রাজধানীর জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে মুঠোফোনে ব্যালেন্স রিচার্জ করা হয় এমন একটি দোকানে তার সঙ্গে দেখা। গায়ের গড়ন লিকলিকে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। হালের ফ্যাশনে চুলের কাট। জিন্স আর টি-শার্টে খারাপ লাগছে না। খুব ব্যস্ত। এদিক-সেদিক তাকানোর সময় নেই। মুঠোফোনটি দু হাতে ধরে কী যেন লিখেই চলছে। বেশ গতি আছে আঙুল সঞ্চালনে।
-‘ফেসবুকে বেশ অ্যাকটিভ মনে হচ্ছে?’
-প্রশ্ন শুনে ত্বরিত ঘাড় ঘুরিয়ে মুচকি হাসলো ছেলেটি। দ্বিতীয়বার তাকানোতে উৎসুকভাব ছিল চোখেমুখে। কী যেন জানতে চাইছে মনে হলো। বোঝা গেল ‘ফেসবুক ব্যস্ততায়’ প্রশ্ন করার ফুরসত হয়নি।
-‘কোন ক্লাসে পড়া হয়?’
-‘ক্লাস টেন।’
-‘ফেসবুক খুব ভালো লাগে?’
-‘হুম। বন্ধুদের কাছে থাকা যায়। কে কী করছে জানা যায়। অনেক কিছু শেয়ার করা যায়।’
ব্যস্ততার কারণে ছেলেটির সঙ্গে গল্পে বেশ সময় দেওয়া গেল না।
-‘তা নাম তো জানা হলো না?’
‘তানভীর আহমেদ সোহান’ চটপট উত্তর দিয়ে তখনও মাথা নিচু করে ফেসবুকেই বুঁদ হয়ে আছে সে। বন্ধুর দেওয়া একের পর এক পোস্টে লাইক, কমেন্ট করে যাচ্ছে।
০২.
তিনি একজন লেখক। লেখালেখি তার ব্রত, প্রায়ই বলেন সে কথা। সমসাময়িক নানা ইস্যুতে খুদে মতামত, মন্তব্য লেখায় বেশ পটু। তবে সেটা ফেসবুকে। তার কাছে ফেসবুক বিকল্প কী হতে পারে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার কাছে এর বিকল্প নেই। এত কম সময়ে বিপুল মানুষের মধ্যে কোনো তথ্য-মতামত ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ বোধহয় ফেসবুকেই আছে।’ নিজের দেওয়া স্ট্যাটাসে লাইক, কমেন্ট নিয়েও বেশ উদ্বিগ্ন এই লেখক। পক্ষে মন্তব্য এলে নিজের মতামতে ভরসা আরও বেড়ে যায়। কোনো মন্তব্য বিপক্ষে চলে গেলে সেটিরও পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেন। তার কাছে ফেসবুক বেশ ‘সিরিয়াস’ একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
০৩.
ফেসবুক সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়েছিল ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে। জবাব দেন বেশ কয়েকজন। সেগুলো তুলে ধরা হলো এখানে
মৃন্ময় মানস: মার্ক জুকারবার্গ সময় বাঁচানোর জন্য সব সময় টি-শার্ট পরেন, আর আমরা তার বানানো জিনিসেই (ফেসবুক) দিনের অর্ধেক সময় ব্যয় করি।
নয়ন: সুবিধা-অসুবিধা দুই দিকই আছে। খারাপ লাগে ভুয়া খবরে।
সোহেল রানা: অসুবিধার তুলনায় সুবিধাই বেশি। যেকোনো খবর জানা থেকে শুরু করে অনেক পুরনো বন্ধু বা অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, যা ফেসবুকের সবচেয়ে ভালো দিক। তবে ভুয়া আইডিসহ ভুয়া খবরেরও অভাব যে নেই সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে ফেসবুক উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের বিপথগামীও করছে, ফলে তারা নানা প্রকার খারাপ কাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে, এটাই ফেসবুকের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক।
সাকির মুহাম্মদ: ফেসবুক কি এখনো সামাজিক সাইট আছে!!! ফেসবুক তো এখন বিজনেস প্লাটফর্ম। বর্তমান প্রজন্মের জন্য এটি কি নেশা নয়? ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট না থাকলে স্মার্ট না এমন কিছুও কম বলা হয়নি...। আমার মতে ফেসবুক ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের মাঝে ...!
