চট্টগ্রাম: এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার কোনো কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। আলোচিত এই হত্যাকান্ডের পর বহু আলামত থাকার পরও খুনীরা অধরা। এরই মধ্যে একদফা তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। কিন্তু ফলাফল দৃশ্যমান নয়। ঐ ঘটনার পর সারাদেশে জঙ্গি ধরার অভিযানে নামে পুলিশ। প্রায় দুই শ’ জঙ্গি ধরা পরলেও চট্টগ্রামে জঙ্গিদের নাগাল পায়নি পুলিশ। অতীতের তালিকা সম্প্রতি হালনাগাদ করে চট্টগ্রামে ৫৩ জন জঙ্গির একটি তালিকা করা হয়েছে। এ নিয়ে অভিযানে নামলেও পুলিশ তাদের নাগাল পায়নি।
একদিকে মিতুর ঘাতকদের নাগাল না পাওয়া, অন্য দিকে জঙ্গি ধরতে না পারায় এই ব্যর্থতা নিয়ে অস্বস্তিতে চট্টগ্রামের পুলিশ। ৫৩ জন জঙ্গির মধ্যে মাত্র তিন জন জেলে রয়েছে। বাকিদের নাম পরিচয় পুলিশের তালিকায় থাকলেও তারা সবাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের এক সিনিয়র কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, সিএমপির তালিকায় অর্ধশত জঙ্গির নাম পরিচয় থাকলেও তারা সবাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে। কেউ আবার এলাকা ছেড়েছে। তালিকভুক্তদের মধ্যে মাত্র তিন জন জেলে। কয়েকজন আবার জামিন নিয়ে লা-পাত্তা। এছাড়া মিতু হত্যায় কোনো অগ্রগতি না হওয়ার বিষয়টিও পুলিশের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।
শুধু মিতু হত্যাই নয় সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসি ঘটনা ঘটেছে। মিতু হত্যার আগে চট্টগ্রামে নৌ ঘাটির একটি মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ, লালখান বাজার এলাকায় মুফতি ইজহারের মাদ্রাসায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও বেশ আলোচিত।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তারের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, দেশজুড়ে গুপ্তহত্যার মধ্যে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে স¤পৃক্ত চট্টগ্রামের ৫৩ জঙ্গির নামের একটি তালিকা ধরে মাঠে নেমেছে পুলিশ।
তালিকাভুক্ত জঙ্গিরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতুল মোজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীর ও হরকাতুল জিহাদ এবং শহীদ হামজা ব্রিগেডের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে যাদের স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রামে তাদের আমরা তালিকাবদ্ধ করেছি। তবে বাড়ি চট্টগ্রামে হলে তাদের জঙ্গি কার্যক্রম চট্টগ্রামের বাইরেও হচ্ছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা, সিলেট, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা জঙ্গি কার্যক্রমে স¤পৃক্ত আছে। আমরা তাদের গ্রেপ্তাারের সর্বাতœক চেষ্টা করছি। যারা জামিনে আছে তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের নেতৃত্বে আছেন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদধারী বিশিষ্ট এক ব্যক্তির ছেলে। তার নাম আসিফ আদনান (২৬)। উচ্চ শিক্ষিত এই যুবক বিবাহিত, দুই ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়। তার বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশে। রাজধানীর শাহবাগ থানার সেগুনবাগিচায় তাদের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। পুলিশ আসিফ আদনান সম্পর্কে জানতে পারলেও তার অনুসারিদের সম্পর্কে এখনো কিছু জানতে পারেনি।
