logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
অবৈধ দখলে ফুটপাত
অভিযান মানেই টাকার অপচয়!
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
১০ জুন, ২০১৬ ১০:৫৫:৩৭
image



ঢাকা: রাজধানীর শাহবাগের ফুটপাতে উচ্ছেদ করা ফুলের দোকানগুলো ফিরে এসেছে। ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে শতাধিক দোকান উচ্ছেদ করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশান। সেই অভিযানের কোনও নমুনাই এখন বোঝা যায় না।






নগরবাসীর চলাচলের সুবিধা করে দিতে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে পুলিশ বা সিটি করপোরেশনের সব চেষ্টার পরিণতিই মোটামুটি একই রকম। নির্বিঘ্ন হাঁটার সুযোগ না পেয়ে নগরবাসী চলছে মূল সড়ক ধরে। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে সড়ক ধরে চলা গাড়ি। ঈদের আগে আগে ফুটপাতের ভোগান্তি আরও বেশি।






প্রতিবার ঘটা করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা খরচ করে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। সিটি করপোরেশন এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বরাবর উচ্ছেদের পর আবার বেদখল হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না।






এ জন্য সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা দায়ী করছেন পুলিশকে আর পুলিশ দায়ী করছে সিটি করপোরেশনকে। দুই পক্ষই আবার জনবল সংকটকে অযুহাত হিসেবে দেখাচ্ছেন।






ফুটপাতের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে ব্যবসা করতে হলে কাউকে না কাউকে টাকা দিতে হয় তাদেরকে।






সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল সংকটের কারণে সর্বক্ষণিক নজরদারির অভাব এবং উচ্ছেদের পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অসহযোগিতার কারণে অভিযান ফলপ্রসূ হচ্ছে না। অন্যদিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা বলছেন, পুলিশকে ফুটপাত ছাড়াও আইন-শৃঙ্খলার সকল ক্ষেত্রে নজরদিতে হয়। সিটি করপোরেশনের কোথায় কোন স্থাপনা বসবে সেটা তাদের বিষয়। তারা যদি কোন সহযোগিতা করতে পুলিশ বাহিনী প্রস্তুত আছে।






দফায় দফায় অভিযানের পর পুনর্দখল হয়ে গেছে এমন তালিকায় আছে রাজধানীর গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, বায়তুল মোকাররম, জিপিও মোড়, ক্রীড়াভবন, দৈনিক বাংলা, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, দিলকুশা, মতিঝিল, ফকিরাপুল, টিকাটুলি, সদরঘাট, বঙ্গবাজার, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, ঢাকা কলেজ, গাউছিয়া, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মোড়, শাহবাগ, মালিবাগ-মৌচাক, ফার্মগেট, বাড্ডা, রামপুরা, শাহজাদপুর, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যস্ততম ফুটপাত।






সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, ফুটপাতে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান চালানোর মতো তেমন কোনো লোকবল নেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। যে কারণে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানোর পর ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে নিয়মিত নজরদারি রাখতে পারছে না তারা। এরওপর ফুটপাত পুনর্দখলে খোদ পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতার সহায়তা পাচ্ছে হকাররা।






সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অভিযানের কিছুক্ষণ পরই ফুটপাতে আবারও হকারদের বসিয়ে দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারা। এর বিনিময়ে প্রতিদিন হকারদের কাছ থেকে তারা তুলে নিচ্ছেন চাঁদা। সেই চাঁদার ভাগ যাচ্ছে পুলিশের পকেটেও।






অবশ্য হকারদের পুনর্বাসন করা যাচ্ছে না বলেও ফুটপাত পুনর্দখল হচ্ছে বলে দাবি করছেন কেউ কেউ। তাদের বক্তব্য, উচ্ছেদ অভিযানে নামার আগে হকারদের পুনর্বাসনের জন্য তালিকা করা হয়। কেবল গুলিস্তানেরই প্রায় দুই হাজার হকারকে পুনর্বাসনের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু সে তালিকা ‘তালিকা’ই থেকে গেছে।






