logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
তীব্র দাবদাহ কি শুধুই জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব?
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
১৯ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:৩৫:২৫
image




খাঁখাঁ রদ্দুর। কোথাও একটু ছায়া নেই। নেই স্বস্তি। বাইরে বের হলেই সূর্যতাপে গা পুড়ে যাওয়ার জোগাড়। পুরোপুরি চোখ মেলে তাকানোর অবস্থাও থাকে না কখনো কখনো। রাজধানীজুড়ে এমন তাপে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। গা বেয়ে দরদর ঘাম ঝরছে। ভিজেপুড়ে একাকার অনেকে পানিশূন্যতায় ভুগছেন। পশুপাখির অবস্থাও ত্রাহি ত্রাহি। ঢাকায় তীব্র দাবদাহের পেছনে কি শুধুই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব? পরিবেশবিদরা বলছেন, ‘আমরাও অনেকটা দায়ী এমন অনল অনুভূতিতে।’ দিন দিন নগরে কমছে গাছপালা।জলাশয় ভরাট হচ্ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে এই দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়ও বটে।



গাছপালা মানুষের নির্গত কার্বন-ডাই অক্সাইড টেনে নিয়ে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয় পরিবেশে। তেমনি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জলাশয়ের ভূমিকাও কম নয়। পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে। ভূখণ্ডের তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলে। ভূ-তটের গভীরের পানিও থাকে স্বাভাবিক স্তরে। কিন্তু ভূখ-ের উপরের জলাশয় কমে যাওয়ায় দিন দিন মাটির গভীরে পানির স্তরও ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে নিচে। নগরবিদরা বরাবরই বলে আসছেন ঢাকার ভারসাম্যহীন পরিবেশের জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন। বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এমনকি আবাসিক এলাকা, কোনোটাতেই নেই সঠিক ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার ছাপ। স্থাপনাগুলোর বেশির ভাগই তৈরি হচ্ছে খেয়ালখুশি মতো। বাতাস আসা-যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জানালা কিংবা জায়গাও রাখা হয় না। একেকটি ভবন যেন একেকটি খাঁচা। পার্থক্য শুধু লোহার খাঁচায় রাখা হয় পশুপাখি, আর কংক্রিটের খাঁচায় মানুষ।



নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারপারসন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ঢাকার বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী করেছেন নগরবাসীকেই। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় আশঙ্কাজনক হারে খোলামেলা জায়গা কমছে। এখন খোলা জায়গা খুঁজে পাওয়াই দায়। এক খ- জমি পেলেই হলো, ডেভেলপাররা সুযোগ খোঁজে কখন সেখানে বড় ইমারত গড়ে তুলবে।’ ইমারত তোলার বিপক্ষে তার অবস্থান নয় জানিয়ে এই নগর গবেষক বলেন, ‘ইমারত নির্মাণে তো দোষ নেই। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমাদের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তগুলো স্পষ্ট হবে। নগরীতে ইমারত গড়ে তুললেই উন্নত হয়ে যায় না, বসবাসের পরিবেশের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। এজন্য প্রয়োজন সবুজায়ন। গাছপালা যত বেশি থাকবে নগরীর তাপমাত্রা থাকবে তত বেশি সহনীয়।’



ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা কত? এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছেও। তবে দেড় কোটির বেশি মানুষের এই ঢাকায় প্রায় ৯ লাখের বেশি যানবাহন চলে বলে বিআরটিএ তথ্য দিচ্ছে। এর মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি বাস ও মিনিবাস। বাকিগুলোর মধ্যে আছে ব্যক্তিগত গাড়িসহ ভারী যানবাহনও। বিপুল এসব যান চলাচলে নগরীতে বায়ু দূষণের পাশাপাশি বাতাসের ধুলোবালির পরিমাণ বেড়েছে। ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা তপ্ত বায়ু, কংক্রিট ও বিটুমিনের তৈরি রাস্তা থেকে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়া তাপবাষ্প পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে বিপর্যয়ের দিকে।