লিমন খান: ফেসবুকের মাধ্যমে বাংলাদেশে ই-কমার্সে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। মার্কেটিং, ব্রান্ডিং সবকিছু সহজ হয়েছে ফেসবুকের কারণে। নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে ফেসবুক বেশ শক্তিশালী সামাজিক মাধ্যম হয়ে উঠছে। জাতীয় ইস্যু নিয়ে তর্ক-বিতর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে ফেসবুকে। ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়ে মিলছে স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো জাতীয় সম্মাননাও। পক্ষ-বিপক্ষে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের মাধ্যমও এখন সামাজিক এই মাধ্যম। ব্যক্তি পর্যায়ে মানহানির ঘটনাও ঘটছে এখানে। যে কাউকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য রটিয়ে দেওয়াও সম্ভব ফেসবুকে। কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়া ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ। এসব দমনে আছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন। কিন্তু ব্যবহারকারীদের সিংহভাগই আইনটি সম্পর্কে অজ্ঞ। তাছাড়া ফেসবুকে কুরুচিকর, অসত্য ও বানোয়াট মন্তব্য করায় শাস্তি পাওয়ার নজিরও কম। যে কারণে এসব বন্ধ হচ্ছে না সহসাই।
প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, ফেসবুক এখন এতটাই সস্তা ও সহজলভ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে যে, কারো হাতে ন্যূনতম সুবিধা সম্বলিত মুঠোফোন আছে সেই একটি বা একাধিক একাউন্ট খুলে ফেলছেন ফেসবুকে। এজন্য কোনো অনুমোদন লাগছে না। যে কারণে ভার্চ্যুয়াল অপরাধের একটি নতুন ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে ফেসবুক। এর সংখ্যা বেশি না হলে কমও নয়।
তথ্য ও প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার মনে করেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে ভার্চ্যুয়াল ক্রাইম কমে আসবে। তিনি বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের দিক থেকে আমরা এখনো নবীন দেশ। যেকোনো কাজে শুরুর দিকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু এগুলোর সমাধান বের করে সামনে এগিয়ে যাওয়াই উৎকর্ষ।’
ব্যবহারকারীদের অনেকের মন্তব্য, কর্মঘণ্টা নষ্ট করার পেছনেও দায়ী ফেসবুক। ঘোর কিংবা মোহও বলেছেন কেউ কেউ। তবে এত কিছুর পরও ফেসবুক ব্যবহারকারী কমছে না। বরং বাড়ছে। আবার অলস সময় পার করার মাধ্যম হিসেবেও কেউ কেউ বেছে নিচ্ছেন সামাজিক এই যোগাযোগ মাধ্যম।
সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ফেসবুক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সমাজে মানুষের সামাজিক বন্ধন বাড়াচ্ছে বলা হলেও আদতে তার উল্টোটা হচ্ছে। একে অন্যের সঙ্গে সরাসরি দেখা কিংবা কথা বলার মাধ্যমে যে হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়, ভার্চ্যুয়ালি তা সম্ভব নয়। কারণ, ফেসবুকে মানুষ একই সময়ে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। যে কারণে কারো প্রতিই পূর্ণ মনোযোগ থাকছে না। কিন্তু দেখা বা কথা বলার সময় যার সঙ্গে কথা বলছেন শুধু তার দিকেই মনোযোগ থাকছে। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতজনদের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন অতটা পোক্ত নয়। যতটা ব্যক্তিগত যোগাযোগে স্থাপিত হয়।
