ঢাকা: ২০১৩ সালে বগুড়ার হোটেল আকবরিয়া থেকে উদ্ধার হওয়ার পর থেকে আর মিডিয়াতে তেমন দেখা নেই তাদের। মিরপুরের সেই কথিত ‘ভূতের বাড়ি’তেও থাকেন না তারা। মানসিক রোগগ্রস্তÍ আলোচিত দুই উচ্চশিক্ষিত বোন রীতা-মিতার খোঁজ নেয়া হয় মিরপুরের বাড়ি, চাকরিস্থল, চিকিৎসক, উদ্ধারকারীসহ বিভিন্ন মহলে। কিন্তু কেউ জানে না তারা কোথায়।
চাকরিস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানানো হয়, চিকিৎসক রীতা মাস ছয়েক চাকরি করে এরপর লাপাত্তা হন। আর কোনো যোগাযোগ নেই তার সঙ্গে।
যে মনোরোগ চিকিৎসক দুই বোনের চিকিৎসা করেছেন, মোহিত কামাল বলছেন, তিনি আন্তরিকভাবে চিকিৎসা করিয়ে সারিয়ে তুলেছিলেন তাদের, কিন্তু পরে তাদের পরে নেয়া হয়নি তার কাছে।
মিরপুরের ‘ভূতের বাড়ি’ থেকে দুই বোনকে উদ্ধার করেছিলেন মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান। তার কাছ থেকেও হারিয়ে গেছেন চিকিৎসক রীতা ও প্রকৌশলী মিতা।
মিরপুরের ছয় নম্বর সেকশনের সি ব্লকের নয় নম্বর রোডের (এক নম্বর) যে বাড়ি থেকে রীতা-মিতাকে উদ্ধার করা হয়, সেখানকার বাসিন্দারাও জানেন না তাদের খোঁজ। তাদের কাছে রীতা-মিতার বাড়ি এখন ভূতের বাড়ি। কেউ কেউ জানান, তাদের বড় বোন কামরুন নাহার হেনার সঙ্গে ধানমন্ডির একটি বাড়িতে তারা বসবাস করছেন। তবে ওই বাসার খোঁজ মিরপুরের কেউ জানে না।
রীতা-মিতাদের বাড়ির দক্ষিণ কোণে আসবাবপত্রের দোকান উডল্যান্ড ফার্নিচার, যেখান থেকে ভাড়া তুলে চলত রীতা-মিতার খরচ, সেই দোকানের লোকজনও বলতে পারেন না তাদের প্রকৃত অবস্থান। কেউ বলেছেন রীতা-মিতা এখন তার বোনের সঙ্গে লন্ডনে থাকেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত তাদের দুলাভাই এসে ভাড়া তুলে নিয়ে যান।
২০০৫ সালের ৮ জুলাই বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছিলেন এই দুই দুই বোন। মানবাধিকার সংস্থার আইনজীবী অ্যাডভোকেট এলিনা খান 'ভুতুড়ে বাড়ি' থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের উদ্ধার করেন। তখন তারা দাবি করেছিলেন, আল্লাহর সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। দিনের পর দিন না খেয়ে হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছিলেন দুই বোন। নানা রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছিল তাদের শরীরে। উদ্ধারের পর রীতা-মিতাকে চিকিৎসা দেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুহিত কামাল। দুই বোন মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠেন চিকিৎসায়।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় করে তাদের ভুতুড়ে বাড়ির সংস্কার করা হয়। ডা. আইনুন নাহার রীতাকে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে মেডিকেল অফিসার পদে চাকরি দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতালের গাইনি বিভাগে। অন্য বোন প্রকৌশলী নুরুন নাহার মিতাকে চাকরি দিতে চেয়েছিল একটি এনজিও। পরে সেটা আর হয়নি।
এরপর দীর্ঘদিন দুই বোন আলোচনার বাইরে ছিলেন। ২০১৩ সালে হঠাৎ আবার পত্রিকার শিরোনাম হন রীতা-মিতা। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি তাদের উদ্ধার করা হয় বগুড়া শহরের হোটেল আকবারিয়ার ২১ নম্বর কক্ষ থেকে। প্রায় চার মাস ধরে তারা সেখানে বসবাস করছিলেন। প্রথম দিকে নিয়মিত হোটেলের বিল পরিশোধ করেন প্রায় ৭০ হাজার টাকা। পরে বিল বকেয়া পড়তে থাকলে পুলিশকে খবর দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। এরপর তাদের উদ্ধার করে সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