বায়ুম-লের তাপ বাড়ছে। ভূখণ্ডের তাপও ছাড়িয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক স্তর। ঢাকায় এমন কতগুলো এলাকা রয়েছে যেগুলো রীতিমতো তপ্ত অঞ্চল হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র ঘরের ভেতরের মানুষকে সাময়িকভাবে ঠা-া করছে ঠিকই, কিন্তু বাইরের পরিবেশকে করে তুলছে তপ্ত। ঢাকার অফিস পাড়া, আবাসিক এলাকার তাপমাত্রা এ কারণে বেশি থাকে। এ কারণে শহরের তাপমাত্রা ৩৩/৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বলা হলেও শরীরে অনুভূত হয় তারও কয়েকগুণ বেশি।



বসবাসের কতটুকু উপযোগী ঢাকা?



ঢাকা বসবাসের জন্য কতটুকু উপযোগী এর কোনো সদুত্তর নেই কারো কাছে। ঢাকায় অসম্ভব গরমের পেছনে দায়ী গাছপালা কমে যাওয়া। উন্মুক্ত জায়গা কিংবা খোলা পরিবেশও দিন দিন কমে আসছে। তপ্ত রদ্দুর থেকে রক্ষা পেতে একদ- জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ কি আছে সচরাচর? পার্ক কিংবা উদ্যানের নামে আছে রমনা আর চন্দ্রিমা। এর মধ্যে রমনা উদ্যান করে গড়ে দিয়ে গেছে ব্রিটিশরা। আর পাকিস্তান আমলে হয়েছে চন্দ্রিমা উদ্যান। তারপর নগরবাসীর স্বস্তির জন্য আর কোনো উদ্যান গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বরং ধ্বংস করা হয়েছে অনেক উদ্যান। উন্নয়নের নামে কেটে ফেলা হয়েছে বিপুল সংখ্যক গাছপালা। অথচ গাছপালা বা নগর বনায়ন উন্নয়নের অংশ।



অন্তত ১৫ জন নগরবাসীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল ঢাকায় তারা কতটুকু স্বস্তিতে আছেন? এর মধ্যে ১০ জনই জানিয়েছে অসন্তোষের কথা। বাকিরা কর্মস্থল ও শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধার জন্য ঢাকার পক্ষ নিয়েছেন। তবে, প্রায় সবাই একমত যে, ঢাকার বাইরে উন্নত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে রাজধানীতে লোকসংখ্যা কমে যাবে।



ইমতিহানুর রহমান, কাজ করেন একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাতাসে এত পরিমাণে ধুলিকণা যে, খালি চোখে বের হলে কিছুক্ষণ পর ঝাপসা দেখতে হয়।’ মিথিলা ইয়াসমিন ঢাকার প্রধান সমস্যা হিসেবে শব্দ দূষণকে চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি তপ্ত পরিবেশের জন্য দায়ী করলেন জলাশয় এবং খোলা জমি কমে যাওয়াকে।



অতিরিক্ত তপ্ত হচ্ছে ঢাকার যেসব এলাকা



ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পরিবেশ দিন দিন তপ্ত হচ্ছে। ভূখ-ে তাপ বাড়ছে। বসবাসে স্বস্তি হারিয়ে দারুণ অস্বস্তিতে ভুগছে মানুষ। বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত শতকের সত্তরের দশকে ঢাকা শহরের প্রথম তপ্ত ভূখ- সৃষ্টি হয় পুরান ঢাকা ও মতিঝিল এলাকায়। এরপর পর্যায়ক্রমে শ্যামপুর, পোস্তগোলা, সায়েদাবাদ, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকা তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর একে একে মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, বাসাবো, রামপুরা, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, শেরেবাংলা নগর, গাবতলী ও গুলশানের একাংশ।



