যাদের হাত ধরে বাংলাদেশে উগ্রবাদী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের যাত্রা শুরু তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউট- আইবিএর শিক্ষক মহিউদ্দীন আহমেদ। সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার পর তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির চার শিক্ষককে পদচ্যুত করা হয় ২০১২ সালেই। এদের একজন হাসনাত আর করিম গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। এক দফা রিমান্ড শেষে তাকে আবার রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। বাহিনীটির দাবি, এই হামলার সঙ্গে হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছেন তারা।
উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার শিক্ষকের চাকরি গেলেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত একজনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধীরে চল নীতি নিয়েছে। মহিউদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে মামলা চলার পরও কেন তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি- জানতে চাইলে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আদালতে তিনি যদি দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন মহিউদ্দীন
এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আবাসিক ভবনেই থাকছেন মহিউদ্দীন আহমেদ। অনেকটা বিচ্ছিন্ন জীবনে নিজেকে আটকে রেখেছেন। তিন সন্তানের স্কুলে যাওয়া আসা ছাড়া বাইরে বের হন না বললেই চলে। আবাসিক ভবনে অন্য শিক্ষক-পরিবারের সঙ্গে তার নেই দেখাশোনা।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে মহিউদ্দীন আহমেদর বিরুদ্ধে উত্তরা মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ২০১০ সালে মামলা করে পুলিশ। ওই বছরের ২০ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন তিনি। হাইকোর্ট থেকে ২০১১ সালের ৩ মে জামিন পান। পরের বছর কারাগার থেকে মুক্ত হন।
তবে তাকে যে অভিযোগ গ্রেপ্তার ও মামলা করা হয়েছে সেই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করছেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলছেন, তার সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের কোনো সম্পর্ক সেই। তিনি কখনই হিযবুতের প্রধান ছিলেন না। এই ধরনের লিখিত প্রমাণ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও দিয়েছেন বলে দাবি করেন মহিউদ্দীন। কেন নিজেকে তিনি লুকিয়ে রাখছেন সে বিষয়ে কিছুই বলেননি মহিউদ্দীন।
রাজধানীর গ্রিনরোডে আইবিএর প্রফেসর্স কোয়ার্টারে মহিউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে দেখা হয় দাঁড়োয়ান সুজাদ আলীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘স্যার বাসায় নেই। ছেলেকে আনতে স্কুলে গেছেন।’
সুজাদ আলী বলেন, ‘স্যারের সাথে সেইভাবে কথা-বার্তা হয় না। তার পরিবার সম্পর্কেও জানি না।’ তবে এই কোয়ার্টারে থাকা অন্যদের সবার সম্পর্কেই আমরা কম-বেশি জানেন সুজাদ। তিনি বলেন, ‘স্যার মামলা খাওয়ার পর থেকে আর ক্লাস নেন না। তবে বাসায় ঠিকই থাকেন। সকালে সন্তানদেরকে স্কুলে নিয়ে যান। আর দুপুরে গিয়ে নিয়ে আসেন।’
দাড়োয়ানের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই রিকশায় করে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরলেন মহিউদ্দীন আহমেদ। ভবনের চতুর্থ তলায় তার বাসায় গিয়ে কথা বলার অনুমতি চাইলে ঘরের ভেতর থেকে একজন পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় দেয়ার পর বললেন- ‘স্যার তো কথা বলে না’। এই প্রতিবেদকের অনুরোধের পর ভেতর থেকে বলা হল- ‘ওয়েট করুন’।
এসব কথা হচ্ছে দরজায় তালা ঝুলানো অবস্থাই। এরপর ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। এরই মধ্যে বাইরে থেকে মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরছেন মহিউদ্দীন আহমেদের স্ত্রী। তিনি চারতলায় উঠতেই সিঁড়ি থেকে এই প্রতিবেদককে জিজ্ঞাস করলেন, ‘আপনি কে?’