অন্যদিকে হকারা বলছেন, ফুটপাতে ব্যবসা করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা। তাই ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করা হলেও নানা কৌশলে আবার বসতেই হয়।






নিউমার্কেট এলাকার একজন দোকানদার বলেন, ‘উঠিয়ে দেয়া হলেও এলাকার বড়ভাইদের ম্যানেজ করে আমরা আবারও দোকান খুলতে পারি। বিনিময়ে তাদের প্রতিদিনই টাকা দিতে হয়’।






ওই দোকানি জানান, দোকান কত বড়, তার ওপর ঠিক হয় চাঁদা। সর্বনিম্ন ৬০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় চাঁদা। এই হিসাবে কেবল সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে নীলক্ষেত মোড়ের দুই পাশে পাঁচ শতাধিক দোকান থেকে দিতে ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা চাঁদা উঠে। 






সিটি করপোরেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ফুটপাত পুরোপুরি উচ্ছেদ করার যাচ্ছে না এর দুইটা কারণ আছে। একটা হল দেশের এক শ্রেণির মানুষ আছে যাদের জীবন-জীবিকা ফুটপাতে ব্যবসা করেই নির্বাহ করে। আরেকটা হল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আইন প্রয়োগে দুর্বলতার। কারণ সিটি করপোরেশন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে উচ্ছেদ করে কিন্তু উচ্ছেদের পর আবার বসছে কিনা সেটা দেখবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাঁরা যদি সজাগ হতো তাহলে কিছুটা আইন প্রয়োগ এবং কিছুটা পুর্ণবাসনের মাধ্যমে ফুটপাত উচ্ছেদ করা যেত।






এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম বিভাগের উপ-কমিশনারের (ডিসি) মাসুদুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হচ্ছে যেখানে আইনের ব্যতয় ঘটে সেখানেই ব্যবস্থা নেয়া। সিটি করপোরেশন যখনই সহায়তা চায় তখনই আমরা তাদের সহায়তা করি’। তিনি বলেন, ‘রাজধানীর কোথায় কোন স্থাপনা বসবে সেটার দায়-দায়িত্ব তো আমাদের না। তার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তবে তারা যখন উচ্ছেদ অভিযানে আমাদের সহায়তা চায় তা আমরা তাদের করছি এবং আগামীতেও করবো’।






নগরবিদ ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরীর যেসব সমস্যা থাকে ঢাকাতেও তাই আছে। আমরা বারবারই বলে আসছি ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য যে ধরনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন ছিল তা নেওয়া হয়নি। এজন্যই ফুটপাত, সড়ক দখল থেকে শুরু করে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে।’






নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ছিন্নমূল ব্যবসায়ী যারা যত্রতত্র দোকান সাজিয়ে বসছেন তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে? নগর পরিকল্পনার ভেতর এই বিষয়গুলোও আশা উচিত। যদি তাদের বিকল্প জায়গার ব্যবস্থা করে দেওয়া যেত তাহলে উচ্ছেদ অভিযান দরকার হতো না।’






ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিতই ফুটপাত উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করে থাকি। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে আমাদের সর্বক্ষণিক নজরদারীর অভাবে আবারও ফুটপাত দখল হয়ে যায়। অভিযানের পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আইন প্রয়োগ করতো তাহলে এ অবস্থা হতো না’।






ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেসবাউল ইসলামের দাবি, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে তারা নিয়মিতই অভিযান করছেন। তিনি বলেন, ‘অভিযান পরিচালনার পর যেন আবারও হকাররা বসতে না পারে সেই জন্য পুনরায়ই অভিযান পরিচালনা করি। এটা স্বীকার করি যে, আমরা পুরোপুরি সফল হতে পারছি না’।






(ঢাকাটাইমস/১০জুন/টিএ/ডব্লিউবি)