একসময় বাংলা চলচ্চিত্র মানেই ছিল হল ভর্তি দর্শক। তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সপরিবারে লোকজন যেত সিনেমা হলে। সিনেমা দেখার জন্য স্কুল পালিয়ে যায়নি এমন ছেলে খুব কম ছিল। আড্ডায় প্রধান আলোচ্য ছিল সিনেমার কাহিনী আর পাত্র-পাত্রী।
নতুন প্রজন্মের কাছে এসব এখন রূপকথা। সিনেমার জন্য ক্লাস ফাঁকি দেওয়া ছেলে খুঁজে পাওয়া দূরের কথা, বাংলা সিনেমা নিয়ে কোনো আগ্রহ নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া ভার।
বলা হয়, বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের শুরু ষাটের দশক থেকে। তা ছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এরপর শুরু বাংলা চলচ্চিত্রের পতনের ধারা। সুস্থ চলচ্চিত্রকে হটিয়ে দেয় অশ্লীলতা। সেই ধারাবাহিকতা চলেছে প্রায় দ্ইু দশকের মতো। বছরে একটি বা দুটি ভালো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে বটে, কিন্তু তা নিরাশ দর্শককে হলমুখী করতে পারেনি।
গত দুই দশকের পরিসংখ্যান অনুসারে এদেশীয় চলচ্চিত্রের টিকে থাকাটাই একটি চ্যালেঞ্জ। নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প।
মানহীন গল্প
মৌলিক গল্পের সিনেমার অভাব ঢাকাই চলচ্চিত্রের (ঢালিউড) এক বড় সংকট। ঢালিউডের ছবিগুলোর বেশির ভাগই ভারতের তামিল, তেলেগু কিংবা উত্তর বা দক্ষিণ ভারতীয় ছবির কপি পেস্ট। হলে ছবি দেখতে গিয়ে নিরাশ হয়ে ফেরে দর্শক। ফলে এখানকার সিনেমা যে মধ্যবিত্ত দর্শককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠার কথা, সেটি হয়নি। দর্শক-সংকটে ক্রমক্ষয়িষ্ণুতার দিকে ধাবিত হয়েছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। গত দুই দশককে তাই বাংলা সিনেমার ‘অন্ধকার যুগ’ বললে ভুল হবে না। এর প্রভাবে একের পর এক বন্ধ হয়েছে সিনেমা হল।
নির্মাণের অদক্ষতা ও প্রযুক্তি-সংকট
মানহীন গল্পের সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্মাণের অদক্ষতা ও প্রযুক্তির অপর্যাপ্ততা। পার্শ্ববর্তী দেশের চলচ্চিত্রশিল্প যেখানে আধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, সেখানে আমাদের সিনেমায় ব্যবহৃত হচ্ছে মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি। পশ্চিমবঙ্গের ছবি একসময় ঢাকাই চলচ্চিত্রের অনুকরণে নির্মিত হতো, সময়ের ব্যবধানে এখন ঢাকাই চলচ্চিত্র পশ্চিমবঙ্গ-নির্ভর হয়ে পড়েছে। এখন যে এইচডি ফর্মেটে ছবি নির্মিত হচ্ছে, সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই অনেক নির্মাতার। বাণিজ্যিক ঘরানার কিংবা আর্ট ফিল্ম ঘরানার অনেক পরিচালকই সিনেমার আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব ভালো জানেন বলা যাবে না। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে আন্তর্জাতিক মানের ছবি নির্মাণ করার ক্ষমতা রাখেন না তা নয়, সে সংখ্যাটি হাতেগোনা। এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ-সুবিধা কিংবা প্রতিষ্ঠানও সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
