logo ০৫ জুলাই ২০২৫
ড্রাগন চাষে কর্মকর্তা হলেন কৃষক
রিমন রহমান, ঢাকাটাইমস
০৭ আগস্ট, ২০১৬ ০৯:২৩:৫৩
image




রাজশাহী: ড্রাগন ফলটি এখনও সবমহলে তেমন পরিচিতই হয়ে ওঠেনি। তবে বাণিজ্যিক দিক বিবেচনায় এর গুরুত্ব অনেক। বলা যায়, এককালীন বিনিয়োগ করে দুই যুগ ধরে আয়ের উৎস গড়া যায় এই ড্রাগনের বাগান থেকে। মাত্র এক বিঘা জমি থেকেই প্রতিবছর কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব এই ফল চাষে।



এদিকে ড্রাগনের গাছ ক্যাকটাস প্রজাতির হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলে এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ কৃষকদের মাঝে এখনও সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি ড্রাগন চাষ। যে দুই-একটি জায়গায় এর চাষ হয়, সেখানকার বেশিরভাগ মানুষও জানেন না এর গুরুত্ব। তারা ড্রাগনের গাছকে ‘ওষুধের’ গাছ হিসেবেই চেনেন। অথচ বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের মাঝে ড্রাগন চাষ ছড়িয়ে দিতে পারলে তারা ব্যাপকভাবে লাভবান হবেন। আর এ লক্ষ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) মঞ্জুরুল হক।



কৃষকদের উৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগের এই ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তা নিজে ‘কৃষক’ হয়েছেন। ২১ কাঠা জমিতে মেক্সিক্যান ফল ‘ড্রাগন’ চাষ করে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। কৃষক বেশে তিনি নিজে চারা লাগিয়েছেন, পরিচর্যা করেছেন। এখন তার বাগান থেকে নিয়মিত ড্রাগন উঠছে। আর চোখ কপালে উঠছে সৌখিন চাষিদের। অনেকেই এখন তার কাছ থেকে ড্রাগনের চারা সংগ্রহ করছেন। ফলে ড্রাগন ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এভাবে মঞ্জুরুল হকের সে স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে, যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন ২০১২ সালে। তার বাগানটিও ওই বছর গড়ে তোলা হয়।



কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হকের ড্রাগন বাগান রাজশাহীর পবা উপজেলার মতিয়াবিলে। গত রবিবার তার বাগান ঘুরে দেখা যায়, ক্যাকটাসের মতো প্রতিটি ড্রাগন গাছেই ঝুলে আছে অন্তত ১২ প্রকারের অনেক ফল। কিছু ফল পেকে লাল টুকটুকে। আর কিছু পাকার অপেক্ষায়। একই গাছেই হলদে রঙের সুদর্শন ফুলও চোখে পড়ে তখন।



মঞ্জুরুল হক জানান, ২০১২ সালে তিনি নাটোরের সিংড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে এক কৃষক প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন চাষ শুরু করেন। তার বাগান পরিদর্শন করতে গিয়ে তিনি দেখেন, ক্যাকটাস প্রজাতির গাছ হওয়ায় এর জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি খুবই উপযোগী। তখন তিনি রাজশাহীর কৃষি কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন, এ অঞ্চলে ড্রাগন চাষ সম্প্রসারণের জন্য। কিন্তু তাতে খুব বেশি সাড়া না পাওয়ায় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে তিনি নিজেই এ অঞ্চলে একটি বাগান করার পরিকল্পনা করেন। সে মোতাবেক ওই বছরেরই জুনে নাটোর থেকে ৬০০ চারা সংগ্রহ করে পবার মতিয়াবিলে তিনি বাগান তৈরির কাজ শুরু করেন।