এর মধ্যে অল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায়। ১৯৯০ সালে এ দুই এলাকার বেশির ভাগই ছিল জলা ও নি¤œভূমি। আবাসন প্রকল্পের কারণে এখানে দ্রুত ইমারত ও সড়ক নির্মিত হয়েছে। মধ্য ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে গাড়ি, গণপরিবহন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র তাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি ও সর্বনি¤œ ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। অন্য এলাকাগুলোর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত ১০০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের উত্তরাঞ্চল, রাঙামাটি ও শ্রীমঙ্গল এলাকায় ভৌগোলিক কারণে তাপমাত্রা বেশি। কিন্তু ঢাকা শহরে মানুষের সৃষ্ট কারণেই তাপমাত্রা বাড়ছে।



বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার সাব্বির আহমেদ। তিনি গবেষণার আলোকে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ থেকে জানান, তপ্ত ভূখ- এলাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। এতে ভবনের ভেতরে ঠাণ্ডা অনুভূতির বিনিময়ে ভবনের বাইরের মানুষ আরও বেশি তাপের কষ্ট অনুভব করছে।



উন্মুক্ত স্থানের অভাবে ভুগছে নগরবাসী



বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ‘ঢাকা শহরের ভূমি ব্যবহারের কারণে তাপমাত্রার পার্থক্য এবং তপ্ত ভূখ- সৃষ্টি’ শীর্ষক এক গবেষণায় ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত নগরায়নকেই দায়ী করা হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে ওই গবেষণায়  দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে রাজধানীর ২৬ শতাংশ এলাকা ছিল উন্মুক্ত স্থান, ৪৬ শতাংশ এলাকা বৃক্ষরাজি দিয়ে আচ্ছাদিত আর বসতি ছিল ২৩ শতাংশ এলাকায়। ২০১০ সালে এসে দেখা যায়, রাজধানীর মাত্র ৮ শতাংশ এলাকা উন্মুক্ত আর ৩১ শতাংশ এলাকায় গাছ আছে। পক্ষান্তরে ৫৭ শতাংশ এলাকা বসতি ও অবকাঠামোয় পরিপূর্ণ। জলাশয় রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ এলাকায়।



চলছে নির্মাণ, পরিবেশ যাক রসাতলে



ঢাকায় ভবন নির্মাণের আগে-পরে অনেক নিয়মনীতি মানার কথা থাকলেও এসবে তোয়াক্কা করেন না কেউ। ভবন নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী স্তূপ করে রাখা হয়। ইট, বালু, সিমেন্ট, রড কোনো কিছুই রাখা হয় না যথাযথ নিয়মে। যে কারণে বাতাসে উড়ে বেড়ায় খোলা পরিবেশে রাখা বালু, সিমেন্ট। এছাড়া ইটের খোয়া আশপাশের পরিবেশ নষ্ট করে। অনেক ক্ষেত্রে মাটির সঙ্গে কংক্রিট মিশে গিয়ে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে ফেলে। মাটিতে ঘাস কিংবা উদ্ভিদ জন্মায় না। ঢাকা শহরের নতুন নির্মাণাধীন ভবনগুলোর আশপাশে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ভবন নির্মাণের পর নির্মাণসামগ্রী ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয় না। যে কারণে পরিবেশের দূষণ এড়ানোও সম্ভব হয় না। পরিবেশ রসাতলে গেলেও ভবন মালিক কিংবা ভবন নির্মাণের সঙ্গে যারা যুক্ত থাকেন তাদের কিছুই আসে যায় না।



ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ অনুসারে যেকোনো প্লটে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবনের চার পাশে খোলা জায়গা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) বজায় রাখা বাধ্যতামূলক। বহুতল ভবন নির্মাণে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ১৯৯৩ অনুসরণ করাও বাধ্যতামূলক। ভবনের সামনের/চারপাশের খোলা জায়গা কোনো অবস্থাতেই পাকা না করে সেখানে উপযুক্ত প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর নির্দেশনাও আছে। কিন্তু এ সব মানছে না সিংহভাগ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।