হল সংকট
একসময় সারা দেশে এক হাজারের মতো সিনেমা হল ছিল। এখন সেই সংখ্যা এসে ঠেকেছে ২৫০-এ। এগুলোর মধ্যেও মাত্র ৫০টির মতো সিনেমা হল কোনো রকম মানোত্তীর্ণ। আর বাদবাকি হলগুলোর অবস্থা যাচ্ছেতাই। অথচ চলচ্চিত্রশিল্প টিকে থাকার জন্য প্রথম শর্তই হলো ভালো পরিবেশের প্রেক্ষাগৃহ বা সিনেমা হল। যেখানে এই শর্তটি লঙ্ঘিত হয় সেখানে চলচ্চিত্রশিল্পের ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
একটি ছবি ভালো কি মন্দ সেটি পরের বিবেচনার বিষয়। আগে সেটি প্রদর্শিত হতে হবে। ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রধান প্রদর্শনমাধ্যম প্রেক্ষাগৃহ এখন কমতে কমতে একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে। যেখানে সারা দেশে অন্তত ৫০০ সিনেপ্লেক্স হলের প্রয়োজন, সেখানে আছে গোটা কয়েক। আর হলের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকের কম।
রাজধানীর মধুমিতা, বলাকা, স্টার সিনেপ্লেক্স বা ব্লকবাস্টারের মতো হল দেশের অন্য কোথাও নেই। শুধু চার-পাঁচটি সিনেপ্লেক্স আর ব্লকবাস্টার দিয়ে একটি দেশের বিশাল চলচ্চিত্র শিল্পের টিকে থাকার কথা চিন্তা করা বাতুলতা।
জেলা শহরের হলগুলোর কথা বলতে গেল ভালো কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। বেশির ভাগ হলই মাদকসেবীদের আখড়া। ছেঁড়া-খোঁড়া-ভাঙা আসন। নোংরা, পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এসব হলে বসে সিনেমা দেখার কথা ভাবা কঠিন। ফলে দিন দিন ঢাকাই সিনেমার দর্শক কমেছে। ব্যবসা করতে না পেরে দিনের পর দিন লোকসান দিয়ে একটি একটি করে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে চলচ্চিত্রশিল্প পড়েছে আরও সংকটে।
চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সারা দেশে অন্তত ৩০০ প্রেক্ষাগৃহ ডিজিটালাইজড করা না হলে এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্প একেবারে ধ্বংসের মুখে পড়বে।
পরিবেশনায় তুঘলকি
সিনেমা সেন্সর হয়ে যাওয়ার পর পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশক। সিনেমা পরিবেশনার ক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যার কথা শোনা যায়। পরিবেশকদের মধ্যে চলে সিন্ডিকেট। কতটি হলে সিনেমা মুক্তি দেওয়া হবে সেটিও পরিবেশক নিয়ন্ত্রণ করেন। পরিচালক বা প্রযোজকের সেখানে কোনো ক্ষমতা নেই। পরিবেশকদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে সিনেমাটির ব্যবসা। কোনো কোনো ছবি হলে দেওয়ার পর কারণ ছাড়া হল থেকে নামিয়ে ফেলা হয় বলেও অভিযোগ আছে। সিনেমাপাড়ার বাইরের কেউ ছবি বানালে তাদের পড়তে হয় আরও বড় ধরনের সমস্যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশকরা পঞ্চাশ-ষাটটি সিনেমা হলের কথা বললেও বাস্তবে মুক্তি দেওয়া হয় বার থেকে পনেরটি হলে। কোটি টাকা বাজেটের ছবি পনেরো বা বিশটি হলে মুক্তি পেলে প্রয়োজক তার লগ্নির টাকা ফেরত পাবেন কীভাবে?
