ঢাকা: প্রশাসনে এখনো প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের ব্যাচমেটরা পদোন্নতি পেয়ে দুই-তিন ধাপ উপরে উঠে গেছেন। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন (সুপারসিড) করে অধঃস্তন কর্মকর্তাদের পদোন্নতির কারণে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা ও ক্ষোভ।
যদিও সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এমন পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত তিনটি পর্যায়ে ২৩০ জনকে পদোন্নতি দেয়, তারপরও ভাগ্যে পদোন্নতি মেলেনি শতাধিক বঞ্চিত কর্মকর্তার।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ-সচিব আলী ইমাম মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, “আমাদের প্রশাসনের এটা একটা চলমান সমস্যা। যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা কিছু কর্মকর্তাকে নিজেদের লোক মনে করে নানা সুযোগ-সুবিধা দেন। পদোন্নতি এর একটি। কিন্তু এটা করতে গিয়ে কিছু লোক আবার বঞ্চিত হন। এতে তারা কর্মোদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেন আর প্রশাসন হয়ে পড়ে মেধাশূন্য। ফলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকারই।”
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “সম্প্রতি সরকার বঞ্চিতদের পদোন্নতি দিতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা প্রশংসার। তবে কোনো কারণে কেউ যেন বাদ না পড়ে যায় সেদিকটিতে লক্ষ রাখতে হবে।”
সম্প্রতি পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হন ৮৬ জন, উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব ৭৩ জন এবং সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব হন ৭১ জন।
এই পদোন্নতির মধ্যেও আছে হতাশা। নিয়মিত পদোন্নতি হলে যে সিনিয়র সহকারী সচিবের এত দিনে অতিরিক্ত সচিব হওয়ার কথা ছিল, তিনি মাত্র এক ধাপ পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন উপসচিব।
বঞ্চিত এসব কর্মকর্তার বেশির ভাগই বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছিলেন। নিয়মিত পদোন্নতির দাবিদার এই কর্মকর্তাদের তখন বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
কোন কারণে এবং কোন অযোগ্যতায় তাদের বারবার বাদ দিয়ে অধস্তনদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে, তা তাদের কাছে বোধগম্য নয় বলে জানান তারা।
ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের অনেকে এ প্রতিবেদকের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান, কোনোভাবেই তারা নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না।
শুধু পদোন্নতিবঞ্চিতদের জন্য এসএসবির (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) বৈঠক হওয়ায় পদোন্নতি-প্রত্যাশী যে কর্মকর্তারা বঞ্চনা অবসানের আশা করেছিলেন, তারাও হতাশ।
নবম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার ব্যাচের প্রায় সবাই এখন যুগ্ম সচিব। পদোন্নতি না পেয়ে কয়েকজন উপসচিব। কিন্তু আমি এখনো সিনিয়র সহকারী সচিব।’
প্রশাসনে সর্বশেষ যে পদোন্নতি হয়েছে, সেখানেও ওই কর্মকর্তা বাদ পড়েছেন। হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কত দফায় বঞ্চিত হয়েছি হিসাব না করাই ভালো। এখন তো চাকরি ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা দেখছি না।’
যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত কয়েকজন কর্মকর্তার একজন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় তিনি একজন উপদেষ্টার একান্ত সচিব ছিলেন। কেউ কেউ বলছেন, এটাই নাকি তার অপরাধ। তিনি বলেন, ‘তাহলে এই বিচার কার কাছে দেব?’ তিনি জানান, তার ব্যাচমেটরা এখন সচিব হওয়ার অপেক্ষায়, সেখানে তিনি এখনো উপসচিব!
১৯৮৫ ব্যাচের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাচের মেধা তালিকার ৫০ জনের মধ্যে ছিলেন তিনি। অথচ এবারও তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়নি।
একই ব্যাচের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার একজন ব্যাচমেট এখন অতিরিক্ত সচিব। তার ও আমার সন্তান একসঙ্গে পাশাপাশি বাসায় বড় হয়েছে। দুজনের মধ্যে রয়েছে পারিবারিক সম্পর্ক। কিন্তু আমি এখনো উপসচিব থেকে গেলাম।’
পদোন্নতিবঞ্চিত একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এসএসবির একজন প্রভাবশালী সদস্যের আত্মীয় চিহ্নিত জামায়াতের লোক। অথচ তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। বড় প্রত্যাশা ছিল, এবার এসএসবি অন্তত ন্যায়বিচার করবে। কিন্তু সেই পুরনো খোলস থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারেনি।’