গাছপালা রোপণের বিকল্প নেই



ঢাকার তপ্ত পরিবেশকে সহনীয় করতে গাছপালা রোপণের বিকল্প নেই। এজন্য সরকারকে ছোট আকারে হলেও নগর বনায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, সরকার যদি ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার আগে আশপাশে গাছপালা রোপণ নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি উন্নয়নের নামে গাছপালা কেটে ফেলা ঠেকাতে পারে তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য অনেকাংশে রক্ষা পাবে। কারণ, গাছ যত বেশি হবে পরিবেশ তত শীতল হবে।



পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরীর মতে, প্রকৃতি ও পরিবেশের রক্ষাকবচ বৃক্ষ। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে যে অক্সিজেন আমাদের কিনতে হয় চড়া মূল্যে, বৃক্ষ তা সরবরাহ করে বিনামূল্যে। পূর্ণ বয়স্ক একটি বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে। বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে বৃক্ষ। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, বায়ুদূষণ রোধসহ শত শত টন কার্বন শোষণ করে বৃক্ষ পরিবেশ অক্ষত রাখতে অপরিমেয় অবদান রাখছে। এসবই বৃক্ষের পরিবেশগত মূল্য।’



বাধ্যতামূলক করতে হবে বৃক্ষরোপণ



নগর উন্নয়নে প্রযুক্তিনির্ভরতার সঙ্গে প্রয়োজন প্রকৃতিনির্ভরতা এবং পরিবেশবান্ধবতা। পরিবেশ ও নগরবিদরা বলছেন, প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে আবাসন বিপ্লবের নামে নগরায়ন টেকসই হবে না। পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার অনেক এলাকায় গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যে সফলতা এনেছে, তা অনুসরণ করে রাজউক ঢাকার ভবনগুলোকে ‘সবুজ ভুবনে’ পরিণত করার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন রাজউকের কড়া অনুশাসন এবং প্রকৌশলী-স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের পরিবেশ আইনের কঠোর বাস্তবায়ন।



আবাসন প্রকল্পগুলোতে হাসপাতাল, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিং মল এবং কমিউনিটি সেন্টারের কথা বলা হলেও গাছপালার কথা বলা হচ্ছে না। নির্মাণাধীন ভবনের আশপাশের খোলা জায়গা গাছপালায় আচ্ছাদিত না করলে সে ভবনকে রাজউকের ছাড়পত্র না দেওয়ার শর্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি ভবন নির্মাণের অনুকূলে ‘গ্রিন সার্টিফিকেট’ অর্থাৎ ভবনটি গাছপালাযুক্ত পরিবেশবান্ধব কি না, তা আইনে অপরিহার্য করতে হবে। এ আইন না মানলে ‘গ্রিন ট্যাক্স’ কার্যকর করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।



পরিবেশবিদ মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী বলেন, ‘ভবন নির্মাণ ব্যয়ের একটি অংশ পরিবেশ রক্ষার বাজেটে অন্তর্ভুক্ত এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। ভবনের আশপাশে খোলা জায়গা না থাকলে ছাদেও বাগান দিয়ে আচ্ছাদিত করে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব। এতে ভবনগুলো প্রচ- দাবদাহ থেকে মুক্ত ও শীতল থাকবে এবং ভবনের আশপাশে কার্বন শোষিত হয়ে নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করবে। গাছপালা বেষ্টিত ভবন শীতল থাকলে এসির ব্যবহার কমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সহায়ক হবে। পরিবেশের প্রতি অবজ্ঞায় রাজধানী ঢাকা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষহীন ভবনের জঙ্গলে।’



দিন দিন কমছে জলাশয়, তপ্ত হচ্ছে মাটি



মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখা এবং তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য পরিবেশবিদরা গুরুত্ব দেন জলাশয়ের ওপর। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য জলাশয়ের বিকল্প নেই। অথচ আশঙ্কাজনক হারে কমছে ঢাকার জলাশয়। ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৯৭৮ সালে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমি ছিল ২ হাজার ৯৫২ হেক্টর ও নি¤œভূমি ১৩ হাজার ৫২৮ হেক্টর। একই সময়ে খাল ও নদী ছিল ২ হাজার ৯০০ হেক্টর। রাজধানীর বৃষ্টির পানি এসব খাল দিয়েই পড়েছে নদীতে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ক্রমেই ভরাট হয়েছে এসব জলাভূমি ও নি¤œাঞ্চল। গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, সড়ক আর শিল্প-কারখানা। পাশাপাশি খালগুলোকে সংকুচিত করে নির্মাণ করা হয়েছে বক্স কালভার্ট। এতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে রাজধানী ও আশপাশের খাল-বিল ও জলাভূমি।



