logo ১৯ এপ্রিল ২০২৫
‘সবাই ফাঁসিতে ঝুলুক, অন্তত একটু শান্তি পাব’
ইমতিয়াজ উল ইসলাম ও এম গোলাম মোস্তফা
২১ আগস্ট, ২০১৬ ০৮:৩২:৪৩
image




ছবি দেখে সবাই ভেবেছিল প্রাণহীন। চিকিৎসকরাও ভেবেছিলেন বাঁচানো যাবে না। অথচ আশ্বর্য জীবনীশক্তি সারিয়ে তুলেছে তাকে। কিন্তু এই জীবন মোটেও তার কাছে উপভোগ্য কিছু নয়। শরীরে বিঁধে থাকা স্প্লিন্টার প্রতি মুহূর্তে তাকে যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধু অন্তঃপ্রাণ, শেখ হাসিনা অন্তঃপ্রাণ মাহবুবা পারভীন। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা না ভেবে দলের জন্য নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন সব সময়। সাভারের এই রাজনৈতিক কর্মীর জীবন পুরোপুরি পাল্টে দেয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের নির্মম গ্রেনেড হামলা। তার নিথর দেহের ছবি গণমাধ্যমে আসার পর সবাই তাকে মৃত বলেই ধরে নিয়েছিল।



দিনে দিনে এক যুগ পেরিয়ে গেল। সময়ের আবর্তে বয়ে চলা দিনক্ষণের হিসাব রাখে কজনা? কিন্তু পারভীন জানেন একেকটি দিন কত বড় হতে পারে। শরীরে বিঁধে থাকা গ্রেনেডগুলো প্রতি মুহূর্তে তাকে জানিয়ে দেয়, সময় বয়ে চলেছে।



ক্ষণে ক্ষণে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠেন পারভীন। খুব কাছ থেকে মৃত্যু দেখেছেন। সেই হামলার মানসিক ট্রমা এক যুগেও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এত বড় অপরাধের পরও কেউ শাস্তি পায়নি, এটাও কম যন্ত্রণার কারণ নয় পারভীনের কাছে।



মাহবুবা পারভীন তখন ছিলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। রাজপথের দায়িত্ব পালনে ছিলেন নিষ্ঠাবান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় সামনের সারিতেই ছিলেন। হঠাৎ হলো গ্রেনেড হামলা। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঝরে গেল বহু প্রাণ। আহত হলো শত শত মানুষ। রাজপথের কর্মী পারভীন পড়েছিলেন রাজপথেই। মৃত ভেবেই হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে বেঁচে যান তিনি।



হামলার পর ১২টি বছর ধরে যাপন করছেন ব্যথাতুর জীবন। এখনও রাতের ঘুম কেড়ে নেয় সেদিনের রক্তাক্ত মানুষের আর্তনাদ। সেই হামলার সাক্ষ্য হিসেবে তার শরীরে রয়ে গেছে প্রায় আঠারোশ স্প্লিন্টার। এতগুলো বের করতে কতগুলো অস্ত্রোপচার লাগবে? হয়ত সারা জীবন কাঁচির নিচেই থাকতে হতো। কিন্তু মানুষের শরীর কি অত ধকল নিতে পারে? পারে না বলেই চিকিৎসকরা রেখে দিলেন সব। বললেন, ব্যথা সয়ে থাকতে। তবে মাহবুবার একটি সান্ত¦না, শেখের বেটি তাকে ভুলেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মায়াময় তত্ত্বাবধানে চলছে চিকিৎসা।



এই সময়-এর কাছে জীবনের এই করুণ কাহিনি তুলে ধরতে গিয়ে বারবার অশ্রুসজল হয়ে পড়েছেন মাহবুবা পারভীন। কিন্তু কষ্ট হলেও তিনি বলতে চান, যারা সেদিনের ঘটনা জানেন না, তাদেরকে আবারও জানাতে চান কতটা নির্মম ছিল তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা।  সাভারের শিমুলতলায় জালেশ্বর এলাকার ভবন সিলমাস টাচে স্বামী বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা আবুল মাসুদ ও দুই সন্তানকে নিয়ে ভাড়া থাকেন পারভীন। এক সময়ের রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে তোলা ছবি ও রাজপথের ফ্রেমে বাঁধা অলোকচিত্র বারবার খুলে দেখেন তিনি।