এছাড়া তালিকাভুক্ত অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত যুবক এবং ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তালিকাভুক্তদের নাম জানতে চাইলে পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মোস্তাফিজুর রহমান এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে তারা জানান, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের তৈরি করা তালিকাটি গেছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, মিতু হত্যাকান্ডে নিয়ে এখনো অন্ধকারে পুলিশ। বিষয়টি দারুনভাবে ভাবাচ্ছে সিএমপির সকল কর্মকর্তাকে। জঙ্গি গ্রেপ্তারে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম সার্বক্ষণিকভাবে তদারক করছেন বলে জানা গেছে।
জঙ্গিদের তালিকায় শহীদ হামজা ব্রিগেডের রয়েছে ৫ জন। এরা হলেন-হাটহাজারীর আবুল কাশেম (৬০), আল ফাত্তাহ (৩৫), আজিজ ও ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা এবং বাঁশখালীর মাওলানা মো. মোবারক। এদের মধ্যে আবুল কাশেম মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী এবং হামজা ব্রিগেডের অর্থ জোগানদাতা। মাওলানা মো. মোবারক দুই মাস আগে মালয়েশিয়ায় মারা গেছে বলে তথ্য আছে পুলিশের কাছে। তবে মৃত্যুর তথ্য এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ।
জেএমবির রয়েছে ৪ জন। এরা হলেন-হাটহাজারীর মঞ্জুরুল মুরাদ ওরফে আবদুল্লাহ মো. মুরাদ ওরফে আবদুল্লাহ আল রায়হান মুরাদ, হাফেজ আহমেদ কাদের মঈনুদ্দিন ওরফে উদয় (১৯) ও সিরাজুল মোস্তফা প্রকাশ সোলায়মান (১৯) এবং সীতাকুন্ডের আইয়ূব আলী ওরফে আবু জর। এদের মধ্যে আবু জর জেএমবি নেতা বাংলা ভাইয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পুলিশের তালিকায় উল্লেখ আছে।
হরকাতুল জিহাদের (হুজি) রয়েছে ৪ জন। এরা হলেন- মিরসরাইয়ের মিনহাজুল ইসলাম সাজিব (২৪), সন্দ্বীপের মনির হোসেন (৬৫) ও মাওলানা আকবর হোসাইন, সাতকানিয়ার একটি মসজিদের ইমাম আব্দুল হান্নান (২৪)। এদের মধ্যে মাওলানা আকবর হোসাইন নারায়ণগঞ্জের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে আছেন সন্দ্বীপের মাকসুদুর রহমান রনি।
তালিকাভুক্ত বাকি ৩৮ জনই হিযবুত তাহরীরের সদস্য। এরা হলেন-মিরসরাইয়ের কামরুল হাসান (২৭), ইফতেখারুল ইসলাম (১৯) ও সালাহউদ্দিন স্বপন (২০), আনোয়ারার লোকমান গণি (২৩), বাঁশখালীর জুনায়েদ (৩৪), মুফতি হারুন বিন ইজাহার ও আমজাদ হোসেন (২৪), লোহাগাড়ার আতিক সাবরাজ হিমেল (২৩), সাতকানিয়ার আহসান আলী রিয়াজ, ইমতিয়াজ হোসেন, তন্ময় সুফিয়ান, নূর মোহাম্মদ, নগরীর আন্দরকিল্লার একটি প্রকাশনা সংস্থার কর্মচারি শাহাদাৎ হোসেন (১৯) ও শিক্ষানবীশ আইনজীবী ফয়সাল রহমান লিমন (২৫), বোয়ালখালীর হাবিবুন্নবী প্রকাশ আশিকুর রহমান, রায়হানুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত এক আনসার কমান্ডারের ছেলে রেজাউল ইসলাম ও এমদাদুল ইসলাম (২৩), রাঙ্গুনিয়ার শরফুল আউয়াল ও ইউএসটিসি থেকে ফার্মেসি অনুষদে মাস্টার্স করা নাজমুল কাদের (২৬), রাউজানের বাসিন্দা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এস এম জুলহাস নাঈম ও বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র মহিবুল আলম, পটিয়ার ফরমান উল্লাহ, সীতাকুন্ডের আব্দুল কাদির, আলাউদ্দিন প্রকাশ রুবেল, জুলফিকার আলী, মিনহাজ উদ্দিন রুবেল (২৩), তানজিব হোসেন, কাজী আহাম্মদ এরফান ইকরাম (২১) ও ডেন্টাল সার্জন মোরশেদুল আলম, ফটিকছড়ির সাফায়েত ইয়াছিন ও তার ভাই সোহান ইয়াছির, ফটিকছড়ির বাসিন্দা ওমানপ্রবাসী সাহেদ হোসাইন সাকের, হাটহাজারীর ইসমাইল হোসেন, মোবারক হোসেন, আতিকুর রহমান (২৬), ইমতিয়াজ সেলিম এবং মোন্তাসির আলম রাজিব (২৫)।
তালিকায় হারুন বিন ইজাহারের পরিচয় হিযবুত তাহরীর হিসেবে উল্লেখ থাকলেও তিনি মূলত যুক্ত আছেন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে। তিনি সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা স¤পাদক। হরকাতুল জিহাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত হেফাজত নেতা মুফতি ইজাহারুল ইসলাম তার পিতা।
(ঢাকাটাইমস/ ২৪ জুন /আইখ/ এআর/ ঘ.)