওভার চালু হওয়ার আগেও মগবাজার হয়েই যেতেন। তিনি জানান, আগে সাতরাস্তা-মগবাজার সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি তেমন চলাচল করতে দেখা যায়নি। কিন্তু ফ্লাইওভার চালু হওয়ার এ সড়কটিতে ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচল অনেক বেড়েছে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ হাতিরঝিল জোনের সহকারী কমিশনার আবু ইউসুফ এই সময়কে বলেন, ‘ফ্লাইওভার চালু হওয়ায় এ এলাকায় যানজট শূন্য পর্যায়ে। বিশেষ করে আগে যেখানে মগবাজার রেলক্রসিংয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো, এখন তা হচ্ছে না।’






রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ ও রামপুরা এলাকার যানজট নিরসনে ২০১৩ সালে শুরু হয় এই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ। তিন বছরের মাথায় গত ৩০ মার্চ সাতরাস্তা থেকে রমনার হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত অংশ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। মোট আট দশমিক ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই উড়াল সড়কটির একটি অংশ বাংলামোটর থেকে মৌচাক হয়ে শান্তিনগর এবং মৌচাক হয়ে রামপুরার দিকে যাবে আরেকটি অংশ।






২০১১ সালে শুরু হয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে তিন দফা সময় বাড়িয়ে উড়াল সড়কটি পুরোপুরি চালু হতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে সরকার। ভারতের সিমপ্রেকস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও নাভানার যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান সিমপ্লেক্স নাভানা জেভি এবং চীনা প্রতিষ্ঠান দ্য নাম্বার ফোর মেটালার্জিক্যাল কনস্ট্রাকশন ওভারসিজ কোম্পানি-এমসিসিসি ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন এই সড়কটি নির্মাণে কাজ করছে।






চার লেনের এই উড়াল সড়কে উঠানামার জন্য তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, সোনারগাঁও হোটেল, মগবাজার, রমনা (হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল) বাংলামোটর, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও শান্তিনগর মোড়ে লুপ বা র‌্যাম্প রাখা হয়েছে। আংশিক চালু হওয়ার পরই সাতরাস্তা-মগবাজারের দুঃসহ যানজট সহনীয় পর্যায়ে নেমেছে। আর পুরোপুরি চালু হলে মৌচাক, রামপুরা, মালিবাগ, শান্তিনগর এলাকার যানজট নিরসনের আশা করছে সরকার।






প্রভাব পড়েছে আশপাশের সড়কেও






যানজটের কারণে মহাখালী হয়ে বা মিরপুর থেকে আসা গাড়িগুলো মগবাজার হয়ে চলত না বললেই চলে। গুলশান থেকে আসা গাড়িগুলোও এই পথ এড়িয়ে সোনারগাঁও ক্রসিং দিয়ে শাহবাগের দিকে যেত। যে গাড়িগুলো এই পথে চলত উড়াল সড়কটির কাজ চলাকালে সেগুলোও পারতপক্ষে এড়িয়ে চলত পথটি। ফলে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ে দিনভর দুঃসহ যানজট লেগে থাকত। কিন্তু মগবাজার উড়াল সড়কের একাংশ চালুর পর গাড়িগুলোর চলার সেই চেনাপথ পাল্টে যাচ্ছে। মহাখালী, ফার্মগেট হয়ে শাহবাগ বা গুলিস্তানের দিকে যেত যেসব প্রাইভেটকার সেগুলোর একটি বড় অংশই এখন সাতরাস্তা হয়ে মগবাজার উড়াল সড়ক ব্যবহার করে রমনা দিয়ে শাহবাগ বা গুলিস্তানের দিকে অবলীলায় চলে যেতে পারছে। ফলে মহাখালী থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত সড়কে গাড়ির চাপ বেড়েছে অনেক।






আবার মিরপুর-মোহাম্মদপুর থেকে আসা যেসব গাড়ি বিজয় সরণি ক্রসিং ব্যবহার করে ফার্মগেটের দিকে যেত সেগুলোর একটি অংশ এখন বিজয় সরণি উড়াল সড়ক ব্যবহার করে ডান দিকে মোড় নিয়ে সাতরাস্তা-মগবাজার উড়াল সড়ক ব্যবহার করে রমনা হয়ে শাহবাগ বা মৎস্য ভবন বা কাকরাইল হয়ে গুলিস্তানের দিকে চলে যাচ্ছে। ফলে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ের দুঃসহ যানজট লাঘব হয়েছে অনেকটাই। 






ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ রমনা জোনের সহকারী কমিশনার আবদুল্লা হিল কাফি এই সময়কে বলেন, ‘মগবাজার ফ্লাইওভারের একাংশ চালু হওয়ার পর সড়কটিতে গাড়ির চাপ অনেক বেড়েছে। আগে গুলশান, বনানী এলাকার গাড়ি ভিআইপি সড়ক (কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ) ব্যবহার করত কিন্তু ফ্লাইওভার চালু হওয়ায় তারা এ সড়ক ব্যবহার করছে এতে ভিআইপি সড়কের ওপর থাকা চাপও অনেক কমেছে। ফ্লাইওভার থেকে নামার কাকরাইল সড়কটি সবসময় সচল করতে ট্রাফিকের নজরদারি সবসময়ই আছে। এজন্য আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি।’আবার যারা মগবাজার হয়ে কিন্তু নিচের সড়ক ব্যবহার করে চলেন তারাও আগের চেয়ে কম সময়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন। কারণ, ওপর দিয়ে চলছে গাড়িগুলোর একাংশ। ফলে নিচের অংশে গাড়ির চাপ অনেক কম।