গ্রেনেড হামলায় চিকিৎসা নিলেও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি এখনও। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার তিন দিন পর জ্ঞান ফিরেছিল তার। এসময় তার শরীরের বাম অংশ অবশ হয়ে যায়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে। দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ফেরেন দেশে।



‘নেত্রীর স্নেহেই নতুন করে জন্ম পেলাম।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা পারভীনের। জানান, হামলার পর থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা পরম মমতায় ‘মায়ের মতো’ আগলে রেখেছেন তাকে। প্রতি মাসে চিকিৎসা খরচ বাবদ এখন দশ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের মাধ্যমে। এছাড়া আগে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দুই দফায় ১২ লাখ টাকা দেওয়া হয় তাকে।



রাজনৈতিক কর্মী পারভীনের ঘরে বসে থাকা আরও কষ্টের। বলেন, ‘আমার কাছে এক বেলা খাবারের মতো ছিল মিছিল-মিটিং। কিন্তু এখন বসে থাকতে হয়। তারপরও কর্মসূচির কথা শুনলে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বাসে করে যাওয়া কি আমার মতো মানুষের পক্ষে সহজ?’



কষ্টের স্মৃতি সত্ত্বেও ২১ আগস্ট এক অদ্ভুত ভালোলাগা থাকে পারভীনের।



: কেমন?



: ‘ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আমাকে বুকে টেনে নেন। তখন আমি সব ভুলে যাই। এটা যেন ঈদের মতো আনন্দ’ জবাব শুনে আপ্লুত না হওয়ার উপায় আছে?



সেই দিনের যে বর্ণনা দিলেন পারভীন



মাহবুবা পারভীন বলেন, ‘মিটিং শুরুর এক ঘণ্টা আগেই গিয়েছি। সংসারে কাজ সেরে একটা ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে সমাবেশ স্থলে যাই। মঞ্চে ট্রাকের সামনের চাকার দক্ষিণ সাইডে ছিলাম। শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য শেষ হলো। এরপর জননেত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দিচ্ছেন, আমরা মনোযোগ দিয়ে তার বক্তব্য শুনছি। নেত্রীর বক্তব্যের শেষে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শেষ করতেই পারেননি। সেই মুহূর্তে একটা বিকট শব্দে কি যেন ফুটল। আমি মনে করছি বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বাস্ট হয়েছে হয়ত। পরে দেখি আমার বাম পা, বাম হাত এবং কোমর অবশ হয়ে গেছে। তারপর আরও কয়েকটি বিস্ফোরণ। তার পর আর কিছু বলতে পারি না, আমি জ্ঞান হারাই।



পারভীন বলেন, ‘পরে জানতে পারি আমাকে ভ্যানে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়। সেখান শয্যা না থাকায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আমার দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন চিকিৎসক। এরপর নেওয়া হয় ট্রমা সেন্টারে। এর পর জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কলকাতায় উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।’ ২০০৫ সালে শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে সেখানে ২৫ দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর চিকিৎসকরা আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসা হয় পারভীনের।



মাহবুবা পারভীন বলেন, ‘কলকাতার ডাক্তাররা বলেছেন আমার শরীরে আঠারোশ স্পিøন্টার আছে। একদিন রাতে প্রচ- ব্যথা করছিল, বমির সঙ্গে ওষুধ বের হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে ইনফেকশনের মতো হয়ে গিয়েছিল। তখন তাড়াতাড়ি সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করানো হয়। ওখানেই বাম পায়ের তালু থেকে দুটা আর ডান পায়ের সাইডে থেকে একটা স্পিøন্টার বের করা হয়। দুই পা নিয়ে তখন অনেক দিন ভুগছি। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায় পা।’



