ঢাকা : বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের চেষ্টায় জঙ্গি দল গঠনের দায়ে সিঙ্গাপুরে সাজা হয়েছে পাঁচ বাংলাদেশি যুবকের। তাদের সঙ্গে আটক চার সহযোগীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে সিঙ্গাপুর পুলিশ। তাদের বিচার শুরুই হয়নি এখনও।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা বরাবরই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জঙ্গিদের বিচারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বলা হয়, দীর্ঘ দিনেও বিচার না হওয়ায় বেপরোয়া হচ্ছে জঙ্গিরা। ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমা হামলার বিচার শেষ করে সাজা নিশ্চিত করা যায়নি এখনও। ২০০৫ সালে একযোগে সারাদেশে জেএমবির বোমা হামলার ঘটনায় করা সব মামলারও বিচার শেষ হয়নি ১১ বছরেও।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দেশে তদন্ত বরাবরই এক প্রশ্নবিদ্ধ ও দীর্ঘসূত্রতার বিষয়। পুলিশের দুর্বলতা, দক্ষতার অভাব বা প্রভাবশালীদের কারণে বিচারে বিলম্ব হয়। কিন্তু উন্নত বিশ্বে এটা হয় না। তাই সেখানে দ্রুত বিচার হয়। কেবল জঙ্গিবাদ নয়, যে কোনও সন্ত্রাস মোকাবেলা করতে হলে দ্রুত বিচার জরুরি’।
পুলিশ জানিয়েছে, সিঙ্গাপুর ফেরত যুবকদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। উদঘাটন করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কিন্তু আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়া যায়নি এখনও। তদন্ত শেষ হতে আরও সময় লাগবে বলেও জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মুনসুর আলী আরিফ।
সিঙ্গাপুরে জঙ্গি সম্পৃক্ততায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত জানুয়ারিতে ১৩ বাংলাদেশিকে আটক করে সিঙ্গাপুর পুলিশ। এদের মধ্যে ২৯ এপ্রিল আটজনকে তাদের হেফাজতে রেখে বাকিদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। আর ছয় মাসের মধ্যে চার বাংলাদেশির সাজা ঘোষণা করে সে দেশের একটি আদালত। সিঙ্গাপুর পুলিশ জানায়, এই চার বাংলাদেশি তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্বীকার করেছেন। তারা দেশে ফিরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা করেছিল।
এদের পাঁচ সহযোগী মিজানুর রহমান ওরফে গালিব হাসান চৌধুরী, রানা মিয়া ওরফে পাইলট, আলমগীর হোসেন, তানজিমুল ইসলাম ও মাসুদ রানা ওরফে সন্টু খানের বিরুদ্ধেও আছে একই ধরনের অভিযোগ। তাদের প্রত্যেকেই ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কাজের অনুমতি নিয়ে সিঙ্গাপুরে যান। তাদের বিরুদ্ধেও আইএস সংশ্লিষ্টতা ও বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাসী হামলা চালানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে সিঙ্গাপুর পুলিশ। দেশে আসার পর এই পাঁচ বাংলাদেশিকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাদের বিরুদ্ধে গত ৩ মে সন্ত্রাস দমন আইনে রামপুরা থানায় মামলা করা হয়।
এ মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরদিন আদালতে হাজির করা হয়। তাদেরকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে পাঁচ জনই স্বীকার করেছে যে, সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে জঙ্গি মতাদর্শ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না কেউ। সেখানে গিয়ে উগ্র প্রচারে উদ্ধুদ্ধ হন তারা। তাদের কয়েকজনের কাছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানীর লেখা বই পাওয়া গেছে। তারা আনসারুল্লাহ’র মতাদশের্রর অনুসারী হতে পারেন বলে গোয়েন্দাদের ধারণা।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মুনসুর আলী আরিফ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত সবাই ওই মামলায় এখনো জেলখানায় রয়েছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো যাচাইবাছাই করতে আরও তদন্তের প্রয়োজন। তাই এই মামলায় এখনও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
যে পরিকল্পনা হয়েছিল সিঙ্গাপুরে
দেশটির আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিবেদেন বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি দল আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটার পর গত মার্চে মিজানুর সিঙ্গাপুরে প্রবাসী কয়েকজন বাংলাদেশিকে নিয়ে একটি দল গড়েন, যার নাম দেওয়া হয় ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ।
শুনানিতে জানানো হয়, আইএসএ এর হয়ে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে তিন দফা ব্যর্থ হন মিজানুর। তুরস্ক ও আলজেরিয়া তার ভিসার আবেদন নাকচ করে দেয়। এরপর তিনি কাজ নিয়ে সিঙ্গাপুরে যান। দোষী সাব্যস্ত বাকি পাঁচজনকে তিনিই দলভুক্ত করেন।
আদালতের শুনানিতে বলা হয়, মিজানুর ও তার দল নিয়মিত বুন লে পার্ক এবং ওয়াটারফ্রন্ট পার্কে জড়ো হয়ে সেই ‘স্বপ্ন বাস্তবায়নের’ জন্য পরিকল্পনা করতেন। দেশে ফিরে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনাও তাদের ছিল।
গত এপ্রিলে ওই ছয়জনের সঙ্গে সোহাগ ইব্রাহিম, শরিফুল ইসলাম নামে আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করে সিঙ্গাপুরের পুলিশ। তবে সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আট বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করে মে মাসের শুরুতে।
তাদের গ্রেপ্তারের পর সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, মিজানুরের কাছে বাংলাদেশের সরকার ও সামরিক কর্মকর্তাদের একটি তালিকা পাওয়া গেছে, যাদের উপর হামলার পরিকল্পনা তারা করেছিল। তাদের ইরাক বা সিরিয়ায় যাওয়ার ভাবনা থাকলেও সেখানে যাওয়া কঠিন মনে হওয়ায় মত পাল্টে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে খেলাফত কায়েমের পরিকল্পনা করে।
(ঢাকাটাইমস/১৩জুলাই/এএ/ডব্লিউবি)