চার দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়জয়কার হলেও নৌকার পরাজয় হয়েছে দলটির বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যের এলাকায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও রাজনীতিকের এলাকার ইউনিয়নেও হারতে হয়েছে নৌকা প্রতীক পাওয়া দলীয় প্রার্থীদের।
ভেতরের দুশ্চিন্তা থাকলেও প্রকাশ্যে দলটির নেতারা বলছেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এলাকায় নৌকার পরাজয়ে প্রমাণিত হয়েছে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে। অন্যদিকে তৃণমূল নেতারা বলছেন, তৃণমূলের মতামতকে উপেক্ষা করায় এ ভরাডুবি হয়েছে। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা এ প্রসঙ্গে বলেন, বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পরাজয়ের ভেতর দিয়ে প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলেও নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছে না। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব ও কারচুপি করে ফল ছিনিয়ে আনার অভিযোগ থাকলেও মন্ত্রীদের এলাকায় দলীয় প্রার্থীর পরাজয়কে উদাহরণ হিসেবে দেখছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা ক্ষমতায় আছি তাই প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকতেই পারে। কিন্তু মনোনয়ন তো একজনকেই দিতে হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত না মেনে অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, সেটা সত্য। এতে তাদের মধ্য থেকে অনেক প্রার্থীই বিজয়ী হচ্ছে। আবার তাড়াহুড়োর কারণে কিছু ইউনিয়নে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয় হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, কোনো কোনো মন্ত্রীর এলাকায় নৌকা প্রতীক পাওয়া প্রার্থীর পরাজয় মানে সেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা নেই বিষয়টি এমন নয়। তিনি বলেন, এটা প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছে না। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করে তুলতে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর, এটা প্রমাণ করতে এর চেয়ে বড় আর কোনো উদাহরণের প্রয়োজন নেই।
শীর্ষ নেতৃত্বকেই দায়ী করছেন তৃণমূলের নেতারা
খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তৃণমূলের পছন্দের প্রার্থী শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পাননি বলেই এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র ও বিএনপির প্রার্থীরা বেশি জয়ী হয়েছেন। সারা দেশের বিভিন্ন ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক যারা পেয়েছেন, আমি মনে করি বেশিরভাগ ইউনিয়নে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন পাননি। যেখানে তৃণমূলের পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, সেখানে ঠিকই নৌকার প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম সিলেট সদর। এখানের এমপি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার নির্বাচনি এলাকায় ৮টি ইউনিয়নে এ পর্যন্ত নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুটিতে নৌকার প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। টুকেরবাজার ও হাটখোলা ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। বাকি দুটি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। কিশোরগঞ্জ সদরের এমপি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এখানে মাইজকাপন ও রশিদাবাদ ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। দুটিতে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন তিনি। এ সংসদীয় আসনের ১৩টি ইউপিতে নির্বাচন হয়। এর মধ্যে সদরপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টিতেই জয়ী হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। এগুলো হলোÑ সদরপুর, ভাসানচর, চরনাসিরপুর, আকোটেরচর, দিয়ারা নারিকেলবাড়িয়া এবং ঢেউখালী। অন্যদিকে চরভদ্রাসন উপজেলার চারটির মধ্যে গাজীরটেক এবং চরহরিরামপুর ইউনিয়নে জিতেছেন বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী।
জানতে চাইলে কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, আমাদের এলাকায় আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হননি। দুই-তিনটিতে বিএনপি এবং দুই-তিনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছে। আর পাঁচটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী তো বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারে না। কারণ তারা তো আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নই চাননি। সিলেট-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ আসনের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউপির মধ্যে মাত্র দুটিতেই জিতেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী। বাকি ৯টির চারটিতে বিএনপি ও পাঁচটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সংসদীয় আসন মাদারীপুর সদর ও কালকিনি উপজেলা নিয়ে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ১৫টি ইউপির মধ্যে ৬টিতেই হেরে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এগুলো হলোÑ কেন্দুয়া, কুলিয়া, রাস্তি, পাঁচখোলা, ছিলারচর ও ধুরাইল। অন্যদিকে কালকিনি উপজেলার ১৩টি ইউপির মধ্যে ৭টিতেই হেরে গেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। এ ইউনিয়নগুলো হলোÑগোপালপুর, কাজীবাকাই, কয়ারিয়া, বাঁশগাড়ী, আলীনগর, ডাসার ও বালিগ্রাম।
চতুর্থ ধাপে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি ইউপি পঞ্চসার, রামপাল এবং বজ্রযোগিনী ইউপিতে নির্বাচন হয়। এর সবকটিতেই হেরে গেছেন নৌকার প্রার্থীরা। এই সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-দপ্তর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস। খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য মৎস্য, প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তার নির্বাচনি আসন ফুলতলা উপজেলায় চারটি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়েছে। এখানে সদর ইউনিয়ন ফুলতলায় বিএনপির প্রার্থী নৌকার প্রার্থীকে হারিয়েছেন। অন্য একটি ইউনিয়নেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হারিয়েছেন নৌকার প্রার্থীকে। বাকি দুটিতে নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।
শেরপুরের শ্রীবর্দী উপজেলায় এ পর্যন্ত ৬টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়েছে। এখানে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য এ কে এম ফজলুল হক। এ উপজেলার কুড়িকাহানিয়া ও গড়জরিপা ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। অন্য দুটিতে নৌকার প্রার্থী হেরেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। মাত্র দুটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী জয়ী হয়েছে।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের নির্বাচনি উপজেলা। তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এ উপজেলায় মাত্র একটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। খলশী ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী ও ছয়টি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীকে বিদ্রোহী প্রার্থীরা হারিয়ে দিয়েছেন। একই জেলার হরিরামপুর উপজেলা কণ্ঠশিল্পী মমতাজের নির্বাচনি আসন। এ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নেই নৌকার প্রার্থীকে হারিয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা। এই ইউনিয়নগুলো হলোÑ গালা, বলরা, বররা, গোপীনাথপুর ও বালা। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন তিনটিতে। মাত্র একটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এত বাজে ফলাফল করার বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুল হুদা সেলিম বলেন, ‘আমাদের দলের গ্রহণযোগ্যতার কোনো অভাব নেই। কিন্তু প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল-ত্রুটির কারণে নৌকার প্রার্থীদের পরাজিত হতে হয়েছে।’ বরগুনা সদর আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। কিন্তু সদর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঢলুয়া ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক পাওয়া প্রার্থীকে হারিয়ে বিএনপির প্রার্থী জিতে গেছেন। এ উপজেলার অন্য তিনটি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হারতে হয়েছে নৌকার প্রার্থীদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে দুটিতে জিতেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। পাঁচটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী জিতেছেন। অন্যদিকে পাঁচটিতে জিতেছেন বিএনপি ও দুটিতে জামায়াতপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন। এ উপজেলায় আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থীরা স্থানীয় সাংসদ গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মঈনুদ্দিন ম-ল বলেন, স্থানীয় সাংসদ রব্বানী নিজের স্বার্থের জন্য দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। এ কারণেই নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম সুজন। এ উপজেলার ছয়টি ইউপির মধ্যে তিনটিতে হেরে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এ তিনটি ইউনিয়ন হলো বোদা সদর, পাঁচপীর ও চন্দনবাড়ি ইউনিয়ন।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।