মানুষের জন্য অসম্ভব মায়া ছিল তার। নিজে কায়ক্লেশে থেকেও অসহায়ের সহায় হওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর এই মায়াই তাকে কেড়ে নিল পৃথিবী থেকে।
তিনি রবিউল করিম। পেশাগত পরিচয় ছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার। সৎ, নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ছিল সুনাম, কর্মজীবনে এতটুকু কালো ছায়া পড়েনি তার গায়ে।
বেশ কিছু নিরস্ত্র মানুষ বিপদে পড়েছে, অস্ত্রধারীরা তাদের ওপর হামলা করেছে- এই খবর যখন তার কানে আসলো তখন নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবার সময় ছিল না তার। ছুটে যান যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়াই। সন্ত্রাসীদের গুলি আর গ্রেনেডের স্প্লিন্টার জীবন কেড়ে নেয় রবিউলের।
তিনি কেন প্রস্তুতি ছাড়াই ছুটি গিয়েছিলেন? জবাব হলো, তিনি তো এমনই। অন্যের জন্য কাজ করছেন সেই ছোটবেলা থেকেই। অতকিছু ভাবার সময় তার যে ছিল না।
ভাবছেন রবিউল কী এমন করেছেন যে এত প্রশংসাবাণী লিখা হচ্ছে? সেই প্রশ্নের জবাবও তিনি তার কাজ দিয়েই করে গেছেন। নিজ জেলা মানিকগঞ্জে সমাজের সমাজের চোখে অচ্ছুৎ মানুষদের জন্য রবিউল যা করেছেন তা কয়জনই বা করতে পারে।
যখনই ছুটি পেতেন রবিউল চলে যেতেন নিজ গ্রামে। এরপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করতেন প্রতিবন্ধী শিশুদের। তাদের শিক্ষার জন্য নিজের যা কিছু আছে তা দিয়েই প্রতিষ্ঠান করেন একটি স্কুল। সেই স্কুলে দেখতে দেখতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ জনে।
রবিউল বেঁচে থাকলে এই স্কুলটির ভবিষ্যত নিয়ে কাউকে হয়ত ভাবতে হতো না। কিন্তু এখন স্কুলটি টিকে থাকা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
তবে স্বজন আর বন্ধুরাও রবিউলের স্বপ্নকে এত সহজে হারিয়ে যেতে না দেয়ার পণ করেছেন। বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখা হবে। এ জন্য সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌসও।
রবিউলের সেই স্কুল
মানিকগঞ্জের নয়াডিঙ্গী থেকে সাত কিলোমিটার দূরে কাটিগ্রাম এলাকার বাসাই গ্রাম। এ গ্রামের কাঁচা রাস্তার পাশে মায়ের দেয়া ২৯ শতাংশ জমির উপর চৌড়ি টিনের ঘর। এ ঘরের সামনে রয়েছে বিশাল পুকুর। আর পুকুরের চারপাশে লাগানো সারি সারি সুপারি গাছ। এমনই একটি শান্ত গ্রামের ভেতর গড়ে তোলা প্রতিবন্ধী শিশুদের বিদ্যাপীঠ দেখতে যেন একটি সাজানো বাগান।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিজ এলাকাসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকার দরিদ্র প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনা বেতনে পড়ার জন্য ‘ব্লুমস’ নামের এ বিদ্যাপীঠ গড়ে তুলেন রবিউল করিম। এখন তাঁর স্কুলে মানসিক, শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়ানো হয়, দেয়া হয় জীবনের শিক্ষা।
স্কুলের চার শিক্ষকের একজন শামীমা নাসরিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘রবিউল ভাই সব সময় স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের খোঁজ নিতেন। কোন প্রতিবন্ধী শিশু যেন মন খারাপ করে না থাকে সে জন্য তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলার অনুরোধ করতেন। এসব শিশুদের যখন যা লাগবে তিনি তা কিনে দিতে বলতেন। তিনি যখন ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসতেন তখন প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্লাশ নিতেন।’
শিশুরাও রবিউল ভাইকে বড় স্যার বলে ডাকতেন। শামীমা বলেন, ‘রবিউল ভাই জীবিত থাকতে প্রতিবন্ধী শিশুরা যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন ভবিষ্যতে এ ধরনের সুযোগ সুবিধা পাবেন কিনা তা নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন শিশুদের অভিভাবকেরা।’
স্কুলের প্রশাসনিক পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘রবিউল করিমের স্বপ্ন ছিল সমাজের অবহেলিত শারিরিক ও মানসিক সক্ষমতাহীন সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশু কিশোরদের জন্য স্কুল করার। পুলিশে যোগ দেয়ার পর বেতনের অর্থ থেকে প্রতিমাসে কিছু জমিয়ে সেই সপ্ন পূরণ করেন তিনি। শিশুদেরকে এখানে বিনাবেতনে পড়ানো হয়। বই-খাতা, কলম, স্কুলব্যাগ, পোশাক সব কিছুই দেয়া হয়। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রতিদিন বিশেষ খাবারও দেওয়া হয়। এখানে একটি স্কুল ভ্যান রয়েছে যেটি দিয়ে শিশুদের বাড়ি থেকে আনা-নেওয়া করা হয়।বছরে তিনবার প্রতিবন্ধী শিশু ও তার পরিবারদের চিকিৎসা সেবাও দেয়া হয়।’
আর রবিউল করিমের স্ত্রী উম্মে সালমা বেগম বলেন, ‘স্কুলটি নিয়ে রবিউল করিমের আরো অনেক স্বপ্ন ছিল। স্কুলের পাশে প্রতিবন্ধী শিশুদের থাকার জন্য আবাসিক একটি কক্ষ করার কথা ছিল রবিউলের। একটি কৃষি খামার আর শিশুদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল পাশাপাশি বৃদ্ধাদের জন্য একটি আশ্রম করতে চেয়েছিলেন রবিউল করিম।’
রবিউলের ছোটভাই সামসুজ্জামান সামস বলেন, ‘সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রবিউল করিমের হাতেগড়া এ স্মৃতি ধরে রাখা হবে।’
রবিউল করিম নিহত হওয়ার পর বেশ কয়েকবার তার বাড়ি গিয়ে পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছেন জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস। তিনি স্কুলটি রক্ষায় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
১৯৯৭ সালে স্থানীয় কাটিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করার পর ধামরাই উপজেলার ভালুম আতাউর রহমান খান কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন রবিউল করিম। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার পর পারি জমান ইতালিতে। সেখানে দুই বছর থাকার পর আবার বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর ৩০ তম বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে যোগ দেন পুলিশ বাহিনীতে। আর গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জিম্মিদের মুক্ত করার চেষ্টায় গিয়ে প্রাণ হারান রবিউল।
ঢাকাটাইমস/১১আগস্ট/ডব্লিউবি