তিনি জানান, লতাগুল্মের মতো গাছ হওয়ায় চারা রোপণের পরই তিনটি গাছের মাঝামাঝি স্থানে একটি করে সিমেন্টের পিলার বসানো হয়। এই পিলারের ওপর তৈরি করা হয় একটি মাচা। ধীরে ধীরে গাছ বড় হয়ে এই মাচায় উঠে যায়। প্রথম বছর ২১ কাঠা জমিতে বাগান গড়ে তুলতে তার প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়। এর পরের বছরের জুলাইয়ে তার বাগান থেকে ফল উঠতে শুরু করেন।



মঞ্জুরুল হক জানান, ওই বছর তার বাগান থেকে ৬০ কেজি ফল পাওয়া যায়। কিন্তু ওই সময় রাজশাহী অঞ্চলে ড্রাগনের কোনো পরিচিতিই ছিল না। বাজারে বিক্রির জন্য তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওই বছর কোনো ব্যবসায়ীই এই ফল কিনতে রাজি হননি। তাই প্রথম বছরের ৬০ কেজি ফল সবাইকে বিনামূল্যে দিয়েই পরিচিত করে তুলতে হয়।



তবে এর পরের বছর অবশ্য তাকে আর ফল বিক্রি নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। ২০১৪ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তার জমি থেকে আট মণ ফল ওঠে। এসব ফল তিনি প্রতিকেজি ২৫০ টাকা দরে বিক্রি করেন। এরপরের বছর ৭০ মণ ফল বিক্রির আশা করেছিলেন তিনি। তবে ওই বছর জলাবদ্ধতার কারণে তার বাগানের ফল কমে গিয়ে ২৫ মণে দাঁড়ায়। এবারও এসব ফল তিনি প্রতিকেজি ২৫০ টাকা দরে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করেন।



তিনি আরও জানান, প্রচ- তাপদাহের কারণে চলতি মৌসুমে ফল এসেছে একটু দেরিতে। গত জুন থেকে তিনি ২৫০ টাকা কেজি দরে ১৫ মণ ফল বিক্রি করেছেন। আরও ২৫ মণ ফল বিক্রির আশা আছে। চলতি মৌসুমে সবমিলিয়ে চার লাখ টাকার ফল বিক্রির আশা করছেন তিনি। আগামী বছর টার্গেট আট লাখ টাকার ফল বিক্রির।



মঞ্জুরুল হক জানান, এক বিঘা জমিতে বাগান করতে প্রতিটি ৫০ টাকা দরে ৬০০টি চারা কিনতে হয়েছে। বসাতে হয়েছে ২০০টি পিলার। সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকা। আর এখন সার, কীটনাশক এবং শ্রমিকের মজুরি বাবদ প্রতিবছর প্রায় এক লাখ টাকা করে খরচ হচ্ছে। এভাবে অন্তত ২০-২২ বছর টিকবে বাগান। আর প্রতিবছর ফল পাওয়া যাবে অন্তত ৭ থেকে ৮ লাখ টাকার।



তিনি আরও জানান, ড্রাগনে তার এই সাফল্য দেখে অনেকেই এখন এটি চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এরই মধ্যে রাজশাহীসহ পাবনা, বগুড়া, ঢাকা, নওগাঁ ও নাটোরসহ বিভিন্ন এলাকার সৌখিন চাষিরা তার কাছ থেকে ড্রাগনের চারা নিয়ে যাচ্ছেন। বাগান করার পর এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০ জন চাষির কাছে তিনি দুই লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন। এভাবে ড্রাগনের সম্প্রসারণ শুরু হওয়ায় তার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।



রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালি বলেন, ড্রাগন খুবই লাভজনক একটি ফল। ক্যাকটাস প্রজাতির গাছ হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি এর জন্য খুবই উপযোগী। এ অঞ্চলে ড্রাগন চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এর সম্প্রসারণে একজন কৃষি কর্মকর্তা হয়ে মঞ্জুরুল হক যা করছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। নিজে চাষাবাদে নেমে তিনি কৃষকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, এর গুরুত্ব কত।



(ঢাকাটাইমস/৭ আগস্ট/প্রতিনিধি/এলএ)