logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা
চ্যালেঞ্জ অনেক, পদক্ষেপ কম
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
০২ জুন, ২০১৬ ০৮:৩৮:৩২
image




ঢাকা: জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ হবে না বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, সরকার এখনই এই পদ্ধতি চালু করতে চাইলেও শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যক্রম তৈরি, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমন্বয় করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এ জন্য প্রচুর বরাদ্দের প্রয়োজন হলে শিক্ষাখাতে সরকার তা দিতে পারবে কি না, সে নিয়ে আছে সংশয়।



তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব হুমায়ূন খালিদ ঢাকাটাইমসকে জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত হলেও প্রাথমিক স্কুলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস চালু হবে না। ষষ্ঠ থেকে তিন বছর শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক স্কুলেই ক্লাস করবে, কিন্তু এই সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনাটা থাকবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন।   



তাহলে বড় পরিবর্তন কোথায় আসছে? জানতে চাইলে হুমায়ুন খালিদ বলেন, সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটা হবে, সেটা হলো শিক্ষার্থীর জন্য আট বছরের শিক্ষা বাধ্যতামূলক হচ্ছে। আর পাঁচ বছরের বদলে আট বছরের শিক্ষা বিনামূল্যে হবে। আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৭ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থাকবে না। অষ্টম শ্রেণি শেষে হবে এই পরীক্ষা। তখন এই পরীক্ষার নাম হবে প্রাথমিক স্কুল সার্টিফিকেট (পিএসসি) পরীক্ষা। এখন অষ্টম শ্রেণি শেষে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা হয়। ২০০৯ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়েছিল।



প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা হলেও আপাতত ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতি এখনকার মতোই চলবে। তবে যে ৭৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু করা হয়েছে, সেগুলোর শিক্ষকদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আলাদা প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে কোনো পরিবর্তন হবে না। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।



উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে প্রাথমিক স্তর আছে। এসব বিদ্যালয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে কোনো এলাকায় যদি নতুন করে অষ্টম শ্রেণি পড়ানোর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয়, তখন ওই এলাকার কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু করা হবে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।



এত দিন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা হলেও আগামী বছর থেকে অষ্টম শ্রেণি শেষে যে পরীক্ষাটি হবে, সেটি নেওয়া হবে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে।



পঞ্চম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষা না হলে প্রাথমিক বৃত্তি দেওয়া হবে কিসের ভিত্তিতে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বলেন, পঞ্চম শ্রেণি শেষে নয়, অষ্টম শ্রেণি শেষেই মেধার ভিত্তিতে প্রাথমিক বৃত্তি দেওয়া হবে। আর শিক্ষানীতির আলোকে মাধ্যমিক শিক্ষা যেহেতু দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করা হবে, তখন প্রাথমিক বৃত্তির সময়কাল দশম শ্রেণি পর্যন্ত হতে পারে। তা ছাডা উপবৃত্তি দিয়ে এ সমস্যা কিছুটা হলেও দূর হবে।



৫০ লাখ শিক্ষার্থীর ব্যবস্থাপনা নিয়ে জটিলতার শঙ্কা



প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক- এই চার স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় সমন্বয় আনতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সঠিকভাবে সমন্বয় করতে না পারলে প্রতিটি স্তরে অধ্যয়নরত প্রায় অর্ধকোটির বেশি শিক্ষার্থী ভোগান্তিতে পড়বে। এর সঙ্গে কয়েক হাজার শিক্ষককে পোহাতে হবে বড় ধরনের ঝামেলা।



শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা কতটুকু সেটি দেখতে হবে। তারা বলছেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বিষয় হচ্ছে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন। শিক্ষানীতির আলোকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজ শেষ হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ে এই কাজ হয়নি। দুই স্তরের পাঠ্যক্রমে সেতুবন্ধন রচনা করা হবে নাকি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ পরিবর্তন করা হবে সে সিদ্ধান্ত হয়নি। সম্প্রসারিত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন হয়েছে এনসিটিবিতে।



এই কমিটি বলছে, নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নতুন করে তৈরি করতে হবে। বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেখানে নবম-দশম শ্রেণিও আছে? তাই একটি স্কুলকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর-এই কয়েক জায়গাতেই ছোটাছুটি করতে হবে।



শিক্ষকরা বলছেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে শিক্ষক সংকট। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কীভাবে চলবে? প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষকরাই কি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন? টিচার ট্রেনিং কলেজগুলো তাহলে শুধু নবম ও দশম শ্রেণিতে যারা পড়ান, তাদের প্রশিক্ষণ দেবে? এ বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া দরকার বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।



আবার প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক। আর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বেতন দিয়ে স্কুলে পড়ে। এই তিন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের যদি বেতন দিতে না হয়, তাহলে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে শিক্ষা খাতে, সে পরিমাণ বরাদ্দ বাজেটে রাখতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপ্রাপ্ত দুই হাজার ৩৮১টি নিম্নমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যাবে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ৫৫৩টি। এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫৫০। আর শিক্ষক হচ্ছেন ১৯ হাজার ২৪০ জন।



আবার দেশে ১৯ হাজারের মতো মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। এসব বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যায়, তাহলে ওই সব স্কুল কি শুধু নবম ও দশম শ্রেণি দিয়ে চলবে, নাকি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হবে- এরও কোনো নির্দেশনা আসেনি। আবার যেসব কলেজ শুধু একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি নিয়ে গঠিত, এগুলোর কী হবে? এগুলো কি কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে, নাকি সেখানে নবম ও দশম শ্রেণি খোলা হবে?



এসব চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ুন খালিদ এই ঢাকাটাইমসকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ধরে নিয়েই সবকিছু করা হবে। এটি বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। তবে সবকিছুই একসঙ্গে সমাধান হবে না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বেতনভাতা, জ্যেষ্ঠতার বিষয়টি পর্যালোচনা- সবকিছুই করা হবে। তবে রাতারাতি এসব ঠিক করা সম্ভব না। কিছু কাজ আছে যেগুলো সময় নিয়েই সমাধান করতে হবে।



এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে গত ৬ বছরে তেমন অগ্রগতি নেই। প্রস্তুতি ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে গেলে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি সামনে চলে আসবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে তা কিন্তু এ নো পরিষ্কার নয়। প্রস্তুতি ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করলে তিন স্তরের শিক্ষার বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।   



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, “এটি একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ। এটি বাস্তবায়ন করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এর মধ্যে ক্লাস পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন বিশেষ করে কর্মমুখী পাঠ্যক্রম প্রণয়নসহ আরও কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।”



(ঢাকাটাইমস/১জুন/এমএম/ডব্লিউবি)