বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাংলাদেশ ঘুরে গেলেও কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা-সমালোচনা ছিল। বলা হচ্ছিল, মাঠের আন্দোলনে ব্যর্থতার মতো কূটনৈতিক অঙ্গনেও যোগাযোগে পিছিয়ে পড়েছে বিএনপি।
তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে ঝটিকা সফরে আসা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকের পর কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে বিএনপিতে।
শুরু থেকেই এই বৈঠক নিয়ে বেশ গোপনীয়তা রক্ষা করে আসছিল বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। চেয়ারপারসনরে কূটনৈতিক কোরের সদস্য, প্রেস উইং থেকেও খুব জোরালোভাবে কিছু বলা হয়নি। তবে বৈঠক হবে এমন খবর কেউ কেউ নিশ্চিত করেছিলেন রবিবারই।
এদিকে দলীয় চেয়ারপারসনের সঙ্গে মার্কিন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সাক্ষাতের খবর জানিয়ে আগে থেকেই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন সারির নেতারা নানাভাবে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। কেউ আবার অভিযোগ করেছেন, সরকার নানা চেষ্টা করেছে এই সাক্ষাৎ যাতে না হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ফলে সরকারি প্রটোকলের বাইরে চলে যান দলটির প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। এরপরও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বাংলাদেশে এলে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বেগম খালেদা জিয়ার। তবে হঠাৎ করে এ ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়।
গত বছর খানেক বেশ কয়েকটি দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকরা বাংলাদেশে এলেও তাদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ ঘটেনি। সর্বশেষ উদাহরণ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর।
জুলাইয়ের শুরুতে গুলশানের আলোচিত জঙ্গি হামলার পর তার এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মনে করা হয়েছিল। তবে সফরকালে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও প্রভাবশালী এই কূটনীতিক বিএনপি চেয়ারপারসনের সাক্ষাৎ করেননি।
একই সময়ে কাতারের প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন নাসের বিন খলিফা আল থানি বাংলাদেশ সফরে ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে তার বৈঠকের কর্মসূচি ছিল না।
নিশা দিশাই ফিরে যাওয়ার তিন দিন পর বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর। তার সঙ্গেও চেয়ারপারসন কিংবা বিএনপির নেতাদের কারও দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি।
এর আগে বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বিএনপি-প্রধানের কোনো কর্মসূচি ছিল না।
মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বিএনপির সুসম্পর্কের কথা শোনা গেলেও কুয়েত ও কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো কর্মসূচি না থাকায় বিএনপিতে হতাশা নেমে আসে।
তবে ওই সময় বিএনপির কূটনৈতিক কোরের নেতাদের ভাষ্য ছিল, বৈঠকের জন্য তারা কারও পেছনে ঘুরতে পারবেন না। বৈঠক করতে চাইলে সফরকারী পক্ষ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত।
এখানেই শেষ নয়,চীনের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক বহুদিনের। চলতি বছরে চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। তার সঙ্গেও বিএনপি চেয়ারপারসন বা দলটির নেতাদের কোনো সাক্ষাতের কর্মসূচি না থাকা নিয়ে দলের ভেতর নানা কথা শোনা গিয়েছিল।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে ক্রমেই ছিটকে পড়ছে বিএনপি। বৈদেশিক নীতির সঙ্গে কাজ করা নেতাদের সরে যাওয়া ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে দলের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যোগাযোগ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
প্রচার আছে, বিএনপির প্রভাবশালী কূটনীতিক ও ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী দল ছাড়ার পর থেকে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। গত বছর ২৮ অক্টোবর বিএনপির রাজনীতি থেকে বিদায় নেন সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব। এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা-সমালোচনাও হয়।
দলীয় তথ্যমতে,বিএনপির কূটনৈতিক মিশনে কাজ করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, ড. এম ওসমান ফারুক,সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, আ ন ম এহসানুল হক মিলন, চেয়ারম্যানের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির আহ্বায়ক শফিক রেহমান, সদস্যসচিব মুশফিকুল ফজল আনসারী, তরুণ নেতাদের মধ্যে শ্যামা ওবায়েদ, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা প্রমুখ।
দল ছাড়ার আগে এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল শমসের মবিনের।
এদের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর দেশের বাইরে অবস্থান করছেন ড. এম ওসমান ফারুক। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ প্রভাবশালী দেশগুলোতে বিএনপির কূটনৈতিক মিশনে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। বিগত সরকারবিরোধী টানা তিন মাসের আন্দোলনের সময় যুক্তরাষ্ট্রে থেকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলে দলের অবস্থান তুলে ধরেন তিনি।
আন্দোলনের সময় রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার পর থেকে তিনি দলে কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সিজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কারাগারে আছেন শফিক রেহমান।
সবকিছু মিলিয়ে বিএনপি কূটনৈতিক কোর দুর্বল হয়ে পড়ে বলে আলোচনা আছে।
সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করছেন বিএনপির নেতারা।
দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেন বলেই তিনি এই সফরে এসেছেন। আশা করি বাংলাদেশের সঙ্গে প্রভাবশালী এই দেশটির সম্পর্ক আরো জোরদার হবে।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে দুদু বলেন,‘কিছুদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ভোটারবিহীন নির্বাচন নিয়ে তারা আগের অবস্থানে আছে। তারা সরে গেছে এমন কোনো তথ্য নেই। বিএনপিকে তারা বড় দল হিসেবে দেখে বলেই জন কেরি সাক্ষাৎ করেছেন। এর আগে কারা দেখা করেছেন কারা করেননি তা বড় কিছু নয়। শেষ ভালো যার সব ভালো তার। সে হিসাবে আমরা ধরে নিতে পারি সরকারি দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন সম্পর্ক আছে, বিএনপির সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক আছে। আমরা একে পজিটিভ হিসেবে দেখতে চাই।’
(ঢাকাটাইমস/৩০আগস্ট/বিইউ/মোআ)