যুগ্ম সচিব পদে চতুর্থবারের মতো বঞ্চিত একজন কর্মকর্তা দুঃখ করে বলেন, ‘লিখে দেন আমি বিএনপি-জামায়াতের লোক। এ জীবনে আমার আর পদোন্নতি হবে না। আমার কী অপরাধ তাও জানি না। কোনোদিন জানতেও পারব না। হয়তো উপসচিব পদে থেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হবে।’ বিসিএসের ১৯৮৫ ব্যাচের এই কর্মকর্তা জানান, তিনি ছাত্রজীবনে বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করা বঞ্চিত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবেই ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আমাকে ডিসির দায়িত্ব দিয়েছিল। নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্বও পালন করেছিলাম। কী কারণে পদোন্নতি হচ্ছে না তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হয়তো কোনোদিন জানাবে না।’
পদোন্নতির ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের এভাবে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এপিডি) সুবীর কিশোর চৌধুরী বলেন, ‘এটি রিভিউ পদোন্নতি। এসব কর্মকর্তার তালিকা আগেই প্রস্তুত করা ছিল। নতুন করে পদোন্নতি দিতে আবারও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তখন বিষয়টি দেখা হবে।’
বঞ্চিত হলেন যারা: পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তার দাবি ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এবার যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাননি বিসিএস ১৯৮৫ ব্যাচের রেকর্ডসংখ্যক কর্মকর্তা। এদের মধ্যে রয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক কাজী আনোয়ারুল হাকিম, আবদুল্লা হেল বাকী, ফজলুজ জোহা, কামরুজ্জামান, কাজী মেরাজ হোসেন, সলিমুল্লাহ, মনিরুল ইসলাম, শেফাউল করিম, শাহেদ ইকবাল, হুমায়ুন কবীর, সাইফুল ইসলাম, জসিমউদ্দিন বাদল, সাজেদুল কাইয়ুম দুলাল, জামাল আহমেদ, নিমাইচাঁদ বিশ্বাস, মহাদেব বিশ্বাস, এআরএম খালেদুজ্জামান, আবুল কালাম আজাদ, আবদুল ওয়াহাব খান, জুলফিকার আলী হায়দারী, ইকরামুল হক, রাশিদুল ইসলাম, নেসার হোসেন আজাদ, শুভাশীষ সাহা, আবদুর রশীদ, জগন্নাথ দাস খোকন, শফিক আনোয়ার, খন্দকার মোখলেসুর রহমান, এ এন এ রহমান ও খন্দকার রফিকুল ইসলাম, মফিজ আহমেদ পাটোয়ারী, মফিজুল ইসলাম, আবু তালেব, মুহাম্মদ ইয়াহিয়া, এসএম শাহীন রেজা, তাহসিনুর রহমান, এস এম ফিরোজ, নাসির উদ্দিন আহমেদ, মশিউর রহমান, জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী, মোজাম্মেল হোসেন, ড. কাইয়ুম আরা বেগম, আবদুল আহাদ।
১৯৮৬ ব্যাচের বঞ্চিতদের মধ্যে রয়েছেন, শামসি আরা বিনতে হুদা, আমিনুর রহমান, লাইসুর রহমান, জুবাইদুর রহমান, মাকসুদুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম, মকসুদুর রহমান, এম এ নোমান, আবদুল্লাহ আল মামুন, মনির হোসেন, হাওলাদার জাকির হোসেন, কল্লোল চক্রবর্তী প্রমুখ।
নবম ব্যাচেরও উল্লেখযোগ্য কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছেন. মধ্যে রয়েছেন- নবম ব্যাচের মেধা তালিকায় দ্বিতীয় জাকের হোসেন, মহাজোট সরকারের আমলে রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম খান, নীলফামারীর জেলা প্রশাসক মু. আবদুল মজিদ, রেজাউল হায়দার, শাহাদাত হোসেন, খলিলুর রহমান, আবদুস সাত্তার, ফারুক আলম, আবদুল্লাহ আল মামুন, আলী রেজা মুজিব, জিএম কাদের, নজরুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, মাসুদুর রহমান, নাসরিন খোরাসানী, সিরাজুল হক, আবদুল মান্নান, এ জে এম আবদুল্যাহেল বাকি, মো. মোস্তা গাউসুল হক প্রমুখ।
একইভাবে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দিতেও বঞ্চিত করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যাচের অনেক দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে জোট সরকারের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ এস এম আবদুল হালিমের একান্ত সচিব (পিএস) নবম ব্যাচের তাজুল ইসলাম, গাজী উদ্দিন মল্লিক, মো. সেলিম, দশম ব্যাচের মো. সিরাজুল ইসলাম খান, ১৩তম ব্যাচের মো. আবদুল খালেক, সেকান্দার হায়াৎ রিজভী, ড. নাজমুল আমিন মজুমদার প্রমুখ।
২০তম ব্যাচের বঞ্চিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- হুমায়ুন কবীর, সামসুল আজম, মোহাম্মদ আবুল হাশেম, শামীম সোহেল, ফারুক আহমেদ, কেএম আলী আজম, রাজা মো. আবদু হাই, গোলাম আজম, নাজমা জেসমীন, খলিল আহমেদ, সৈয়দা আমেনা ফাহমীন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, মনির হোসেন, রাহেদ হোসেন, মোস্তাক উদ্দিন আহমেদ, মুহাম্মদ নুরুজ্জামান, মনিরুজ্জামান, জাহিদ হোসেন, খালেদ মহিউদ্দিন, মিহির কান্তি রাউত, রাশিদা সুলতানা, জহিরুল ইসলাম, নাজমুস সাদাত, ড. আহমদ উল্লাহ, মো. আরফানুল হক, মাহফুজুর রহমান, শারফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান, শামীম আহমেদ, আরিফুল হক, মোস্তফা জামান, মুহাম্মদ নুরে আলম সিদ্দিকী, লুৎফর রহমান, মোহাম্মদ জাফর আলম, সঞ্জয় চক্রবর্তী, এস এম হাবিবুর রহমান হাকিম, এস এম হুমায়ুন কবীর সরকার প্রমুখ।
(ঢাকাটাইমস/২৬মে/মোআ/ডব্লিউবি)