জ্বালানি তেলের দাম কমায় দূরপাল্লার বাস ভাড়াও কমিয়েছে সরকার। কিন্তু যে হারে ভাড়া কমেছে, তাতে নাম হলেও এর কোনো সুফল যাত্রীরা পাবে কি না সে নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া কমেছে সবে তিন পয়সা, অর্থাৎ একশ কিলোমিটারের যাত্রায় যাত্রীদের আগের চেয়ে কম গুনতে হবে তিন টাকা। এই টাকা বাস মালিকরা আদৌ কমাবে কি না, বা যাত্রীরাই এই টাকার জন্য চাপ দেবে না বলে মনে করছেন খোদ যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
এতদিন তেলচালিত দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারপ্রতি সরকার নির্ধারিত ভাড়া ছিল এক টাকা ৪৫ পয়সা। ১৫ মে থেকে সরকার নতুন ভাড়া ঠিক করেছে এক টাকা ৪২ পয়সা। তবে এই সময়-এর অনুসন্ধান বলছে, কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৪৫ পয়সা ভাড়া নেওয়া হয় না কোনো রুটেই। সব যাত্রাতেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছে পরিবহন মালিকরা। যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলো বলছে, কিলোমিটারপ্রতি তিন পয়সা ভাড়া কমানোর সুফল মিলবে না। কিন্তু সরকার যদি আগের নির্ধারিত ভাড়াও কার্যকর করতে পারত তাহলে সুফল পেতো যাত্রীরা।
২০১৩ সালে সরকার যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় তখন ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল লিটারে সাত টাকা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার আইন অনুযায়ী কিলোমিটারপ্রতি এক পয়সা করে তখন সাত পয়সা ভাড়া বাড়ানোর কথা থাকলেও বাড়ানো হয়েছিল ১০ পয়সা। তবে সরকারি ঘোষণার চেয়ে ভাড়া বাড়ে আরও বেশি। এরপর তেলের দাম বাড়ানো না হলেও নানা সময় নানা অজুহাতে বাড়ানো হয় ভাড়া। যাত্রীরা বলছেন, সরকার ভাড়া নির্ধারণের কথা বললেও কার্যত কোনো রুটে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
বারবার দেখা গেছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর ভাড়া বাড়ালে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলেও পরে তা থেমে যায়। শুরুর দিকে জরিমানা আর যাত্রীদের চাপাচাপি থাকলেও পরে মুখ বুঁজে মেনে নেয় তারাও। আর এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় অতিরিক্ত ভাড়া। গণমাধ্যমে এ নিয়ে মাঝেমধ্যে প্রতিবেদন ছাপা হলেও কোনো ফায়দা হয় না। যোগাযোগ করা হলে বিআরটিএ বলছে, তারা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কোনো অভিযোগ পায়নি।
কিশোরগঞ্জের আবুল খায়ের খান নিয়মিত যাতায়াত করেন ঢাকায়। প্রতিবারই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আসতে হয় তাকে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই। তাছাড়া আসতেই হবে এই বাস্তবতায় ভাড়া নিয়ে বাদানুবাদের সুযোগ নেই। প্রশাসন দায়িত্ব পালন না করলে আমাদের যাত্রীদের অন্যায় মেনে না নেওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই সময়কে বলেন, যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকার কখনো সফল হয়নি।
পরিবহন কোম্পানিগুলো যাত্রীদের পকেট কাটলেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা তা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ২০০৯ সালে একবার সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমালেও বাস ভাড়া কমেনি এতটুকু। এবারও সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে তা কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। আদতে পরিবহন কোম্পানি কোনো ভাড়া কমাবে না। তাই সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বলে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হলেও উচ্চ এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত আর পরিবহন মালিকরা ছাড়া এর সুফল কেউ পাচ্ছে না।
কেবল দূরপাল্লার বা ডিজেলচালিত বাস নয়, অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ আছে সিএনজিচালিত নগর পরিবহনেও। নগরীর কোনো কোনো রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ বা কৌশলে তিনগুণও আদায় করা হয়। বড় বাসের সর্বনি¤œ ভাড়া সাত টাকা হলেও রাজধানীতে কোনো বড় বাসে ১০ টাকার নিচে ভাড়া নেই। আবার কোনো কোনো বাসে নানা কৌশলে সর্বনি¤œ ভাড়া ২০ টাকাও নেওয়া হয়। আর প্রতি কিলোমিটার ভাড়া এক টাকা ৬০ পয়সার হিসাবও মেলে না কোনো রুটেই।
দূরত্বের সঙ্গে ভাড়ার হিসাব মেলে না
বিআরটিএর ভাড়ার তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায় ঢাকা থেকে নোয়াখালীর সোনাপুরের দূরত্ব ১৯৫ কিলোমিটার। সরকারনির্ধারিত এক টাকা ৪৫ পয়সা হারে এই রুটে টোলসহ জনপ্রতি সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়ার কথা ২৮৮ টাকা। কিন্তু এই রুটে চলাচলকারী বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৩৫০ টাকা, যা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৬২ টাকা বেশি। এই রুটে চলাচলকারী বাসগুলোকে দুটি সেতু পারাপারে টোল দিতে হয় ৪০০ টাকা করে। এই হিসাব বাদ দিলেও কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া আদায় করা হয় এক টাকা ৭৩ পয়সা।
এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলেও কখনো প্রশাসন কর্তৃক পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একইভাবে ঢাকা থেকে কুমিল্লার দূরুত্ব ১০২ কিলোমিটারের ভাড়া হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ১৬০ টাকা (সেতুর টোলসহ)। কিন্তু যাত্রীপিছু নেওয়া হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। অর্থাৎ এক যাত্রাতেই যাত্রীপিছু ২০ থেকে ৪০ টাকা বেশি নিচ্ছে পরিবহন কোম্পানিগুলো।