২০১৫ সালে ৬২টি ছবি মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি ছবি লগ্নির টাকা তুলতে পেরেছে। আর বাকি সিনেমাগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। এসব সিনেমার প্রযোজকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নতুন, যাদের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই এই শিল্পে।
বিনোদনের নতুন উপায়
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পতনের পেছনে আর একটি কারণকে অনেকে সামনে আনেন। সেটি হলো আকাশ সংস্কৃতি, ইন্টারনেটসহ বিনোদনের নতুন নতুন উপায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো বরং বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নের সুযোগ এনে দিয়েছিল। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট লোকজন এসব মাধ্যমকে প্রতিযোগী হিসেবে নিয়ে নিজেদের যোগ্য করে তোলার পরিবর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। তারা সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি, না চলচ্চিত্রের গল্প, না নির্মাণ, না প্রেক্ষাগৃহ- কোনো দিকেই তারা দূরপ্রসারী নজর দেয়নি। ফলে দিনের পর দিন বিরক্ত দর্শক একসময় বাংলা সিনেমাবিমুখ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এই সময়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা সিনেমার কোনো দর্শকশ্রেণি গড়ে ওঠেনি।
যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা
সংকটাপন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আবার যোগ হয়েছে যৌথ প্রযোজনার ছবি। অবশ্য এর পক্ষে-বিপক্ষে দুটি ধারা। কেউ এটিকে দেখছেন ইতিবাচক দৃষ্টিতে। তারা মনে করছেন, বাংলাদেশের সিনেমার এই দুর্দিনে চলচ্চিত্রকে টেনে তুলতে যৌথ প্রযোজনা ভূমিকা রাখতে পারে।
অন্যদিকে যারা যৌথ প্রযোজনকে দেশের চলচ্চিত্রের জন্য মন্দ বলে ভাবছেন, তাদের অভিযোগ, কলকাতার সিনেমার বাজেট ও নির্মাণ ব্যয়ের তুলনায় তাদের বাজার ছোট। তাই নিজেদের সিনেমার বড় বাজার হিসেবে তারা বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশকে।
এদিকে যৌথ প্রযোজনার ছবিতে নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া গত দুই-তিন বছরে যৌথ প্রযোজনায় বেশ কিছু ছবি নির্মিত হলেও আশানুরূপ সফলতা আসেনি তাতে।
তবে ইতিবাচক ধারার সিনেমা বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাজার ঠিক হতে একটু সময় লাগবে। মন্দা সময় কেটে গেলে দুই দেশই বড় বাজারে তাদের ছবি মুক্তি দিতে পারবে।
উৎসবকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র
দর্শক ও হলের সংখ্যা গুণানুপাতিক হারে কমে যাওয়ায় দেশের চলচ্চিত্র কিছুটা হলেও উৎসবকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ঈদ ও পূজার মতো বড় উৎসবগুলো কেন্দ্র করে তৈরি হয় বড় বাজেটের সিনেমা। অন্য সময়ে নির্মিত সিনেমার চেয়ে গল্প ও নির্মাণে কিছুটা বেশি যতেœর ছাপ পাওয়া যায় উৎসবকেন্দ্রিক সিনেমাগুলোতে। ফলে হলগুলোতে বেশ দর্শক সমাগম হয়। ভালো ছবিগুলো ব্যবসাও করে বেশ। মূলধারার পরিচালকরা তাদের ছবি নির্মাণের জন্য এ সময়টির জন্য অপেক্ষা করেন।
আশার কথা
আশার কথা, এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল অনেক পরিচালক-নির্মাতা বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে লড়াই করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ইতিমধ্যে ভালো সিনেমা বানিয়ে দর্শকদের মধ্যে আশার আলো দেখাচ্ছেন। কেউ কান চলচ্চিত্র উৎসবের মতো বিশাল প্ল্যাটফর্মে ছবি নিয়ে হাজির হচ্ছেন। কারও সিনেমা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরস্কৃত হচ্ছে।
এসব আশার আলো আমাদের আবার স্বপ্ন দেখায় সুস্থ চলচ্চিত্রের জাগরণের। একটু ঠান্ডা বাতাস বুলিয়ে দিয়ে যায় দর্শক-খরায় হাঁসফাঁস করা ঢাকাই চলচ্চিত্রে।
(ঢাকাটাইমস/৯জুলাই/মোআ)