চট্টগ্রামে সার কারখানা ডিএপির ৫০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার অ্যামোনিয়ার ট্যাংকটির সেফটি বাল্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তিন বছর আগেই। বাল্বটি চালু থাকলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। এছাড়া কয়েক বছর ধরে কট্রোল রুমের মনিটরও কাজ করত না। ফলে যান্ত্রিক ত্রুটির সংকেত নিরূপণ করা যেত না। তাছাড়া সেফটি ট্যাংকের একটি লেভেল ছিল। সেটিও অনেকদিন ধরে অকেজো।
প্রকৌশল বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারীদের মতে, এই লেভেলটি সচল থাকলে ট্যাংকের মধ্যে কী পরিমাণ গ্যাস ছিল তা নিরূপণ করা যেত। সেই সঙ্গে লেভেল গ্যাস ক্যাপটিও ছিল বিকল। এটি চালু থাকলে ট্যাংকের ভেতর-বাইরের অবস্থান জানা যেত। ট্যাংকের ড্রেন লাইনের বাল্বটিও কাজ করত না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মচারী জানিয়েছেন, অ্যামোনিয়া ট্যাংকের ত্রুটির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতেন। তবে এ ব্যাপারে কারখানার কোনো কর্মকর্তা কিছু বলতে রাজি হননি।
এক দশকেও মেরামত বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি
দীর্ঘ ১০ বছরে একবারও মেরামত কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি-১) কারখানাটি। অথচ প্রতিটি কারখানা বছরে ন্যূনতম একবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দীর্ঘদিন তদারকি না থাকায় ডিএপি-১ এর অ্যামোনিয়া গ্যাসের ট্যাংকটিতে ছিদ্র হলেও তা ধরা পড়েনি। যার ফলে গত সোমবার গভীর রাতে বিকট বিস্ফোরণে অন্তত ৫০ ফুট দূরে উড়ে গিয়ে পড়ে ট্যাংকটি। নির্গত হয়ে যায় ট্যাংকের প্রায় ৪০০ টন এমোনিয়া গ্যাস।
ঘন এমোনিয়া গ্যাস অক্সিজেনকে সরিয়ে দেয়। ফলে এই গ্যাস নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয়। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এই রাসায়নিক পদার্থটি সংরক্ষণের জন্য সাধারণত ট্যাংক দ্বি-প্রস্থবিশিষ্ট হয়। ডিএপি-১ তৈরি করেছে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমপ্লান্ট। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের ট্যাংকটি তৈরি করা হয়েছে এক প্রস্থবিশিষ্ট। তার পাশে জাপান নির্মাণ করেছে ডিএপি-২। এখানে পাঁচ হাজার টন ও ৫০০ টনের দুটি অ্যামোনিয়া গ্যাসের ট্যাংক রয়েছে। এগুলো দ্বি-প্রস্থবিশিষ্ট। বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল বিষয়টি প্রসঙ্গে বলেন, একটি চীনা প্রতিষ্ঠান এই কারখানাটি তৈরি করেছে। তাদের প্রকৌশলীরা কী তৈরি করে দিয়ে গেছেন আমরা কিছুই জানি না। এখানে ঝুঁকি মোকাবেলার ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। আমি বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের জানিয়েছি। তারা আমার কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছেন। আমি সেগুলোও পাঠিয়েছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রকৌশলী ঢাকাটাইমসকে জানান, নির্মাণ ত্রুটির কারণে ডিএপি-১ এর ধারণক্ষমতা ৫০০ টন হলেও কখনও ৪০০ টনের বেশি এমোনিয়া গ্যাস সংরক্ষণ করা যেত না। কারখানায় উৎপাদনের শুরুতেই এখানে কিছু ত্রুটি দেখা দেয়। এমনকি প্রধানমন্ত্রী যেদিন কারখানাটি উদ্বোধন করতে আসেন, সেদিনও সেটি চালু করা যায়নি। বাধ্য হয়ে তাঁকে প্রজেক্টরের মাধ্যমে আগে ধারণ করা কারখানার একটি ভিডিও দেখানো হয়।
ডিএপির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল বড়ুয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ট্যাংকে কিছু ত্রুটি ছিল। গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণে দুইটি ব্যবস্থা ছিল। সেগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। কেন তা হলো আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি।
কারখানার ক্ষতি
কারখানা সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে অ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রতি টনের বাজার মূল্য ৫৬ হাজার টাকা। বিস্ফোরিত ট্যাংকে ৩০০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়া থাকলে এক কোটি আটষট্টি লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। ট্যাংকটি পুনঃনির্মাণ করতে কত কোটি টাকা লাগবে সেই হিসাব কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। তবে প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, এ ট্যাংকটি পুনঃনির্মাণ করে কারখারা চালু করতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। সেই হিসেবে আগামী এক বছর কারখানাটির উৎপাদন বন্ধ থাকবে। বর্তমান ডিএপি-১ ও ২-তে ১৫০০ মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও ৬০০ থেকে ৭০০ মেট্রিক টন সার উৎপাদন হয়। প্রতি টন ডিএপি সারের উৎপাদন খরচ ৭৬ হাজার টাকা হলেও সরকার ভর্তুকি দিয়ে ২৩ হাজার টাকায় বিক্রি করে। সেই হিসেবে দৈনিক কমপক্ষে ৫০০ টন সার উৎপাদন হিসেবে এক বছরে গড়ে এক লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টন উৎপাদন হবে। এতে ৪১৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ক্ষতি হবে। কারখানাটি বন্ধ হলে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ওভারটাইম অনেক কিছুতে অনিশ্চয়তা নেমে আসবে। অস্থায়ী শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে পড়বে।
২০০৬ সালে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমপ্ল্যান্ট নামক প্রতিষ্ঠান ডিএপি কারখানাটি নির্মাণ করে দেয়। এ কারখানার দুটি ইউনিটে মোট তিনটি অ্যামোনিয়া গ্যাসের ট্যাংক রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, ডিএপি কারখানাটি ২০১০ সালের ২৮ মার্চ পরিবেশগত ছাড়পত্র লাভ করে এবং আগামী বছরের ২৭ মার্চ পর্যন্ত তা নবায়ন করা আছে।
তদন্ত কমিটি গঠন
গ্যাস বিস্ফোরণে ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও বিসিআইসি আলাদা তদন্ত টিম গঠন করেছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসশনের কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মঈনুল ইসলামকে। অপর দুই সদস্য হলেন কর্ণফুলী থানার ওসি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। বিসিআইসিদ্মর পক্ষে গঠিত কমিটিতে বিসিআইসির পরিচালক (কারিগরি ও প্রকৌশলী) আহ্বায়ক করা হয়। অন্য সদস্যরা হলেন কাফকো প্রাক্তন ডাইরেক্টর মোহাম্মদ সাবের আলী, বুয়েট কেমিকৌশল বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. একেএমএ কাদের, কাফকোর প্রাক্তন সিও শেখ শফি আহমদ, বুয়েটের বিভাগীয় প্রধান ড. এম এ এ শওকত চৌধুরী, সিইউএফএল প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুর রহমান খাঁন, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মহাপরিচালকের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি ও সিইউএফএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু তাহের ভূঁইয়া।তারা তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রদান করবেন।
(ঢাকাটাইমস/২৪আগস্ট/এসইউ/জেবি)