২০১৪ সালে ঢাকা ও আশপাশে জলাভূমি কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৩৫ হেক্টর, নিম্নভূমি ৬ হাজার ১৯৮ হেক্টর এবং নদী-খাল ১ হাজার ২ হেক্টর। অর্থাৎ ৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে ৩৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ সময়ের ব্যবধানে নিচুভূমি কমেছে ৫৪ দশমিক ১৮ শতাংশ ও নদী-খাল ৬৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আইডব্লিউএমের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ১৯৭৮ সালে ঢাকার মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল বিভিন্ন ধরনের জলাশয় ও নিচুভূমি। সে সময় ঢাকায় নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও শক্তিশালী ছিল। এর পর বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে, যার বেশির ভাগই অপরিকল্পিত। এতে নষ্ট করা হয়েছে সুবিন্যস্ত নৌ অবকাঠামো। ভরাট করা হয়েছে নদী, খাল, জলাভূমি ও নি¤œাঞ্চল। খাল পরিণত হয়েছে সরু নালা বা বক্স কালভার্টে। বর্তমানে ঢাকার আয়তনের মাত্র ২১ শতাংশজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন জলাভূমি ও নি¤œাঞ্চল। এর ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই জলযট দেখা দিচ্ছে।



আইডব্লিউএমের তথ্যমতে, ঢাকার জলাভূমি, নি¤œাঞ্চল ও খাল ভরাটপ্রবণতা ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে তুলনামূলক কম ছিল। এর পর দুই দশকে বেশির ভাগ জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। ১৯৮৮ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ঢাকার প্রায় অর্ধেক নি¤œভূমি বিলীন হয়ে যায়। ১৯৮৮ সালে ঢাকা ও আশপাশে জলাভূমি ছিল ২ হাজার ১০৪ হেক্টর, নি¤œাঞ্চল ১২ হাজার ৭১৮ হেক্টর ও নদী-খাল ২ হাজার ৫ হেক্টর। ২০০৯ সালে এগুলো কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ হাজার ৯৯১ হেক্টর, ৬ হাজার ৪১৫ হেক্টর ও ১ হাজার ৫৮ হেক্টরে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিচুভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।



পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, পানি নিষ্কাশন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ঢাকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাড্ডা, সাঁতারকুল, খিলক্ষেত, রামপুরা, দক্ষিণ ও উত্তরখানের বেশির ভাগ এলাকা একসময় জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল ছিল। গত এক যুগে এসব জলাভূমি ও নিচু অঞ্চলের ৯০ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। মোহাম্মদপুর ও গুলশান আবাসিক এলাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন নেই, এমন এলাকা মাত্র ৪ শতাংশ। এজন্য অপরিকল্পিত নগরায়ন যেমন দায়ী, একইভাবে দায়ী সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা ও অবহেলা। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঢাকার জলাবদ্ধতা কমানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে যে নতুন ধারা সংযোজিত হয়েছে, সেখানে জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য ঢাকার জলাভূমি ও নি¤œভূমি রক্ষার পাশাপাশি নদীগুলো রক্ষায়ও উদ্যোগ নিতে হবে।



নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, জলাভূমি ভরাটের ফলে শহর থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। মাটির তাপমাত্রা বাড়ছে। এজন্য জনগণ যেমন দায়ী, তেমনি সরকারেরও অবহেলা রয়েছে। জনগণ নি¤œভূমি দখল করে বা কিনে নিয়ে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছে।- সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে।