নিজের জীবন তুচ্ছ করে দু-দুটি জীবন বাঁচালেন একজন সারোয়ার। মানবজীবনের মহত্ত্বের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বরগুনা থেকে ঢাকায় আসা শ্রমজীবী মানুষটি।
সারোয়ারের বন্ধুরা জানান, মানুষের বিপদে-আপদে এগিয়ে যাওয়া ছিল সারোয়ারের সহজাত প্রবণতা। কোনো বৃদ্ধার চিকিৎসার মানুষ নেই, কারও লাশ বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার লোক নেই, সারোয়ার এগিয়ে গেছেন এসব অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে।
ঢাকায় অটোরিকশা চালাতেন সারোয়ার। বন্ধু ট্রাকচালক আক্তারকে নিয়ে তিনি সোমবার দুপুরের দিকে ঘুরতে গিয়েছিলেন রাজধানীর ভাটারা এলাকায়। বালু নদীর পাড়ে তিন নম্বর সেতুর কাছে যেতেই তাদের কানে ভেসে আসে কিশোর কণ্ঠে প্রাণ বাঁচানোর আকুতি।
ভেসে আসা শব্দ অনুসরণ করতেই সারোয়ার ও আক্তারের চোখে পড়ে দুই কিশোর খালের পানি থেকে তীরে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তীব্র স্রোতের কারণে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। মুহূর্তেই দুই বন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়েন পানিতে। দুই কিশোরকে বাঁচাতে পারলেও নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না সারোয়ার। স্রোতের টানে তলিয়ে যান পানিতে।
এর ঘণ্টা চারেক পর ঘটনাস্থলের ১০০ গজ দূরে সারোয়ারের মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
তিন ভাই আর দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন সারোয়ার। বাবা আজহার মৃধা মারা গেছেন আগেই। ঢাকায় তিন ভাইয়ের আয় থেকে বরগুনা সদর উপজেলার বড়গলা কাটিয়া গ্রামের বাড়িতে চলে মায়ের সংসার।
পুলিশ জানায়, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দুই স্কুলশিক্ষার্থী নদীতে পড়ে যাওয়া বল তুলতে পানিতে নেমেছিল। কিন্তু স্রোতের কারণে তীরে উঠতে পারছিল না তারা। সারোয়ার ও আক্তার ওই দুই শিক্ষার্থীকে উদ্ধারে নেমে পড়েন পানিতে।
দুই শিক্ষার্থীসহ আক্তার যখন খালের পাড়ে ওঠেন, তখন সারোয়ারের চিহ্নটি নেই। আশপাশে খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি তাকে।
ততক্ষণে এলাকাবাসীর ভিড় জমে যায় খালপাড়ে। খবর যায় ফায়ার সার্ভিসে। ছুটে আসেন ডুবুরিরা। কয়েক ঘণ্টা তল্লাশির পর বিকাল পাঁচটার দিকে যখন সারোয়ারকে পাওয়া যায়, তখন নিথর স্পন্দনহীন তার দেহ।
উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া ফায়ার সার্ভিসের বারিধারা শাখার পরিদর্শক মিলন মিয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘স্রোতের তীব্রতায় বালুর ভেতর আটকে যান সারোয়ার। ফলে তিনি আর নড়াচড়া করতে পারেননি। পানির মধ্যে থাকা অবস্থায়ই মৃত্যু হয় তার।’
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ জলিল ঢাকাটাইমসকে জানান, বেলা পাঁচটার কিছুক্ষণ পর সারোয়ারকে মৃত অবস্থায় ওই খাল থেকে উদ্ধার করা হয়।
ঘটনাস্থলে কথা হয় প্রত্যক্ষদর্শী মাসুদা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১২টার দিকে আমার পোলা সরফরাজ জানায়, দুজন বালু নদীর চিতাখলায় পড়ছে। আমি আইসা দেখি ট্রাক ডেরাইবার আর সরোয়ারে মিইল্যা তাগো তুলার চেষ্টা করছে। দুই পোলারে খালের কিনারে তুইল্যা দেয়ার পর একজন ওপরে উইঠ্যা যায়। কিন্তু পানিত তলায়া যায় সরোয়ার।’
ভাটারার মোড়ে একটি বাসায় থাকতেন সরোয়ার। সেখানে কথা হয় তার বন্ধু শামীমের সঙ্গে। চোখে তখন তার অশ্রুধারা। বন্ধুর মৃত্যুতে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন না শামীম। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, “ওর সারা জীবনের নেশা ছিল মানুষের জন্য কাজ করা। আর হে এই কাম করতে গিয়াই মইরা গেল। আসলে ভালো মানুষ বেশি দিন বাঁচে না।’
সারোয়ার কেমন মানুষ ছিলেন কিছু উদাহরণ দিয়ে তা বলার চেষ্টা করেন শামীম। তিনি জানান, কিছু দিন আগে তার এক বন্ধুর মা মারা যাওয়ার পর কেউ এগিয়ে আসেনি। তখন সারোয়ার মরদেহ কুমিল্লায় দিয়ে এসেছেন।
ভাটারা এলাকায় এক বৃদ্ধা টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। অটোরিকশা চালিয়ে জমানো টাকা দিয়ে ওই বৃদ্ধার চিকিৎসা করিয়েছেন সরোয়ার। বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন শামীম।
ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট সরোয়ার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন। বড় ভাই মোকলেস রিকশা চালান। মেজ ভাই গুলশান ক্লাবে চাকরি করেন। দুই বোন সালমা আর হনুফা তাদের স্বামীর সঙ্গে থাকেন।
সারোয়ারের নিথর দেহ উদ্ধারের পর বড় বোন সালমাকে দেখা গেছে মরদেহের পাশে বিলাপ করতে। তিনি ভাইয়ের মরদেহের পাশে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন আর বলছেন, ‘কেন পানিতে নামল ভাই। কোথায় গেলে পাব ভাইরে।’
মেজ ভাই স্বপন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মারে এহনও জানাই নাই। হের খবর জানলে মারে বাঁচানো যাইব না। কিন্তু এই কথা তো জানাইতেই হইবে। তাইলে কীভাবে কী করুম বুঝতেছি না।’
(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/এমএম/ডব্লিউবি/মোআ)