logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
নীতিমালার ‘প্যাঁচে’ সরকারি চাকুরেদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা!
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
১৭ এপ্রিল, ২০১৬ ১১:০৫:৪৮
image



ঢাকা: অভ্যন্তরীণ উচ্চশিক্ষার নীতিমালার ‘প্যাঁচে’ ফেলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। ‘সরকারি/আধাসরকারি/বিধিবদ্ধ/স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারীদের জন্য দেশের অভ্যন্তরে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক নীতিমালা’টি জারি করা হয়েছে ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর।






কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন, এই নীতিমালার দোহাই দিয়ে বহুদিনের পুরনো রীতি ভেঙে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।






জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরে উচ্চশিক্ষা এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে আলাদা নীতিমালা রয়েছে। অভ্যন্তরে উচ্চশিক্ষার নীতিমালায় বলা আছে- এটি দেশের অভ্যন্তরে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথচ বিদেশি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও এই নীতিমালা ব্যবহার করা হচ্ছে।






জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, কোনো সরকারি চাকরিজীবী দেশের অভ্যন্তরে মাস্টার্স বা অন্য কোনো ডিগ্রি অর্জন করলে তিনি বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবেন না।






কিন্তু উচ্চশিক্ষা-প্রত্যাশী  কর্মকর্তারা বলছেন এমন কথা এই নীতিমালায় নেই।






মন্ত্রণালয় দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিমালার স্মারক (০৫.০০.০০০০.২১১.২২.১০৬.২০০৮.৩৩৯) ব্যবহার করে চীনে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সেখানে বলা হয়- “জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন নং ৩৩৯ মোতাবেক চাকুরিতে প্রবেশের পর প্রেষণ বা শিক্ষা ছুটিতে একটি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন এমন কর্মকর্তার আবেদন করার প্রয়োজন নেই।”






একই নিয়ম চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে ‘স্ট্রেনদেনিং গভমেন্ট থ্রো ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বিসিএস ক্যাডার অফিসিয়ালস’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় মাস্টার্স/ডিপ্লোমা কোর্সের ক্ষেত্রেও। অথচ আবেদনপত্রে শুধু এই প্রকল্পের আওতায় আগে বিদেশে উচ্চশিক্ষা কিংবা ডিপ্লোমা করেননি এমন অঙ্গীকারনামার কথা বলা হয়েছে। দেশে যারা উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে কোনো কিছু বলা নেই।  






কিন্তু দেশে উচ্চশিক্ষা নেয়া কর্মকর্তাদের এই প্রকল্পে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।






এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মধ্যম সারির বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ।






নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, “একজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিদেশি উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ অনেক পুরনো। বহুদিন ধরে বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ ভোগ করে আসছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। মনগড়া নতুন নিয়মের প্যাঁচে ফেলে কর্মকর্তাদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার অযোগ্য করার পাঁয়তারা এটি।”






এই নীতিমালাকে অস্পষ্ট বলে বর্ণনা করে ওই কর্মকর্তা বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষা নিলে বিদেশে নেয়া যাবে না- এই ধরনের নিয়ম বাতিল করা জরুরি। এতে কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।






একই ক্যাটাগরির প্রশাসন ক্যাডারের আরেক কর্মকর্তা বলেন, দেশে উচ্চশিক্ষা নিলে বিদেশে নেয়া যাবে না- সুনির্দিষ্ট এমন নীতিমালা না থাকলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ভুতুড়ে নিয়ম চাপিয়ে দিচ্ছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সব সময়, সর্বক্ষেত্রে খোলা রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।






এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. জারিনা রহমান খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, “শুধু সরকারি চাকরিজীবী বলে নয়, যে কারও জন্যই বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ থাকা জরুরি। কারণ আমাদের দেশের শিক্ষার চেয়ে উন্নত দেশের উচ্চশিক্ষা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এলে সরকারি আমলারা অনেক বেশি দক্ষ হবেন। তারা মাঠ পর্যায়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে পারবেন। প্রশাসনকে সেই সুযোগ সম্প্রসারিত করতে হবে, সংকুচিত নয়।”  






জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবদুস সোবহান শিকদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, “নতুন নিয়ম সম্পর্কে আমি জানি না। আমি যতটুকু জানি দেশে কোনো সরকারি কর্মকর্তা মাস্টার্স বা অন্য কোনো ডিগ্রি অর্জন করলেও তিনি বিদেশে ডিগ্রি নিতে পারতেন। আর এটাই হওয়া উচিত। কারণ বিদেশি ডিগ্রি তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে কর্মকর্তাদের ক্যাপাসিটি বিল্ড আপের সুযোগ থাকে। এটিকে সংকুচিত করা ঠিক হবে না।”






জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ইব্রাহীম হোসাইন খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, “নতুন নিয়মটি সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা নেই। আমার এই দায়িত্বে আসার আগেই নীতিমালাটি করা হয়েছে।”






তবে অতিরিক্ত সচিব বলেন, “নতুন নিয়মে একজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা দেশের অভ্যন্তরে মাস্টার্স করলে তিনি আর দ্বিতীয়টি করার সুযোগ পাবেন না। এটি দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।” আগে এই ধরনের কোনো নীতিমালা ছিল না বলেও স্বীকার করেন তিনি।






নতুন নীতিমালা থেকে দেখা যায়, এটি করা হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে উচ্চশিক্ষা লাভের বিষয়কে কেন্দ্র করে। এতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।






এই নীতিমালার যে ধারাটিকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সেই ৭ ধারায় বলা হয়েছে- ‘দেশের অভ্যন্তরে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা কর্মকালীন উচ্চশিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ ক্ষেত্রে চাকরিতে প্রবেশের পর প্রেষণে/শিক্ষাছুটিতে বা কর্মকালীন কোনো কর্মচারীর একটি মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য অনুমোদন দেয়া যাবে। তবে অতিরিক্তভাবে সরকার কর্তৃক স্বীকৃত প্রফেশনাল কোর্স/ডিগ্রির (এলএলবি/সিএ ইত্যাদি)অনুমোদন দেয়া যাবে।”






অভ্যন্তরীণ উচ্চশিক্ষার নীতিমালাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে কর্মকর্তাদের অভিযোগের বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, “এটি ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়নি। ওই নীতিমালাটি বিদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।”






নীতিমালায় অভ্যন্তরীণ উচ্চশিক্ষা ও বিদেশের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা ও বক্তব্য না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নীতিমালা পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট করা হবে।






স্পষ্ট করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সুযোগ দেয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত সচিব বলেন, “এ বিষয়ে কেউ আবেদন করেনি। তাই এটি আমাদের ভাবনার মধ্যে নেই।”






যেসব কর্মকর্তা এ ধরনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানেন না, তারা কীভাবে আবেদন করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নীতিমালা ওয়েবসাইটে দেয়া আছে। এটি তো তাদের দেখার কথা।”  






তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার বাইরে বা কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলির ভয়ে বা কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপের আশঙ্কায় কোনো কর্মকর্তা এই সিদ্ধান্ত বাতিলের আবেদন করছেন না। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।






(ঢাকাটাইমস/১৭এপ্রিল/মোআ)