গাজীপুর থেকে ঢাকায় চলাচলকারী প্রভাতী-বনশ্রী পরিবহনের চালক সামছুল আলম বলেন, ‘আগে সাতরাস্তা থেকে মগবাজার পার হতে লাগত এক ঘণ্টা। আর এখন দুই মিনিটেই এ সড়ক পার হওয়া যায়। তবে এখন সকাল বেলা হলি ফ্যামিলি অংশে নামতে গেলে যানজটের মুখে পড়তে হয়। এ যানজট অফিসার্স ক্লাব মোড় পর্যন্ত হয়। তবে সেটা বেশিক্ষণ থাকে না।’






সাতরাস্তা-মহাখালী সড়ক সংস্কার জরুরি






সাতরাস্তা থেকে মগবাজার হয়ে উড়াল সড়ক ব্যবহারের ভোগান্তি অনেকটাই কমলেও উল্টোপথে যানবাহনের চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু তিব্বত মোড়ের পর থেকে গুলশান লিংক রোড পর্যন্ত এই সড়কের রাস্তার বা পাশে বাস দাঁড় করিয়ে রাখে চালকরা। আবার লিংক রোড থেকে মহাখালী পর্যন্ত সড়কের বাঁ পাশ ভাঙাচোরার কারণে ব্যবহার করা কঠিন। আবার মহাখালী মোড়ে দিনভর যানজটের অবসান হয়নি। এর কারণ মূলত বনানী মোড়। গুলশান থেকে মহাখালী ডিওএইচএসগামী গাড়ি চলাচলের জন্য বিমানবন্দর সড়কটি আটকে রাখাই মূলত এই দীর্ঘ যানজটের কারণ। আবার গুলশান থেকে বিমানবন্দর সড়কে গাড়ি ছাড়ার সময়ও কাকলি মোড় থেকে বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এর প্রভাব পড়ে মহাখালী ছাড়িয়ে কখনো কখনো তিব্বত মোড় পর্যন্ত।






সমাধান লুকিয়ে কাকলি মোড়ে






ওই সড়কে কাজ করেন এমন একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলছেন, গুলশান থেকে ডিওএইচএসগামী গাড়িগুলো সৈনিক ক্লাব হয়ে ঘুরে এলেই বিমানবন্দর সড়কটি সব সময় চালু রাখা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ডিওএইচএসগামী গাড়িগুলো সহজেই বাঁয়ে ঢুকে যেতে পারবে। আর এ ক্ষেত্রে বনানী মোড়ে এই গাড়িগুলোকেও আটকে থাকতে হবে না।






এভাবে সৈনিক ক্লাবে একটা ইউলুপ থাকলেই বিমানবন্দর সড়কটি সার্বক্ষণিক চালু রাখা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে তিব্বত থেকে মহাখালী হয়ে বনানী পর্যন্ত সড়কে দুঃসহ যানজটের অবসান সম্ভব। একাধিক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেছেন, একইভাবে বিমানবন্দর সড়কের দীর্ঘ যানজটের সমাধানও লুকিয়ে আছে মহাখালী মোড়ে। মহাখালী হয়ে সাতরাস্তার দিকে যাওয়ার সড়কটির পদে পদে প্রতিবন্ধকতা। মোড়ে বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলায় পেছনে লাগে দীর্ঘ যানজট। আবার এই সড়কে আছে হিউম্যান হলারের স্ট্যান্ডও। সড়কে বসে থাকে হকাররাও। 






উড়াল সড়কের বাকি কাজ শেষ কবে?






২০১৫ সালের মধ্যে গোটা উড়াল সড়কের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও বারবার নকশা পরিবর্তনসহ নানা জটিলতায় কাজ এগিয়ে নিতে বিলম্ব হয়েছে। আর তিন দফায় সময় বাড়ানোর পর এখন ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা জটিলতায় বারবার মেয়াদ বাড়াতে হলেও মেয়াদের আগেই কাজ শেষ করার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী তারা। আর সাতরাস্তা-রমনা অংশের মতোই বাংলামোটর থেকে মৌচাক পর্যন্ত অংশের কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা চলছে। এখন সড়কের ওপরের অংশের কাজ চলছে। বাকি কাজ শেষ করতে আর দীর্ঘসূত্রতা হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মাটির নিচে বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইনের কারণে নকশা পরিবর্তন করতে গিয়ে কাজে বিলম্ব হয়েছে। তবে মাটির নিচের কাজ পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে। অল্প কিছু এলাকা ছাড়া বাকিগুলোতে পিলার নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেছে। সৌজন্যে: সাপ্তাহিক এই সময়