আবার ফেসবুকে এমন অনেক পোস্ট, ছবি, ঘটনা শেয়ার হচ্ছে যেগুলো একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের জন্য গ্রহণ করা কঠিন বটে। এতে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ারও ঝুঁকি থাকে। অথচ অনেকে জেনে বুঝে কিংবা না জেনেই এ ধরনের পোস্ট জুড়ে দিচ্ছেন ফেসবুকের দেয়ালে।
ফেসবুকে অতি আসক্তি
এই প্রজন্ম কি ফেসবুকে অতি আসক্ত হয়ে পড়ছে? ফেসবুক এখন নিত্যকার যোগাযোগের মাধ্যম হয়েছে বটে, কিন্তু অহেতুক ফেসবুকে সময় পার করাও বে-নজির নয়। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা অনেকে প্রতিটি মুহূর্ত অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চান নিজের অবস্থানের জানান দিয়ে। সেলফি বা গ্রুপ ছবি শেয়ার করে আনন্দটাও ছড়িয়ে দিতে চান সবার মধ্যে। কিন্তু অনেকের কাছে এটি হয় বিরক্তির কারণও। কারণ, আপনি যে ছবি বা পোস্ট শেয়ার করছেন তা অন্যের কাছে পছন্দের নাও হতে পারে। ফেসবুক এখন লাইফস্টাইলের সঙ্গেও জড়িয়ে গেছে মনে করেন রাজিব সেন। তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। এই তরুণ বলেন, কাজের ব্যস্ততায় বন্ধু-বান্ধবের সময় দিতে পারবেন না। তার জন্য বিকল্প মাধ্যম ফেসবুক। বন্ধুদের অভিন্ন প্লাটফর্ম ফেসবুক। এখানে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।’
তবে এর বিপরীত মতও আছে। ছেলের ফেসবুক ব্যবহারের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘পড়ালেখা শিকায় উঠেছে। সারাক্ষণ মোবাইল আর ফেসবুক। জিজ্ঞেস করলেই বলে, ‘আমি তো বাইরে খেলতে যাই না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেই না। একটু ফেসবুকিং করলে ক্ষতি কী?’ নিরুপায় বাবা বলেন, ‘আমাদের সময় বিনোদনের বড় মাধ্যম ছিল খেলাধুলা। এখনকার ছেলেমেয়েরা সব ভিডিও গেম, ফেসবুক এসব নিয়ে মেতে আছে। আমার ছেলেটারই খেলাধুলায় মন নেই। সারা দিন বসে থাকতে থাকতে শরীরের ওজনও বেড়ে যাচ্ছে।’
বাড়ছে কলহ
ফেসবুকের কারণে কলহও বাড়ছে। সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরছে। আবার নতুন সম্পর্কও তৈরি হচ্ছে। তবে এসব সম্পর্কের বেশির ভাগই ক্ষণস্থায়ী। ব্যক্তি প্রতিহিংসাপরায়ণতাও বাড়ছে ফেসবুকের কারণে। একজনে আক্রমণ করে অন্যজনের স্ট্যাটাসের তীব্র প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক কলহও দেখা দিচ্ছে ফেসবুকের কারণে।
ইতিবাচক দিকও কম নয়
কলহ, প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত আক্রমণের পাশাপাশি ফেসবুকের ইতিবাচক দিকও কম নয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার মাধ্যমও ফেসবুক। সম্প্রতি তনু হত্যার পর বিচারের দাবিতে গোটা জাতি ফেটে পড়েছে ফেসবুকে। এখনো থেমে যায়নি সে আওয়াজ। আর যেন কোনো তনুর এভাবে মৃত্যুবরণ করতে না হয় সেই আহ্বানও আসছে ফেসবুক থেকে।
প্রতিনিয়তই আমাদের আশপাশে অনেক শিশু হত্যার শিকার হচ্ছে। হন্তারকের ভয়াল থাবা শিশুদের ওপরও পড়ছে। হচ্ছে শিশু নির্যাতনও। কিন্তু সিলেটের মৌলভীবাজারে শিশু রাজনকে পিটিয়ে যেভাবে খুন করা হয়েছে তা ফেসবুকের বদৌলতেই ছড়িয়ে গেছে। দূরপ্রবাসে পালিয়ে যাওয়া কামরুলকে ধরে আনা সম্ভব হয়েছে দেশের মাটিতে। এরপর আরও বেশ কয়েকটি শিশু হত্যার ঘটনা ওঠে এসেছে সামাজিক এই যোগাযোগ মাধ্যমে। বিষয়টি ফেসবুকে যতটা প্রচার পেয়েছে তাতেই ধরা পড়েছে আসামি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের পেছনেও ফেসবুকের অবদান কম নয়। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমেই সবাইকে শাহবাগে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম নামে একটি সংগঠন। এরপরের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে।
রাজনীতি যখন ফেসবুকে
রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা কিংবা মতপ্রকাশের বড় মাধ্যম ফেসবুক। যে যার মতো রাজনৈতিক মত প্রকাশ করতে পারছেন। সমালোচনা হচ্ছে। মুক্তবুদ্ধির চর্চাও হচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দল, কেউ বাদ যাচ্ছে না এ থেকে। একজন প্রবীণ রাজনীতিক বলছিলেন, ‘রাজনীতি এখন মাঠ থেকে ওঠে এসেছে ফেসবুকে। রাজপথে যে কথা বলা যাচ্ছে না, কৌশলে সেই কথাগুলো ফেসবুকে বলা হচ্ছে। তবে এর মন্দ দিকও আছে। কারণ প্রতিপক্ষের নজরে পড়ে যাওয়ার সুযোগও বাড়ছে। ফেসবুকে গালিগালাজ বা উগ্রতা প্রচারের কারণে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে অনেককে।’
ফেসবুক আসক্তি কোকেনের মতোই ভয়ংকর
ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহার স্বাভাবিকতা বহন করে না। এই আসক্তি মূলত মাদকাসক্তির পর্যায়ের। ডিজ্যাবিলিটি অ্যান্ড ট্রমা শিরোনামে সাইকোলজিক্যাল একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবরে বলা হয়েছে, বিশেষ করে, কোকেনসেবীদের বেশ কিছু মানসিক সমস্যা ফেসবুক আসক্তদের মাঝে এক সময় প্রকট আকারে দেখা দেয়। নতুন এক গবেষণার ফলাফলে এসব কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ফেসবুকে আসক্তদের ব্রেইনও এক সময় কোকেন আসক্তদের ব্রেইন প্যাটার্নের মতো হয়ে যায়। গবেষকরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার মস্তিষ্কের কমপালসিভ সিস্টেমের ওপর প্রভাব ফেলে। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তদের আচরণ কোকেনসেবীদের মতো হয়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ও গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের একজন টুরেল জানিয়েছেন, অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ফেসবুক আসক্তরা একটা সময় তাদের আচরণ সংযত রাখার উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে। অবশ্য সংযত আচরণের সামর্থ্য তাদের থাকে।
ফেসবুক ব্যবহারের প্রভাব জানতে টুরেল ও তার সহকর্মীরা তাদের ২০ জন স্নাতক পর্বের শিক্ষার্থীর সহায়তা নিয়ে এই গবেষণা করেন। গবেষকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফেসবুক আসক্তদের মধ্যে কোকেনসেবীদের মতো কোনো কিছু ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবার মানবিক প্রবণতা কমে যায়। ফলে এদের মধ্যে অযথা ভয় পাওয়া, বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া বা হঠাৎ রেগে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
হতাশ ও উদ্বিগ্নের পেছনেও অনলাইন শো
ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহার মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলে। মানুষের চিন্তাশক্তিতেও আনে পরিবর্তন। কর্মঘণ্টা নষ্টের পাশাপাশি হতাশা ও উদ্বিগ্নের কারণও অনলাইন শো। বেঙ্গালুরুর কনসালট্যান্ট মনোচিকিৎসক এম জে থমাস বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগের আসক্তি এখন পরিচিত একটি বিষয়। এই ঘটনা নতুন হলেও মনোচিকিৎসার ক্ষেত্রে এর কোনো শিরোনাম ঠিক করা হয়নি।’ চার দশকের অভিজ্ঞ চিকিৎসক থমাস বলেন, ‘যারা অনলাইন শো দেখেন বেশি তাদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বিগ্নতার লক্ষণ বেশি দেখা যায়। যখন অন্যরা সুখী জীবনযাপনের কিছু অনলাইনে পোস্ট করেন তখন নিজের ওপর রাগ করে বসেন তারা। এতে হতাশা বাড়তে থাকে। যদিও এ ধরনের সমস্যা বাড়ছে তবুও সচেতনতার অভাবে এই আসক্তির জন্য চিকিৎসকের কাছে আসেন না অনেকে।’