স্প্লিন্টারগুলো এখনও যন্ত্রণা দেয়



চিকিৎসা চলছে নিয়মিত। তবু বাঁ হাতটা অচল প্রায়, চোখেও কম দেখেন, ডান কানের শ্রবণশক্তিও কমে গেছে। শরীরের ভেতরের স্পিøন্টার মাঝেমধ্যে ‘মৃত্যু যন্ত্রণা’ দেয়। ‘১২ বছর ধরে গ্রেনেডের স্পিøন্টার দেহের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। সঙ্গে মানসিক যন্ত্রণা। ২০১২ সালের জুলাই মাসে একবার শরীরে প্রচ- ব্যথা শুরু হয়, এত যন্ত্রণা হচ্ছিল পেটে মনে হচ্ছিল বেলুনের মতো কিছু বেরিয়ে আসছিল। তখন আমি বলছিলাম আমি বাঁচতে চাই না, আমি সহ্য করতে পারছি না’ চোখে অশ্রুধারা নিয়ে বলতে থাকেন পারভীন।



সে সময় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয় পারভীনকে। তিনি বলেন, ‘বোর্ড মিটিংয়ে বলেছিলাম আমার মনে হয় আমার সারা শরীরে ক্যানসার হয়ে গেছে। তখন ভিসি প্রাণ গোপাল দত্ত বলেছিলেন স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্যানসার হয় না। ওনার কথায় আশ্বস্ত হয়ে এক মাস ওষুধ খাওয়ার পর ব্যথা কমতে থাকে।’



শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা



মাহবুবা পারভীন বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার ছেলেদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। এককালীন যে ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন সেটা দিয়ে নানা কিছু করার চেষ্টা করেছি। সাভারে একটা পৈতৃক প্লট আছে, সেখানে টিনশেড বাড়ি তুলে ভাড়া দিয়েছি।’ বড় ছেলে আসিফ পারভেজ এবার ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ে এমবিএতে ভর্তি হয়েছে। আর ছোট ছেলে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় পাস করে বের হয়েছে দুই বছর আগে। দুই সন্তান প্রতিষ্ঠিত হলে অন্তত একটা দুশ্চিন্তা কমবে পারভীনের। তিনি বলেন, ‘মিডিয়ার ভাই-বোনরা বারবার আমার কাছে জানতে চেয়েছেন আমার চাওয়া কী। আমি বলেছি, ছেলেদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই। নেত্রী বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমাদের সব দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। এরপর প্রতিমাসেই চিকিৎসার টাকা আমার বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন তিনি।’



নিজ সংগঠনের নেতাদের পাশে না পাওয়ার দুঃখ



রাষ্ট্র চালানোর ব্যস্ততার মধ্যেও ভুলে যাননি শেখ হাসিনা। অথচ যে সংগঠনের কর্মী ছিলেন পারভীন, সেই স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা সমবেদনার হাত বাড়াননি তার দিকে। এ জন্য অভিমান ঝরে পড়ে তার কথায়। বলেন, ‘তারা আমার কোনো খেয়াল রাখেনি এবং খোঁজখবর নেয়নি। নেত্রী যদি আমার পাশে না দাঁড়াতেন তবে আমি এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারতাম না।’ পারভীন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। অথচ দলের কোনো নেতা বা স্থানীয় সংসদ সদস্য বা সংগঠনের কেউ আমার খোঁজ নিতেও আসে না। এই কষ্ট কই রাখি ভাই।’



বিচারের অপেক্ষা



শরীরের যন্ত্রণা যতটা না কষ্ট দেয় পারভীনকে, মনের যন্ত্রণা আরও বেশি পিষ্ট করে তাকে। বলেন, ‘সেদিনের কথা মনে করলে এখনও গা শিউরে ওঠে। মনে হয় নিজ হাতে শাস্তি দেই ওদের। কেমন করে এই কাজটা করতে পারল তারা? এতগুলো মানুষকে মেরে ফেলল? নেত্রীকে হত্যা করার মতো সাহস করল? অথচ এখনও এদের কিছুই হলো না।’



পারভীন বলেন, ‘জানি না কতদিন বাঁচব। তবে মৃত্যুর আগে বিচার দেখে যেতে চাই। সবাই ফাঁসিতে ঝুলুক, অন্তত একটু শান্তি পাব। আর কেবল আমরা না, আইভি আপা শান্তিতে থাকবেন, শান্তিতে থাকবেন আরও ২৩ জন। তারাও হয়ত আমার মতোই বিচারের অপেক্ষায় আছেন।’







(ঢাকাটাইমস/২১আগস্ট/ইএম/জিএম/ডব্লিউবি)