ঢাকা থেকে ফেনী পর্যন্ত দূরত্ব ১৪৯ কিলোমিটার। টোলসহ এই রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়া হওয়ার কথা ২১৬ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ২৮০ টাকা। এই রুটে কেবল স্টার লাইন নামে পরিবহন কোম্পানি বাস পরিচালনা করে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এই রুটে বাস চালু করে টিকতে পারেনি। এ জন্য এই কোম্পানির মালিক-শ্রমিকদের দাপটও বেশি বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
ঢাকা থেকে হবিগঞ্জের দূরত্ব ১৬৬ কিলোমিটার। সরকারনির্ধারিত ভাড়া মানলে এই পথের ভাড়া হওয়ার কথা টোলসহ ২৪৭ টাকা। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। অর্থাৎ এক যাত্রাতেই ৫৩ টাকা বেশি নিচ্ছে পরিবহন কোম্পানিগুলো। সায়েদাবাদ থেকে ভৈরব হয়ে কিশোরগঞ্জ রুটে ভাড়া হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ২০৩ টাকা। কিন্তু এই রুটের বাসগুলো আদায় করছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা।
একইভাবে ঢাকা থেকে নরসিংদী, ভৈরব হয়ে ব্রাহ্মবাড়িয়ার দূরত্ব ১০২ কিলোমিটার। এই রুটে ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে ভৈরব ব্রিজের টোল দিতে হয় যার বড় বাসের ক্ষেত্রে ২০০ টাকা। আর সরকার নির্ধারিত হারে এই রুটের ভাড়া হয় সর্বোচ্চ ১৫৬ টাকা। কিন্তু পরিবহন কোম্পানিগুলো নেয় ২০০ টাকা করে, যা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৪৪ টাকা বেশি।
যদিও সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক তালুকদার সোহেলের দাবি, তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কম ভাড়া নেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দূরত্ব ১০২ কিলোমিটারের বেশি, তাছাড়াও টোল দিয়ে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকার বেশি হয়। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কারণে আমরা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কম ভাড়া নিচ্ছি।’ ঢাকার গাবতলী থেকে ফরিদপুরের দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। ফেরির ভাড়াসহ এই পথের ভাড়া হওয়ার কথা ১৭৭ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। অর্থাৎ সরকারনির্ধারিত ভাড়ার প্রায় দ্বিগুণ আদায় করা হয় এই রুটের যাত্রীদের কাছ থেকে।
নতুন সিদ্ধান্তেও লাভ হবে না যাত্রীদের
সরকার ভাড়ার নতুন যে হার বেঁধে দিয়েছে, পরিবহন মালিকরা তা যে মানবেন না তা স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছেন। একাধিক পরিবহন কোম্পানির মালিক জানিয়েছেন, এখন তারা যে হারে ভাড়া নিচ্ছেন সেখান থেকে কিলোমিটারপ্রতি ৩ পয়সা করে কমাবেন তারা। অর্থাৎ এখন যে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে পুনর্নির্ধারিত ভাড়ার ক্ষেত্রে তা হিসেবেই আসবে না।
ঢাকা-নোয়াখালী রুটে চলা একুশে এক্সপ্রেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুদ্দিন ফরহাদ বলেন, ‘সরকার আমাদের নির্দেশ দিয়েছে কিলোমিটারে তিন পয়সা করে কমানোর জন্য, যা আমাদের বর্তমান নির্ধারিত ভাড়া থেকে কমানো হবে।’ আপনারা তো নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেন, সেটা কমাবেন না? এই প্রশ্নের জবাবে শামসুদ্দিন ফরহাদ বলেন, ‘আমি গত ফেব্রুয়ারিতে পরিবহন ব্যবসায় নেমেছি। অন্যরা যে হারে ভাড়া রাখে আমিও সে হারে রেখেছি। এটা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বেশি কি না, তা জানা নেই।
অতিরিক্ত ভাড়ার তথ্য জানে না বিআরটিএ
যাত্রীরা ত্যক্ত-বিরক্ত, হতাশ। গণমাধ্যমের কাছে বারবার তারা অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে তাদের ক্ষোভ-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারি সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর দাবি, এর কিছুই জানে না তারা। সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন) শওকত আলী বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত ভাড়া চেয়েও আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসে বেশি ভাড়া নিচ্ছে এমন অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ করেনি। লিখিত অভিযোগ করলেই এর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
অতিরিক্ত ভাড়ার পেছনে দায়ী চাঁদাবাজি
পরিবহন মালিকরা গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ্যে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ স্বীকার না করলেও ব্যক্তিগত আলাপচারিতা বা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক অভিযোগই স্বীকার করেছেন। এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের পেছনে চাঁদাবাজিকেও একটি কারণ হিসেবে বলছেন তারা।
ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ রুটে চলাচলকারী একটি পরিবহন কোম্পানির মালিক বলেন, ‘পথে পথে চাঁদা দিতে হয় আমাদেরকে। কখনো পুলিশ, কখনো শ্রমিক ইউনিয়ন, কখনো অন্য কোনো সমিতি বা সংস্থাকে। এই টাকা আমরা নিজেদের পকেট থেকে দেব না। যাত্রীদের কাছ থেকেই তুলতে হয়। এই চাঁদাবাজি বন্ধ হলে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কম টাকা নেব আমরা।’ পুলিশ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই চাঁদাবাজি ঠেকানোর ঘোষণা এসেছে বারবারই। কিন্তু কার্যত হয়নি কিছুই। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।