রিনা যাদব বলেন, যদিও সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট মানুষকে পরপর সংস্পর্শে রাখে কিন্তু এর কিছু ফিচার আবার মানুষের ওপর চাপ বাড়িয়ে তোলে। এ থেকে মুক্তির জন্য প্রথমে বুঝতে হবে সত্যিকারের আসক্তি পেয়ে বসেছে কি না সে বিষয়টি। এতে শুরুতেই নিজের ওপর কঠোর হলে বা জোর করা উচিত হবে না। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের বদলে অন্য কার্যক্রমগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু করতে হবে। শিশুর সঙ্গে খেলে সময় কাটানো, রান্না করা, হাঁটা বা অফিসে থাকলে পানি বা চায়ের ক্যান্টিন থেকে হেঁটে আসা। এরপর নিজেকে উজ্জীবিত রাখার জন্য সহজে চোখে পড়ে এমন জায়গায় রেখে দেওয়া। ‘আই ক্যান ডু ইট’ বা ‘আই অ্যাম গেটিং বেটার অ্যান্ড বেটার’ প্রভৃতি বাক্য লিখে নিজের আসক্তি মুক্তির কথা নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের কার্যক্রমে যদি ফল না পাওয়া যায় তবে কাউন্সেলিং নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আসক্তির কারণ থাকে লাইক পাওয়া, অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করা বা কারও অনুমোদন পাওয়া।
ফেসবুক আসক্তির লক্ষণ
১. নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত শেয়ার।
২. যখন-তখন কারণ ছাড়াই ফেসবুকে ঢোকা।
৩. প্রোফাইলের ছবিটি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া।
৪. ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিউজ ফিড পড়া এবং এগুলো নিয়ে সময় পার করা।
৫. অনলাইনের জন্য বাস্তবের জীবনকে জলাঞ্জলি দেওয়া।
৬. কাউকে বন্ধু করতে পাগলের মতো আচরণ করা।
৭. ফোনের নোটিফিকেশন বা কোনো নোটিফিকেশনের চিহ্ন দেখলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠা।
৮. কোথাও গেলে সঙ্গে সঙ্গে চেক ইন করার মাধ্যমে নিজের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া।
৯. প্রায়ই মানুষকে ট্যাগ করা।
১০. কাজের সময় লুকিয়ে গোপনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুক ব্যবহার করা।
১১. কেউ যখন কোনো ফেসবুক পোস্টে কোনো মন্তব্য করে না তখন হতাশ হয়ে পড়া।
১২. বন্ধুর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অপরিচিতদের তালিকায় যুক্ত করার প্রবণতা।
১৩. একেবারে মাঝ রাতে ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে ফেসবুক চেক করা।
১৪. ফেসবুক ছাড়া জীবন অচল হয়ে পড়ছে এ রকম ভাবনা পেয়ে বসা।
ফেসবুক আসক্তির ফলে যা ঘটে
১. আবেগ-অনুভূতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
২. হতাশা ও দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে।
৩. একাকী বোধ হয় ও নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে আসক্ত ব্যক্তি।
৪. কাজের সময় ঠিকঠাক থাকে না, কাজের আগ্রহ হারিয়ে যায়।
৫. সময় জ্ঞান লোপ পায়, অসৎ পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করে।
৬. নিজেকে অন্যর সঙ্গে তুলনা করে ঈর্ষাবোধ হতে শুরু করে।
৭. দায়-দায়িত্ব ভুলে মনোযোগ ডুবে থাকে ফেসবুকে।
৮. সম্পর্ক নষ্ট হয়, ঘর ভেঙে যেতে পারে।
শারীরিক সমস্যা
১. পিঠব্যথা, ২. মাথাব্যথা, ৩. পন্ডাইলিটিজ বা মেরুদণ্ডের সমস্যা, ৪. ওজনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে কারও ওজন বেড়ে যায় আবার কমে যায়, ৫. ইনসমনিয়া বা ঘুমের ব্যাঘাত এবং ৬. চোখে দেখতে সমস্যা হয়।
সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।