পরিচয় দেয়ার পর ওই নারী বললেন, ‘কী বলবেন আমাকে বলেন।’ মহিউদ্দীন আহমেদের সঙ্গেই কথা বলতে চাই- প্রতিবেদকের এমন অনুরোধে তিনি গেট খুলে ভেতরে ঢুকে ফের দরজায় তালা দিয়ে দিলেন। বলেন, ‘সাংবাদিকদের প্রতি আমাদের আস্থা নেই। তাদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। আপনারা কোনো উপকার করেন না। ক্ষতি করেন।’
কথা না বললে উপকার কীভাবে করবো- এমন প্রশ্নের পর কিছুটা নরম সুরে মহিউদ্দীন আহমেদ জানান, ‘ভাই আমার সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের কোনো সম্পর্ক বর্তমানে নেই। আমি হিযবুতের প্রধান সমন্বয়কারীও নই। আমাকে খামাখা প্রধান সমন্বয়কারী বানানো হয়েছে।’
চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছেও এই বক্তব্য দিয়েছেন মহিউদ্দীন আহমেদ। আবেদনের একটি কপি ঢাকাটাইমসকেও সরবরাহ করেন। এতে তিনি দাবি করেন হিযবুতের প্রধান তো দূরে থাক, তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনটির সাধারণ সদস্যও নন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে তার চাকরি ফিরিয়ে দেয়া এবং বেতন ভাতা দেয়ার অনুরোধ করেন ওই চিঠিতে।
কিন্তু বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড চলার সময় বিভিন্ন সভা-সেমিনারে হিযবুতের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন মহিউদ্দীন। বিভিন্ন সেমিনারের সভাপতিও ছিলেন তিনি। এখন কেন সম্পর্ক অস্বীকার করছেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই চ্যাপ্টার বাদ দেন। এখন তো কোনো সম্পর্ক নেই। এটাই মূল কথা। তখন নিষিদ্ধ ছিল না। এখন নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধের পর থেকে কোনো ধরনের সম্পর্ক ওই সংগঠনের সঙ্গে নেই।’
মহিউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে কথা বলতেই পাশ থেকে তার স্ত্রী কথা টেনে নিয়ে বললেন, ‘আমার স্বামী এখন কোনো দলের সঙ্গে নেই। তার দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। আমরা প্রশা্সনকে বলেছি, তিনি কোনো দল করেন না।’
আর্থিক সুবিধা পাওয়া নিয়ে অসত্য দাবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেলেও তা অস্বীকার করছেন হিযবুত তাহরীরের নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে নিজ বাসায় গেটের তালার ফাঁক দিয়ে এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, ‘আমি মানবেতর জীবন যাপন করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো আর্থিক সুবিধাই আমি পাই না ‘ আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে থাকেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে তো চাকরিচ্যুত করা হয়নি। বাসা তো আমার নামে অ্যালোটেড।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি বেতনের ৫০ শতাংশ টাকা প্রতি মাসেই পাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বিষয়টি ঢাকাটাইমসকে নিশ্চিত করে জানান, কেউ বাধ্যতামূলক ছুটিতে গেলে তার বেতন বন্ধ হয় না। বেতনের ৫০ শতাংশ পান। মহিউদ্দীন আহমেদও নিয়মিতই টাকা পাচ্ছেন।
মামলার কী অবস্থা
মহিউদ্দীন আহমেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে উত্তরা মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ২০১০ সালে মামলা করে পুলিশ। ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ছয় জনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। মামলাটি বিচারের জন্য ওই বছরের ২১ এপ্রিল ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। তখনই আদালত থেকে মামলার অনুমোদনের প্রথম দফা চিঠি পাঠানো হলেও অনুমোদনের কোনো কাগজপত্র আদালতে আসেনি। সবশেষ গত ২৮ মার্চ তৃতীয় দফা চিঠি পাঠানো হয়।
কেবল মহিউদ্দীন নয়, আরও দুই জঙ্গি নেতা জেএমবির মাওলানা সাইদুর রহমান ও আনসারউল্লাহ উল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীমউদ্দীন রাহমানীর বিচারের জন্যও অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না- এমন একটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে।
ঢাকাটাইমস/১৮আগস্ট/এমএম/ডব্লিউবি