২৮ জুন সকালে বগুড়ার সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে তাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন অ্যাভোকেট এলিনা খান ও রীতা-মিতার বড় বোন কামরুন নাহার হেনা। তখন এলিনা খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ঢাকার মিরপুরে ৭ কাঠা জমির ওপরে রীতা-মিতাদের বাড়িটি দখলের চেষ্টা চলছে।
এরপর রীতা-মিতার চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিয়ে তেমন সংবাদ নেই কোথাও। গত তিন বছর ধরে তারা একরকম ‘নিখোঁজ’ হয়ে আছেন।
রীতা-মিতার প্রথম চিকিৎসক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুহিত কামাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, “প্রথমে আমি রীতা মিতাকে চিকিৎসা করিয়েছিলাম। তখন তাদের অভিভাবক ছিলেন অ্যাডভোকেট এলিনা খান। তিনি ওদের আমার চেম্বারে নিয়ে আসতেন। কয়েক মাসের চিকিৎসায় তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে তাদের আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর রীতা-মিতাকে আর আমার কাছে আনা হয়নি। কেন আমার কাছে আনা হয়নি, সেটা আমি বলতে পারব না।”
মোহিত কামাল বলেন, “সুস্থ হওয়ার পর রীতাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যলয়ে চাকরি দেওয়া হয়। তবে ওই সময়ে মিতাকে চাকরি দেওয়া সম্ভব হয়নি। হয়তো চাকরিতে ব্যস্ত থাকতে পারলে দুই বোন সুস্থ থাকত।”
তবে রীতা-মিতার পুরোপুরি সুস্থ থাকতে না পারার জন্য আশপাশের মানুষের কিছু নেতিবাচ আচরণ দায়ী বলে মনে করেন মোহিত কামাল। তিনি বলেন, “সুস্থ হওয়ার পর কখনো তারা শপিং মলে কিংবা কোথাও গেলে মানুষ তাদের বলত ‘ওই পাগল এসেছে’। এমন কথা শুনে রীতা-মিতা অবাক হতেন। এতে মেন্টাল ট্রমা হয় তাদের। এসব কারণে তারা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে এখন তারা কোথায় আছেন, কেমন আছেন সে বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতাল সূত্র জানায়, চাকরিতে যোগদানের পর রীতা পাঁচ-ছয় মাস কাজ করেন। তবে ঠিকমতো অফিসে আ তেন না। পরে একসময় অফিসে আসা বন্ধ করে দেন।
তবে রীতার চাকরি এখনো আছে কি না বা তিনি বেতন পান কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, “এ ব্যাপারে আপনি গাইনি বিভাগের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন। এই বিষয়টি উনিই ভালো বলতে পারবেন।”
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক পারভীন ফাতেমা ঢাকাটাইমসকে বলেন, “আমি রীতার বিষয়ে কিছুই জানি না। আর আমার ডিপার্টমেন্টে আইনুন নাহার রীতা নামের কোনো মেয়ে ছিল কি না তা আমার মনে নেই।”
রীতা-মিতাদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট এলিনা খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, “তারা এখন তাদের বড় বোন হেনার সঙ্গে ধানমন্ডিতে থাকেন বলে শুনেছি। রীতা-মিতাদের মিরপুরের বাড়ির পাশে একটি ফার্নিচারের দোকান রয়েছে, হয়তো দোকানের মালিক সব তথ্য জানেন।”
রীতা-মিতার বড় বোন কামরুন নাহার হেনার ফোন নম্বর জোগাড় করে তাতে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
রীতা-মিতার মধ্যে আইনুন নাহার রীতা সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। আর নূরুন নাহার মিতা বুয়েট থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিদেশে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন।
(ঢাকাটাইমস/১জুলাই/মোআ)