মানবতাবিরোধী অপরাধে যখনই কোনো জামায়াত নেতার ফাঁসির প্রসঙ্গ আসে, তখনই দেশের কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসী হামলা বা গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটে। আপিল বিভাগে গত কয়েকটি রায় এবং রায়ের পর ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করে এমনটি দেখা গেছে। অবশ্য গুপ্তহত্যার প্রতিটি ঘটনার পরই আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএসের পক্ষ থেকে এসব হত্যার দায় স্বীকারের দাবি জানা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
তবে সরকার বলছে, প্রচার পেতেই দেশের ভেতর নাশকতাকারীরা আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম প্রচার করছে। এসব গুপ্তহত্যার পেছনে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও তুলেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও এই ইঙ্গিত দিয়েছেন। চট্টগ্রামে খুন হওয়া পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার পর জেলায় সাবেক এক শিবির নেতাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম জামায়াত নেতা হিসেবে আবদুল কাদের মোল্লার দ- ঘোষণার আগ থেকেই ঘোষণা দিয়ে সারা দেশে সহিংস অবস্থান নিয়েছিল জামায়াত-শিবির। তবে ট্রাইব্যুনালের রায়ে তার যাবজ্জীবন দণ্ড হওয়ার পর দলটির নেতা-কর্মীরা অনেকটাই চুপ হয়ে যায়। অবশ্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তখন সারা দেশে গড়ে ওঠে আন্দোলন যা গণজাগরণ নামে পরিচিতি পায়।
এই আন্দোলন চলাকালেই আরেক জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হয় ট্রাইব্যুনালে। আর সকালে রায় ঘোষণার পর পর জামায়াত অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় নজিরবিহীন সহিংসতা। সরকারি সম্পত্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, জামায়াতবিরোধীদের ওপর বেপরোয়া হামলা, ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিÑসব মিলিয়ে প্রাণ হারায় ৭০ জনেরও বেশি।
আপিল বিভাগের রায়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পরও ব্যাপক সহিংসতা চালায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তবে এরপর একে একে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, এ টি এম আজহারুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির আবদুস সুবহান, আমির মতিউর রহমান নিজামী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল বা আপিল বিভাগের রায়ের পর জামায়াতের প্রকাশ্য তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। রায়ের প্রতিবাদে হরতাল ডাকলেও তা সফল করতে নেতা-কর্মীরা বলতে গেলে কিছুই করেনি।
তবে এই সময় শুরু হয় গুপ্তহত্যা। নেতাদের বিরুদ্ধে রায়ের আগে পরে বা দণ্ড কার্যকরের প্রসঙ্গ এলেই ঘটা নানা ঘটনার কারণে এর পেছনে স্বাধীনতাবিরোধী দলটির নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ আসছে জোরালভাবে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবীর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জামায়াত-শিবির শুরু থেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করে আসছে। নেতাদেরকে রক্ষায় নাশকতাসহ নানা ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যাও এই ধারাবাহিকতার অংশ হতে পারে। নইলে কেন জামায়াত নেতাদের ফাঁসির রায়ের আগে-পরে এতগুলো ঘটনা ঘটবে?’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এ বিষয়ে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে। কিন্তু তখন তারা ব্যর্থ হয়। এরপর ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বানচাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে সহিংসতা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। কিন্তু তখনও উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় তারা। এখন তারা গুপ্তহত্যার পথ বের করেছে। তাই তো যখনই কোনো শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের সময় ঘনিয়ে আসে, তখনই এ ধরনের হামলা, হত্যা শুরু হয়।
এ বিষয়ে অবশ্য জামায়াত বা শিবিরের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং সরকার পতনের আন্দোলনে নাশকতার পর থেকে দলটির নেতা-কর্মীরা কেউ প্রকাশ্যে নেই। তারা গোপন স্থান থেকে তৎপরতা চালাচ্ছেন।
শুরু ব্লগার রাজীবকে দিয়ে
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনে যখন সারা দেশ উত্তাল তখনই ঢাকায় খুন হন গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম কর্মী রাজীব হায়দার। মিরপুরে নিজ বাড়ির কাছে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। এই ঘটনায় জঙ্গি সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের নাম আসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে। এরই মধ্যে বিচারিক আদালত দুই জনের মৃত্যুদণ্ড, একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দিয়েছে আদালত। এরপর নানা সময় খুন বা হামলার শিকার হয়েছেন ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, বিজ্ঞান লেখক, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, শিক্ষক ও প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা।
জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল। তিনদিন পর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বইমেলা থেকে ফেরার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে। কুপিয়ে আহত করা হয় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকেও। তবে মারাত্মক জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এই হত্যা মামলার তদন্তে এখনো পর্যন্ত বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই সদস্যদের পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও তদন্তেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
এরপর বেশ কয়েক মাস গুপ্তহত্যা বা হামলার ঘটনা ঘটেনি। তবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর পর হামলা হয় বেশ কয়েকজন ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের ওপর। দুই মানবতাবিরোধী অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর। আপিল বিভাগের রায়ের আগে-পরে ঢাকায় খুন হন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, সিলেটের অনন্ত বিজয় দাস। দীপনের সঙ্গে একই দিন হামলায় আহত হন প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, লেখক-ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসু।
এরপর কার্যকর হয় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড। গত ১১ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। আপিল বিভাগের রায়ের পর এবং রিভিউ আবেদন চলার সময় আবার ঘটে গুপ্তহত্যা। এবার কলাবাগানে নিহত হন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়। নিজ বাসায় ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় এ দুজনকে। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই টাঙ্গাইলে খুন হন দর্জি নিখিল জোয়ার্দার। নিজ দোকানের সামনে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে হত্যা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আপিল বিভাগ এবার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে। গত ৫ জুন তার দণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। চলতি বছরের ৮ মার্চ তার ফাঁসির দ- বহাল রাখে আপিল বিভাগ। এই দণ্ড বহাল রাখার পরও বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় আলোড়ন হয় দেশজুড়ে। এই পূর্ণাঙ্গ রায় যে কোনোদিন প্রকাশ হতে পারে সেটা জানা ছিল আগে থেকে।
এই রায় প্রকাশের দিন সকালেই চট্টগ্রামে খুন হলেন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অন্যতম সফল পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। দুর্বৃত্তরা তাকে এক মিনিটেরও কম সময়ে খুন করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে নাটোরে খুন হন খ্রিষ্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ। তার ওপরও অতর্কিত হামলা করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
৭ জুন ঝিনাইদহে খুন হন হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি। তার ওপরও হামলা হয় একই কায়দায়। কুপিয়ে হত্যার পর মোটর সাইকেলে করে পালিয়ে যায় তারা। ১০ জুন পাবনার হেমায়েতপুরে খুন হন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে।তাকেও হত্যা করা হয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে।
এভাবে গুপ্তহত্যার প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা গেছে খুনিরা কাজ সেরেছে খুবই কম সময়ে। যারা খুনে জড়িত তারা সবাই প্রশিক্ষিত বলেই ধারণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কেবল আশিকুর রহমান হত্যার ঘটনায় হাতেনাতে দুইজনকে আটক করে স্থানীয়রা। অন্য সব কটি ঘটনাতে নির্বিঘেœ পালিয়ে যায় খুনিরা। আর তাদেরকে গ্রেপ্তার এমনকি শনাক্ত করতেও ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। যদিও বাহিনীটি বরাবর বলে আসছে তদন্তে অগ্রগতির কথা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরাও এখন গুপ্তহত্যায় জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পেট্রল বোমায় মানুষ হত্যা শেষে এখন শুরু হয়েছে বেছে বেছে হত্যা। খুনিদের বিষয়ে সরকারের কাছে তথ্য আছে জানিয়ে সবাইকে গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের কিছু কর্মী এসব ঘটনায় জড়িত, এ বিষয়ে আমাদের কাছেও তথ্য আছে।’ তথ্য থাকলে খুনিদেরকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না কেন, তদন্তেই বা অগ্রগতি নেই কেন, জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজধানীতে গুপ্ত হত্যা মামলার তদন্তে বেশ কিছু অগ্রগতি আছে। আগামী মাসের মধ্যেই কিছু মামলার প্রতিবেদন দেওয়া হবে আদালতে।’
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (অপরাধ) মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সব ঘটনা অবশ্যই একই সূত্রে গাঁথা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করতে এসব ঘটনা ঘটতে পারে। তবে আমরাও বসে নেই, আজ হোক কাল হোক সবাই ধরা পড়বে।
(ঢাকাটাইমস/১০ জুন /এএ/ডব্লিউবি/)